এমনটা যে হবে, তা এক রকম যেন জানাই ছিল সিবিআই-কর্তাদের। বছর খানেক আগে সেই মতো প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গিয়েছিল সংস্থার অন্দরে। তখন উত্তর-পূর্বের দুই রাজ্য অসম ও ত্রিপুরা তাদের রাজ্যে সারদা-কেলেঙ্কারির তদন্তের ভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়ার আর্জি জানিয়েছিল কেন্দ্রের কাছে। তবে বাধ সেধেছিল পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশা।
পরে ওড়িশাও রাজি হয়ে গেল। কিন্তু শেষ দিন পর্যন্ত নিজেদের আপত্তিতে অনড় রইল পশ্চিমবঙ্গ। শুক্রবার সেই আপত্তিকে উড়িয়েই দেশের সর্বোচ্চ আদালত সারদা-কেলেঙ্কারির তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিতেই নড়েচড়ে বসল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাটি। প্রস্তুতি এক রকম ছিলই। সুপ্রিম কোর্টের এ দিনের রায়ের পরে এখন সরকারি ভাবে নির্দেশ হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় সংস্থার অফিসারেরা! নির্দেশ হাতে পাওয়ার পর ক’দিনের মধ্যেই পুরো ক্ষমতা নিয়ে তদন্তে ঝাঁপিয়ে পড়তে তৈরি তাঁরা। সিবিআইয়ের এক অফিসারের কথায়, “ত্রিপুরায় সারদা-সহ বিভিন্ন অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই তদন্ত শুরু করে দেওয়া হয়েছে। আমরা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের অপেক্ষা করছিলাম।” তবে সিবিআইয়ের আশঙ্কা, এক বছর পরে তাদের হাতে তদন্ত ভার তুলে দেওয়া হচ্ছে। এর মাঝে যে নথি নষ্ট করে ফেলা হয়নি, তার নিশ্চয়তা কোথায়? একই সঙ্গে শীর্ষ আদালতের স্পষ্ট নির্দেশের পরেও পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের কাছ থেকে কতটা সহযোগিতা মিলবে, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে সিবিআইয়ের। যদিও রায় ঘোষণার পর সরকারের তরফে সিবিআই-কে সব রকম সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
এ দিন আদালতের নির্দেশ জানার পরে দিল্লিতে সিবিআই ডিরেক্টর রঞ্জিত সিংহ উচ্চপদস্থ অফিসারদের নিয়ে বৈঠক করেন। কোন কোন বিভাগের কত জন অফিসার নিয়ে দল তৈরি হবে, তা নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়। পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, অসম ও ত্রিপুরা এই পাঁচ রাজ্যে বিস্তৃত সারদা মামলা। অভিযোগ, এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক চক্রেরও যোগ রয়েছে। ফলে এই ধরনের মামলায় তদন্তের দায়িত্ব সদর দফতরের অফিসারদেরই দেওয়া হয়। সিবিআইয়ের সদর দফতর দিল্লিতে হলেও সারদা-কেলেঙ্কারির দায়িত্ব সংস্থার মুম্বই শাখার ইকনমিক অফেন্স উইং (ইওডব্লিউ)-কে দেওয়া হতে পারে বলে সংস্থা সূত্রের খবর।
কিন্তু পাঁচ রাজ্য ও বিদেশে টাকা লেনদেনের অভিযোগ থাকায় সারদা-কেলেঙ্কারির তদন্ত কি সিবিআইয়ের পক্ষে সুষ্ঠু ভাবে করা সম্ভব? বিশেষত তাদের হাতে যেখানে অনেক মামলার ভার জমে রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ তাঁর দলের অনেকে আবার প্রশ্ন তুলেছেন এই কেন্দ্রীয় সংস্থার দক্ষতা নিয়েই।
এ প্রসঙ্গে সিবিআইয়ের এক কর্তা বলেন, “আমাদের উপর কাজের চাপ রয়েছে। তা ছাড়া সারদার শিকড় অনেক দূর বিস্তৃত। তবে অন্যান্য সংস্থার সাহায্য নিয়ে এই কাজ করা যাবে। কিছুটা সময় লাগবে” ওই কর্তার ইঙ্গিত, পুলিশের থেকে সারদা-কাণ্ডের সব নথি হাতে এলেও সুদীপ্ত সেন ও অন্যান্য অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে করা সবক’টি মামলার তদন্ত না-ও করতে পারে সিবিআই। কেন? ওই কর্তার ব্যাখ্যা, গত এক বছরে সারদার ঘটনায় প্রায় ৫৫০টি মামলা হয়েছে। এর সবক’টিতে হাত দিলে দীর্ঘসময় লাগবে। তাই গুরুত্বপূর্ণ কিছু মামলাকে বেছে নিয়ে তদন্ত শুরু হতে পারে। উদ্দেশ্য হল, মূল অভিযুক্তদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া।
সারদা-কাণ্ডে ইতিমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে দুই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) এবং সিরিয়াস ফ্রড ইনভেস্টিগেশন অফিস (এসএফআইও)। সিবিআইয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, সত্যম কেলেঙ্কারি, মধু কোড়া-সহ সাম্প্রতিক কালের বহু ঘটনার তদন্তে নেমে অনা্যন্য কেন্দ্রীয় সংস্থার অফিসারদের সাহায্য নেওয়া হয়েছে। এক অফিসারের কথায়, “সারদায় ১০ হাজার কোটি টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ, ২৫ লক্ষ মানুষ তার শিকার। এত বড় ঘটনার তদন্তের জন্য ইডি এবং এসএফআইও-র সাহায্যও জরুরি।” ওই কর্তা জানান, সারদার টাকা বিদেশে লেনদেন হয়েছে কি না, মূলত সেই দিকটা খতিয়ে দেখছে ইডি। আর লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষের টাকা নয়ছয়ের পিছনে কারা জড়িত, তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করবে সিবিআই। তাই ইডি-র সাহায্য বেশি প্রয়োজন।”
সারদা মামলায় গ্রেফতার হয়ে জেলে রয়েছেন সুদীপ্ত সেন, তাঁর ছেলে শুভজিৎ সেন, সংস্থার অন্যতম কর্ত্রী দেবযানী মুখোপাধ্যায়, সোমনাথ দত্ত এবং তৃণমূলের সাংসদ কুণাল ঘোষ। এঁদের কি সিবিআই নিজেদের হেফাজতে নেবে? ওই অফিসার বলেন, “কোনও অভিযুক্ত একটি মামলায় ১৪ দিনের বেশি তদন্তকারী সংস্থার হেফাজতে থাকেন না। তবে দেখতে হবে, এঁদের নামে কতগুলি করে মামলা রয়েছে। যদি সুদীপ্ত সেনের নামে ১০টি মামলা থাকে, তা হলে তাঁকে মোট ১৪০ দিনের জন্য হেফাজতে পাওয়া যেতে পারে। দেখতে হবে, ইতিমধ্যে তিনি কত দিন জেলে রয়েছেন।” সিবিআইয়ের ওই অফিসারের মতে, প্রধান অভিযুক্ত সুদীপ্তকেই প্রথমে নিজেদের হেফাজতে নিতে চায় সিবিআই। কেন্দ্রীয় সংস্থা যাঁদের নিজেদের হেফাজতে নেবে, তাঁদের রাখা হবে লালবাজারের সেন্ট্রাল লকআপে। মামলার শুনানি হবে আলিপুরে।
সাধারণত, দেশে আর্থিক কেলেঙ্কারি, অবৈধ টাকা লেনদেন (মানি লন্ডারিং), বাজার থেকে বেআইনি ভাবে টাকা তোলার ঘটনার তদন্ত করে সিবিআইয়ের ইওডব্লিউ। আবার, আর্থিক লেনদেনের পরিমান ২৫ কোটি টাকার বেশি হলে সেই তদন্ত চলে আসে ব্যাঙ্ক সিকিউরিটিস অ্যান্ড ফ্রড সেল (বিএসএফসি)-এর আওতায়। শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট সারদা-র সঙ্গে অন্য অর্থলগ্নি সংস্থার তদন্তের ভারও তুলে দিয়েছে সিবিআইয়ের হাতে। সব মিলিয়ে কেলেঙ্কারির পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে ইওডব্লুউ-র সঙ্গে দুর্নীতি দমন শাখার অফিসারদেরও ডাকা হতে পারে বলে ইঙ্গিত মিলেছে। এই সবাইকে নিয়েই দল তৈরি হবে। এই তদন্তের ভার দেওয়া হতে পারে ডেপুটি বা অতিরিক্ত সুপার পদের কোনও অফিসারের উপরে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy