পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা সংক্রান্ত মামলাগুলি বিচারপতি দীপঙ্কর দত্তের এজলাস থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি। সে ছিল গত শুক্রবারের ঘটনা। তার দু’দিন বাদে, সোমবার সব মামলা আবার বিচারপতি দত্তের আদালতে তিনি ফেরত পাঠিয়েছেন। আর তার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে পাড়ুই-মামলাও সেই বিচারপতি দত্তেরই এজলাসে ফিরিয়ে দিলেন হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি অরুণ মিশ্র।
গত জুলাইয়ে, পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক্কালে বীরভূমের পাড়ুইয়ে খুন হয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলকর্মী সাগর ঘোষ। ওই হত্যাকাণ্ড নিয়ে সাড়া জাগানো মামলাটি বিচারপতি দত্তের সিঙ্গল বেঞ্চেই চলছিল। কিন্তু সেখানে রাজ্য পুলিশের ডিজি’র তলব পড়ায় রাজ্য সরকার গত ১১ এপ্রিল হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে পাল্টা আবেদন করে। বিচারপত্তির দত্তের নির্দেশ তিন সপ্তাহ স্থগিত করে প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ সে দিন জানিয়ে দেয়, পাড়ুই-মামলা অতঃপর তারাই শুনবে। অন্য দিকে সাগরবাবুর পুত্র মামলাটি বিচারপতি দত্তের এজলাসে ফিরিয়ে দেওয়ার আর্জি জানান সুপ্রিম কোর্টে। সর্বোচ্চ আদালত অবশ্য মামলা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চেই ফেরত পাঠিয়ে দ্রুত নিষ্পত্তির নির্দেশ দেয়।
এবং সেই ডিভিশন বেঞ্চই এ দিন পাড়ুই-মামলা ফের বিচারপতি দত্তের সিঙ্গল বেঞ্চে পাঠানোয় কার্যত টানাপড়েনের একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হল, যার শুরু থেকে শেষের মাঝে গড়িয়ে গিয়েছে ছাব্বিশটি দিন। মিটে গিয়েছে বীরভূমের ভোটপর্বও। হাইকোর্ট-সূত্রের খবর: সম্প্রতি আইনজীবীদের একাংশ বিবিধ কারণে প্রধান বিচারপতির এজলাস বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন। বেশ কিছু প্রবীণ আইনজীবী ইতিমধ্যে প্রধান বিচারপতির এজলাসে মামলা লড়া বন্ধও করে দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতির সোমবার ও মঙ্গলবারের দুই নির্দেশের পিছনে মূলত এ সবেরই ছায়া দেখছেন আইন-কারবারিদের অনেকে।
আজ, বুধবার বিচারপতি দত্তের এজলাসে পাড়ুই-মামলার শুনানি পুনরায় শুরু হওয়ার কথা। তবে এ দিন ডিভিশন বেঞ্চে মামলাটি ওঠার পরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত শুনে সরকারপক্ষ আপত্তি তুলেছিল। মামলা ডিভিশন বেঞ্চে রাখার পক্ষে তারা বারবার সওয়াল করে। “পাড়ুই-মামলার শুনানি ডিভিশন বেঞ্চে হওয়া বাঞ্ছনীয়। সুপ্রিম কোর্ট তেমনই নির্দেশ দিয়েছে।” সওয়ালে বলেন সরকারের কৌঁসুলি (জিপি) অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রধান বিচারপতি মিশ্র সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন রায় উল্লেখ করে অশোকবাবুর বক্তব্য নস্যাৎ করেন। জিপি বলেন, “আপনাদের রায় ছিল, তিন সপ্তাহ বাদে মামলা শুনবেন।” প্রধান বিচারপতি জবাব দেন, “আমি ঠিক করেছি, আমি শুনব না।” শুক্রবার ডিভিশন বেঞ্চ যে হলফনামা জমা দেওয়ার কথা বলেছিল, এ দিন জিপি সেটিও জমা দিতে চেয়েছিলেন। সাগরবাবুর পুত্র হৃদয় ঘোষের কৌঁসুলি অরুণাভ ঘোষ ও শীর্ষেন্দু সিংহরায় প্রতিবাদ করে বলেন, “সাত মাস ধরে মামলা চলছে। আবার হলফনামার কী দরকার? মামলা চলাকালীনই তো সরকারপক্ষ সব বক্তব্য পেশ করেছে!”
এমতাবস্থায় ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়ে দেয়, কোনও হলফনামা জমা দিতে হবে না। বিচারপতি দত্তই ঠিক করবেন, হলফনামার প্রয়োজন আছে কি না। “সাত মাস বিচারপতি দীপঙ্কর দত্তের বেঞ্চে শুনানি হয়েছে। তাই সেই বেঞ্চেই মামলার নিষ্পত্তি হোক। এটাই সঙ্গত।” মন্তব্য করেন প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চের অপর বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী।
প্রসঙ্গত, পাড়ুই-মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত হিসেবে নাম রয়েছে তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের, যাঁকে পুলিশ এখনও গ্রেফতার না-করায় বিচারপতি দত্ত একাধিক বার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এমনকী, ‘অনুব্রত মণ্ডল মুখ্যমন্ত্রীর আশীর্বাদধন্য’ বলে মন্তব্যও করেছেন। বিচারপতি দত্তের ১০ এপ্রিলের নির্দেশের ওই বিশেষ অংশটি অবশ্য বাদ দিয়েছে ডিভিশন বেঞ্চ। যুক্তি: যিনি মামলায় অভিযুক্ত নন, কোনও ভাবেই মামলায় যুক্ত নন, আদালতের নির্দেশে তাঁর উল্লেখ থাকতে পারে না। পাশাপাশি প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশ, ডিজি’র ব্যক্তিগত হাজিরা আপাতত চাওয়া যাবে না। তবে সিঙ্গল বেঞ্চ মনে করলে পরে ডিজি’কে তলব করতে পারে।
পাড়ুই-মামলার আবেদনকারীদের কী প্রতিক্রিয়া?
হৃদয়বাবু স্বভাবতই খুশি। যদিও তাঁর আশঙ্কা কাটেনি। “এ আমাদের নৈতিক জয়। তবে মাঝে যে সময়টা নষ্ট হল, তাতে মামলার ক্ষতি হয়ে গেল।” প্রতিক্রিয়া সাগর-পুত্রের। তাঁর এ-ও আক্ষেপ, “মূল অভিযুক্তেরা এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের পরিবারের ভয় আরও বেড়ে গিয়েছে।” রাজ্য সরকার যে আদতে সময় নষ্টের লক্ষ্যেই হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে গিয়েছিল, ঘটনাক্রমের মধ্য দিয়ে সেটাও পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন হৃদয়বাবু।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy