খাতায়-কলমে টাকা জমা পড়েছে। অথচ সে টাকার হদিস কোথাও নেই! এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের সন্দেহ, কারচুপি করে সারদার ওই টাকা মেরে দিয়েছেন সংস্থারই কয়েক জন এজেন্ট ও কর্তাস্থানীয় ব্যক্তি। তাঁরা কারা, ইডি’র গোয়েন্দারা আপাতত তা জানার চেষ্টা করছেন।
সারদা-কেলেঙ্কারি নিয়ে ফরেন্সিক অডিট করছে সেবি-নিযুক্ত যে সংস্থা, সেই শরৎ অ্যাসোসিয়েটসের রিপোর্টে বলা হয়েছে, আমানতকারীদের থেকে সারদা প্রায় ২৪৫০ কোটি টাকা তুলেছিল। এর প্রায় ৬০০ কোটিরই খরচের হিসেব নেই। ইডি-র প্রাথমিক সন্দেহ, ওই ছ’শো কোটির অন্তত ১০০ কোটি খাতায়-কলমে সারদার ভাঁড়ারে জমা পড়লেও বাস্তবে কিছু কর্তা ও এজেন্টের পকেটস্থ হয়েছে। কী ভাবে তা সম্ভব হল?
ইডি-র তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, সারদা গোষ্ঠী টাকা তোলার হিসেব রাখত একটি সফটওয়্যারের সাহায্যে। কেউ সারদার ‘স্কিমে’ টাকা রাখলে ‘সাফারি’ নামের সফটওয়্যারটির মারফত তাঁকে একটি ‘পলিসি সার্টিফিকেট’ বার করে দেওয়া হতো, যে ভাবে বিভিন্ন জীবনবিমা পলিসি’র গ্রাহককে দেওয়া হয়ে থাকে। তাতে প্রিমিয়ামের অঙ্ক, জমার তারিখ, প্রকল্পের মেয়াদ শেষের তারিখ এবং প্রাপ্য অঙ্কের উল্লেখ থাকে।
এবং সারদা’র অর্থ আত্মসাতের জন্য ওই সফটওয়্যারই জালিয়াতদের অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল বলে তদন্তকারীদের ধারণা। ‘সাফারি’র প্রস্তুতকারী সংস্থা ওয়েবস্পাইডার প্রাইভেট লিমিটেডের কলকাতায় দু’টি অফিসে ইডি ইতিমধ্যে তল্লাশি চালিয়েছে। তদন্তকারীদের দাবি: সংস্থাটির অন্যতম কর্তা সুমন শাস্ত্রী জেরায় জানিয়েছেন, সারদায় ‘সাফারি’কে এড়িয়ে কোনও পলিসি সার্টিফিকেট তৈরি করা যেত না। কত টাকা জমা পড়েছে, কত টাকা আমানতকারীকে ফেরত দেওয়া হয়েছে— সব কিছুর বিস্তারিত হিসেব সাফারিতে মজুত থাকবে।
তা হলে টাকা বেপাত্তা হল কী ভাবে?
ইডি’র ব্যাখ্যা: আমানতকারীদের টাকা জমা নেওয়া হতো সারদার শাখা অফিসগুলোয়। সফটওয়্যার চালানোর পাসওয়ার্ড থাকত শাখা-প্রধানদের হেফাজতে। টাকা জমা পড়লে তা সংশ্লিষ্ট আমানতকারীর নামে ‘এন্ট্রি’ করা হতো। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, জমার এন্ট্রি থাকলেও বাস্তবে টাকা সারদার ঘরে ঢোকেনি। এজেন্টই তা হস্তগত করেছেন বলে তদন্তকারীদের অনুমান। আবার যে সব আমানতকারী দু’-তিনটি কিস্তি দিয়ে স্কিম আর চালাতে পারেননি, তাঁদের শুধু আসলটুকু ফেরত দিয়ে স্কিমটি বন্ধ করে দেওয়ার কথা। অথচ সফটওয়্যারে এমন অনেক ‘ডিফল্টার’ গ্রাহকের পলিসিকে ‘চালু’ হিসেবে দেখানো হয়েছে। যার সুবাদে প্রিমিয়াম জমা না-পড়লেও যথারীতি মেয়াদ শেষে ‘ম্যাচিওরিটি’র পুরো টাকা তুলে নিয়েছেন শাখা অফিসের কোনও কর্তা বা এজেন্ট। দু’-তিনটি প্রিমিয়াম জমা হওয়ার পরে সফটওয়্যারে মেয়াদ শেষের ভুল এন্ট্রি দেখিয়ে ম্যাচিওরিটির পুরো টাকা তোলা হয়েছে— এমন দৃষ্টান্তও মজুত।
সংস্থারই কিছু কর্মী যে এ ভাবে ডোবাচ্ছেন, কর্ণধার তা ধরতে পারলেন না?
তদন্তকারীদের দাবি, সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেন কম্পিউটারে সে ভাবে সড়গড় ছিলেন না। তাই জালিয়াতির ছবিটা তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়নি। ২০১২-র নভেম্বর নাগাদ ব্যাপারটা যখন সুদীপ্তের নজরে আসে, তখন অবশ্য তাঁর নৌকো ডুবতে শুরু করেছে। এর মাস পাঁচেক বাদে, ২০১৩-র ১৬ এপ্রিল সারদার ঝাঁপ পড়ে যায়। কিন্তু তার পরেও দিন দশেক পর্যন্ত টাকা জমা পড়ার ‘এন্ট্রি’ রয়েছে ‘সাফারি’তে, যার পুরোটাই লোপাট হয়েছে বলে ইডি’র সন্দেহ। তাদের হিসেব অনুযায়ী, ২০১৩-র এপ্রিল জুড়ে সারদার নামে তিন কোটিরও বেশি টাকা ‘আমানত’ হিসেবে তোলা হয়। কম্পিউটারে জমার ‘এন্ট্রি’ও হয়েছে। কিন্তু ওই টাকা সারদার অফিসে বা ব্যাঙ্ক অ্যকাউন্টে জমা পড়েনি।
এমন ভাবে নানা সময়ে, নানা পন্থায় প্রায় একশো কোটি টাকা গায়েব করা হয়েছে বলে ইডি-কর্তারা মনে করছেন। কারা এতে জড়িত?
এক তদন্তকারী বলেন, “প্রাথমিক ভাবে আমরা সন্দেহ করছি দুই ২৪ পরগনায় নিযুক্ত সারদার কয়েক জন এজেন্টকে। আমাদের ধারণা, অরিন্দম দাস ওরফে বুম্বা এদের অন্যতম।” প্রসঙ্গত, সারদা-কেলেঙ্কারি সামনে আসার ক’দিন বাদেই বারুইপুরের বাসিন্দা বুম্বাকে সল্টলেক পুলিশ গ্রেফতার করে।
ইডি-সূত্রের ইঙ্গিত, বুম্বা ছাড়াও সন্দেহভাজন কয়েক জন এজেন্টকে খুব শিগগিরই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy