Advertisement
২৮ এপ্রিল ২০২৪

প্রতিবাদী মেয়েটির খাতায় শক্তির কবিতা

ভৌতবিজ্ঞান খাতার শেষ পৃষ্ঠায় নীল কালিতে লেখা কবিতার পঙ্ক্তি। ‘নদী নদী নদী সোজা যেতিস যদি সঙ্গে যেতুম তোর আমি জীবনভর।” কিন্তু যার খাতা সে চলে গিয়েছে। মঙ্গলবার সকালে জলপাইগুড়ির ধূপগুড়িতে বাড়ি থেকে সামান্য দূরে রেললাইনের পাশে পাওয়া গিয়েছে তার ক্ষতবিক্ষত বিবস্ত্র দেহ। কিছু দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল তার পোশাক।

অনির্বাণ রায়
ধূপগুড়ি শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:১৫
Share: Save:

ভৌতবিজ্ঞান খাতার শেষ পৃষ্ঠায় নীল কালিতে লেখা কবিতার পঙ্ক্তি। ‘নদী নদী নদী সোজা যেতিস যদি সঙ্গে যেতুম তোর আমি জীবনভর।”

কিন্তু যার খাতা সে চলে গিয়েছে। মঙ্গলবার সকালে জলপাইগুড়ির ধূপগুড়িতে বাড়ি থেকে সামান্য দূরে রেললাইনের পাশে পাওয়া গিয়েছে তার ক্ষতবিক্ষত বিবস্ত্র দেহ। কিছু দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল তার পোশাক। তার আগের রাতেই পাওয়ার টিলারের ভাড়া না মেটানোয় একটি সালিশি সভায় তার বাবাকে মারধর করার সময়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল দশম শ্রেণির ছাত্রী সেই কিশোরী। সেই ‘অপরাধে’ তাকে থুতু চাটতে বলা হয়েছিল। তখন অপমানে ক্ষোভে সে সেখান থেকে পালায়। সারা রাত আর তার কোনও খোঁজ মেলেনি। পরদিন তার দেহ উদ্ধার হয়।

তার সহপাঠীদের কথায়, সেই কিশোরী কবিতা পড়তে ভালবাসত, অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করত। কখনও স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে শিক্ষককে হেনস্থার প্রতিবাদ। কখনও পুলিশ অফিসারের সামনে প্রতিবাদ। মাত্র ১৫ বছরেই স্কুলে এবং এলাকায় স্পষ্টবক্তা প্রতিবাদী মেয়ে হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিল দশম শ্রেণির ছাত্রীটি। অন্যায়ের কাছে মাথা নিচু করতে না চাওয়ার জেরেই তাকে দুনিয়া থেকে সরে যেতে হয়েছে বলে মনে করছে তার সহপাঠীদের অনেকে। কয়েকজন সহপাঠীর কথায়, “খুব সোজাসাপটা কথা বলত। পরোপকারী ছিল। অন্যায় দেখলে রুখে দাঁড়াত। কবিতা পড়তে ভালবাসত। শক্তি চট্টোপাধ্যায় ছিল ওর প্রিয় কবিদের একজন।” তাই তাঁর কবিতার পঙ্ক্তিই লিখে রেখেছিল নিজের খাতায়।

ওই ছাত্রী যে স্কুলে পড়ত, সেখানকার ইংরেজির শিক্ষক সঞ্জয় ঘোষ জানান, ওই কিশোরীকে সোজা পথেই চলতে দেখেছেন তিনি। একবার স্কুলের সামনে একদল লোক অশান্তি করছিল। তিনি বলেন, “আমি তখন বাধা দেওয়ায় আমাকে কটূক্তি করছিল তারা। সে সময় অন্য সব ছাত্রছাত্রীকে ডেকে সেই লোকদের দিকে ধেয়ে যায় ওই ছাত্রী। সে দিন ওর প্রতিবাদী চেহারা দেখেছিলাম।” স্কুলের প্রধান শিক্ষক ধরেন্দ্রনাথ রায় জানালেন, বছরখানেক আগের সেই ঘটনা এখনও তাঁর মনে আছে। তিনি বলেন, “সে দিন স্কুলের সামনে অনেকে জড়ো হয়েছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মদ্যপও ছিল বলে অভিযোগ। ও কিন্তু ভয় পায়নি।” স্কুলের পরিচালন সমিতির সভাপতি ননীগোপাল সরকারের কথায়, সে দিন ওই ছাত্রীর নেতৃত্বেই সব পড়ুয়ারা গলা মেলানোয় স্কুলের গেট থেকে সরে যায় ওই লোকেরা।

তাই সোমবার রাতে তৃণমূল মাতব্বরদের ডাকা সালিশি সভায় বাবাকে মার খেতে দেখে ছাত্রীটি চেঁচিয়ে উঠেছিল। সে চিৎকার করে বলেছিল, “তোমরা এমন করতে পার না। দেশে আইন আছে। কেন চুপ করব। আমি বাবার মেয়েও, আমি বাবার ছেলেও। তোমরা আমাকে জবাব দাও।”

তার বাবাও জানতেন মেয়ে এরকমই। তিনি জানান, কয়েক মাস আগেও এক তৃণমূল নেতা তাঁর বিরুদ্ধে নলকূপের মাথা চুরির অভিযোগে পুলিশকে জানিয়েছিলেন। পুলিশ তাঁর বাড়িতে যায়। তিনি বলেন, “মেয়ে তখন গ্রেফতারের কাগজপত্র দেখতে চায়। সেই সব প্রশ্ন করতেই পুলিশ চলে যায়।”

তিনি জানান, সোমবারও সালিশি সভায় প্রতিবাদ করে। কিন্তু থুতু চাটানোর হুমকি দিতেই মেয়ে ছিটকে ওঠে। তার দেহ উদ্ধারের পরে ইতিমধ্যেই তিন দিন, তিন রাত কেটে গিয়েছে। শোক সামলে এখন তার ৫ দিনের শ্রাদ্ধের আয়োজন করছেন বাড়ির লোকজন।

শুক্রবার সকালে দরমা বেড়ার ঘরে দিদির বই খাতার সামনে বসেছিল ছোট দুই ভাই-বোন। সামনে খোলা সেই ভৌতবিজ্ঞান খাতার শেষ পৃষ্ঠা। পঙ্ক্তিটির উপরে যত্ন করে লেখা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নাম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

rape case murder dhupguri anirban roy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE