অঙ্কন: সুমন চৌধুরী
এ বারের ভোটে এত স্রোত, চোরাস্রোতের মধ্যে দাঁড়িয়েও তিনি অবিচল। ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ির ফাঁকে ঠোঁটে চিলতে হাসি। মুখে একটাই কথা, “তৃণমূল প্রত্যাশার চেয়ে ভাল ফল করবে।” খুব চাপাচাপিতে বলেছেন, “৩০-এর উপরে থাকবে।”
ভোট গণনার ২৪ ঘণ্টা আগে, বৃহস্পতিবার রাতেও তিনি ঘনিষ্ঠদের কাছে আলাপচারিতায় বলেছেন, “আমাদের আসন তো ৩২-এর নীচে দেখতে পাচ্ছি না।” শেষ ও পঞ্চম দফার ভোটের আগেও তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে, অন্তত ৪০% আসনে তৃণমূল ছাড়া কেউ আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। কী ভাবে বুঝছেন? এক কথায় উত্তর, “অবাধ ও শান্তিতে ভোট দেখে।”
এতটা আত্মবিশ্বাসী? সরাসরি উত্তর নেই। মুখে সেই চিলতে হাসি। নিজের হাতের রেখার দিকে তাকিয়েছেন। তৃণমূল দল, দলের কর্মীদের হাতের তালুর মতোই চেনেন। দলের ভোট সংক্রান্ত যাবতীয় কাজকর্মের দায়িত্ব তাঁর হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নির্বাচনী কেন্দ্রের সীমা পুনর্বিন্যাসের (ডিলিমিটেশন) কাজ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা থেকে শুরু করে ভোটে দলনেত্রীর নির্দেশিত রণকৌশলকে কাজে লাগানোর জন্য এক নম্বরে কে? তিনি মুকুল রায়। তাঁর রণকৌশলটাই বা কী? মুখে কুলুপ এঁটেছেন মুকুল। খুব চাপাচাপিতে বলেছেন, “দিদি যা নির্দেশ দিচ্ছেন, আমি তা পালন করছি মাত্র।”
তাঁর ‘চাণক্য’সুলভ রাজনীতির ছটা অনেকেই লক্ষ করেছিলেন চলতি বছরের রাজ্যসভার ভোটে বাম বিধায়কদের ভাঙিয়ে এনে তৃণমূল প্রার্থীদের সকলকে জিতিয়ে দেওয়ায়। আবার রাজ্যে কংগ্রেস-সহ বিরোধীদের সংগঠনে ভাঙন ধরানোয় তাঁর কৌশল কার্যকর হয়েছে বলেই তাঁরা মনে করেন। কারণ দল ভেঙে বেরিয়ে আসা সৌমিত্র খান, সুনীল মণ্ডল এবং দশরথ তিরকি জয়ী হয়েছেন।
গত দু’মাস ধরে ভোট প্রচারের ফাঁকে নিয়ম করে এসে বসেছেন তপসিয়ায় তৃণমূল ভবনের একতলার বাঁ দিকে তাঁর নির্দিষ্ট ঘরে। সেটাই মুকুলের ‘ওয়ার রুম’। সেখানে সদাসঙ্গী ডেরেক ও’ব্রায়েন। সামনে অন্য নেতা ও কর্মীদের ভিড়। সকলের সব কথা মন দিয়ে শুনছেন। সেনাপতির মতোই বলছেন‘মিলে মিশে কাজ কর। কিছু সমস্যা হলে আমাকে জানিও।’ দলনেত্রীর নির্দেশে এটাই বলতে গেলে তাঁর দৈনন্দিন রুটিন। নির্দেশ পালন করে কখনও চলে গিয়েছেন নদিয়ার কোনও প্রত্যন্ত প্রান্তে, কখনও বা উত্তরবঙ্গে কোনও জেলায়।
ছাত্র জীবনে এসএফআই করতেন। পুরনো কমিউনিস্ট সংগঠকের মতো ব্লক স্তরের কর্মীকে প্রত্যক্ষ ভাবে চেনাটা মুকুল রায়ের অন্যতম ইউএসপি। দলের অন্দরের খবর, ভোটের দায়িত্ব বণ্টনের ক্ষেত্রে মুকুল যে ভাবে টিম গড়েছেন, তা-ও লক্ষণীয়। যিনি টিমের নেতা হয়েছেন, তাঁর কাজকর্ম ঠিকঠাক চলছে কি না তা বুঝতে মুকুল ওই টিমেরই অন্য কারও উপর অলিখিত ভার দিয়েছেন। কোথাও অব্যবস্থার অভিযোগ বা প্রয়োজন বুঝলে সরাসরি মুকুলের কাছেই জানানোর নির্দেশ ছিল। এমনকী, ভোটের কাজে বুথ স্তর পর্যন্ত যে টাকা পাঠাতে হয়, সেটাও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিজের বিশ্বস্ত লোকেদের হাত দিয়ে সরাসরি পাঠানোর ব্যবস্থা চালু করেন মুকুল। যাতে বুথভিত্তিক পরিস্থিতির আগাম আঁচ তাঁর কাছে পৌঁছে যায়।
মমতা যখন প্রচারে ব্যস্ত, তখন মুকুলের উপর দায়িত্ব বর্তেছে কখনও মিঠুন চক্রবর্তী, কখনও দেবকে নিয়ে পৃথক ভাবে প্রচারের। তারকারা যখন বক্তৃতা করেছেন, মঞ্চে বসে মুকুল তখন স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে সাংগঠনিক আলোচনা সেরেছেন। এটাও কি রণকৌশলের অঙ্গ? উত্তর দেননি তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক।
প্রবল মোদী হাওয়াতেও দলের এমন সাফল্য এল কী ভাবে? মুকুলের বিনীত উত্তর, “দলনেত্রী যা বলার বলেছেন। আমি তাঁর নির্দেশ পালন করেছি মাত্র।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy