Follow us on

Download the latest Anandabazar app

© 2021 ABP Pvt. Ltd.

Advertisement

২৬ এপ্রিল ২০২৪ ই-পেপার

Chandan Sen: কলকাতার থিয়েটারে এখন প্রতিস্পর্ধার অভাব দেখি: চন্দন সেন

কলকাতা মানেই থিয়েটার আর থিয়েটারই আমার রাজনৈতিক ভাষা।

চন্দন সেন
কলকাতা ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৮:২৬

গ্রুপ থিয়েটার নিয়ে কথা বললে জীবনের বৃহত্তর ক্ষেত্রটি ছুঁয়ে থাকা যায়

কলকাতায় থিয়েটার করতে এসেছি ৭৯ সালে। তার আগে অভিনয় বলতে বাবা-মায়ের তত্ত্বাবধানে আইপিটিএ আর রামকৃষ্ণ মিশনের কো-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিস। মাঝের সময়টি বেশ বিস্তৃত। তাই কলকাতার কথা বলতে গেলে গোটা যাত্রাপথটির সব জায়গাতেই যে থিয়েটার ছুঁয়ে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। তা ছাড়া গ্রুপ থিয়েটার নিয়ে কথা বললে জীবনের বৃহত্তর ক্ষেত্রটি ছুঁয়ে থাকা যায়। রাজনৈতিক ভাবে, সামাজিক ভাবেও।
প্রথম দিনগুলির কথা বলতে গেলে মনে পড়ে, ৭৯ সাল থেকে ৯০ সাল পর্যন্ত যখন নাটক করেছি, তখন মনে হয়েছিল যে, চল্লিশের দশক থেকে বামপন্থার যে অভিঘাত নাট্য জগতে চলেছিল, সেটিই পরম্পরাগত ভাবে রয়ে গিয়েছে। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে বাজার সভ্যতার আগমনে সেটি একেবারে পাল্টে যায়। পুঁজির আঘাতে সেটাই হয়ে থাকে। কারণ পুঁজির স্বভাবই হল ব্যক্তিগত প্রবৃত্তিকে খুঁচিয়ে তোলা আর মানুষ যে সমাজবদ্ধ জীব, সে কথাটি ভুলিয়ে দেওয়া। একই সঙ্গে বাম সরকারের যেন তেন প্রকারেণ নির্বাচনে জিততে চাওয়ার চেষ্টাও এই বদলকে ত্বরান্বিত করে। কিছু মানুষ নাট্য জগতেও তৈরি হয় যাঁরা সরকার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে চান, ফলত শুধু বামফ্রন্টের তৎকালীন পছন্দের ভাবনাই ক্রমাগত প্রকাশ পেতে থাকে কলকাতা শহরের নাটকে। তবে এই সময়ে বিরুদ্ধ মতটিও বেড়ে উঠতে শুরু করে সমান্তরালে। কার্যত সরকার বদলের পর শহরজুড়ে সে রকমেরই একটি অভিঘাত দেখতে পেলাম বলে মনে হল। হয়তো সব শাসকের চরিত্র একই রকম।

Advertisement
বিশ্বাস করি যে, শিল্প সাহিত্য কোনও দিন, কোনও ভাবেই অরাজনৈতিক হতে পারে না

বিশ্বাস করি যে, শিল্প সাহিত্য কোনও দিন, কোনও ভাবেই অরাজনৈতিক হতে পারে না


চরিত্রগত ভাবে এই বদলটি বেশ স্পষ্ট বলেই মনে হয় আজকাল। নাটক তো শুধুমাত্র বিনোদনের জায়গা নয়, একটি দায়িত্বের জায়গাও রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে মনে হচ্ছে সেই দায়িত্ব পালনে বেশ কিছুটা অসুবিধা হচ্ছে। আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে প্রতিস্পর্ধার কথা বলতে চাইছি। অর্থাৎ, স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে নাটক। স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধের এই প্রতিস্পর্ধা যেন আজ আর দেখতে পাই না।
কিন্তু তাই বলে বিনোদন কে আমি অস্বীকার করি না। বিনোদন তো অবশ্যই থাকবে। দর্শক যদি গল্পে মজা না পান, অভিনয়ে ও প্রযোজনার মানে যদি না মজেন, তা হলে নাটকের কোনও মানে হয় না। কিন্তু এও বিশ্বাস করি যে, শিল্প সাহিত্য কোনও দিন, কোনও ভাবেই অরাজনৈতিক হতে পারে না। অথচ গত দশ-বারো বছর ধরে এই সামাজিক দায়বদ্ধতার অভাব যেন খুব বেশি করে বোধ হচ্ছে। আমাদের শিক্ষকরা এই সামাজিক দায়বোধ আর নন্দনিকতা বোধ আমাদের মধ্যে একই সঙ্গে বুনেছিলেন। এখন যেটি প্রবল ভাবে মনে হচ্ছে, তা হল, এই দু’টি বোধ এখন আর বোধ হয় একসঙ্গে তৈরি হচ্ছে না। আর সেটি না হওয়ায় জন্য দায়ী আমরাও। আমরা নিজেরাও এই ঘটনার দায় এড়াতে পারি না।

কলকাতার এক প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব এক বার বলেছিলেন, কেবল বামপন্থী ভাবনাতেই সার্থক থিয়েটার হতে পারে, এমন ধারণা একেবারেই ভুল। তিনি দাবি করেন যে, তিনি প্রমাণ করে দেবেন ডানপন্থী ধারণা থেকেও থিয়েটার করা যায়। কিন্তু নাটকের এত হাজার বছরের ইতিহাস যদি দেখা যায়, তবে দেখা যাবে নিজের সময়ে দাঁড়িয়ে যে, যে নাটক বিদ্রোহীর ভূমিকা নিয়েছিল সেই নাটকগুলিই টিকে গিয়েছে সময়ের মাপকাঠিতে। আর এই বিরুদ্ধতা ও দ্রোহের নামই বামপন্থা। যখন বামফ্রন্ট সরকার চলছে তখন, বিশেষত ৮৭ সালের পর থেকে যখন তথাকথিত বামপন্থী সরকার ক্ষমতায় ছিল, তখনও আমরা তাঁদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে নাটক করে গিয়েছি। ‘সুনেত্রা’, ‘হীরক রাজার দেশে’ বা ‘সিজার’-এর মতো নাটকগুলি দেখলে সেটি সাফ হয়ে যায়। সেটিই আমার রাজনৈতিক কাজ ছিল বলে বিশ্বাস করি। আজকালকার নির্দেশকদের মধ্যে যে সব নতুন ছেলেমেয়েরা নির্দেশনার কাজ করেন, তাঁরা নাটক সাজানোর কলা বা শৈলীতে হয়তো খুবই দক্ষ, কিন্তু আমার মনে হয় দর্শন ও ইতিহাসজ্ঞানের দিক থেকে কোথাও বড় ফাঁক থেকে যাচ্ছে কিংবা জেনেশুনেই খুব প্রত্যক্ষ ভাবে তা এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে।

কলকাতার নাট্য জগতের মধ্যে আরও যে ব্যাপারটি নজরে এসেছে, তা হল কিছু কিছু অভিনেতাকে কেন্দ্র করে টিকিট বিক্রির একটি ঝোঁক। আমার সঙ্গে এর একটি ধারণাগত বিরোধ আছে। নাটকচর্চা শুধুমাত্র বাণিজ্যকেন্দ্রিক ভাবে হয় না। কয়েক জন বিশিষ্ট জনকে সামনে এগিয়ে দিয়ে টিকিট বিক্রির চেষ্টা বামফ্রন্টের সময়েও হয়েছে। তবে এখন যেন সেই চেষ্টা আরও কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে। কয়েক জন হাতে গোনা নাট্যকারকে বাদ দিলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চর্চার থেকে চমকের দিকে বেশি নজর চলে যাচ্ছে।

কলকাতার গ্রুপ থিয়েটারের খবরের কাগজের উপর বিজ্ঞাপন নির্ভরতা কমছে এটাও একটা ভাল লক্ষণ। ইন্টারনেট আসার পর, সস্তায় বিজ্ঞাপন করা যাচ্ছে। সাধারণ দর্শকের মতামত সরাসরি নেওয়া যাচ্ছে। এই যোগাযোগের জায়গাটি খুব বড় একটি বদল। থিয়েটার কোনও দিনই সাধারণের জন্য খুব একটি ছিল না। তবুও গণনাট্য আন্দোলনের সময়ে কিছুটা গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ পাওয়া গিয়েছিল। অবশ্য বামেদের বড় সমস্যা ছিল এই যে তাঁরা বড় বেশি আশু কর্মসূচি নির্ভর। কিন্তু বর্তমানে এই সব প্রতিবন্ধকতা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে অনেকটাই।

কোনও প্রশ্ন অরাজনৈতিক হয় না, তাই অভিজ্ঞতাও অরাজনৈতিক হয় না। কলকাতার নাট্যচর্চার যে চরিত্রবদলের চেষ্টা হয়েছে, তাও কেবল চেষ্টা হিসাবেই থেকে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। কলকাতা বলতে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে বুঝি, তাদের চরিত্রে কোনও বদল আসেনি। শুধু কলকাতা নয়, সারা পৃথিবীর কোনও শহরেই তা হয়নি। তবুও বিশ্বাস করি কলকাতা প্রতিস্পর্ধা ভোলেনি। হয়তো আগামী দিনে তা আরও স্পষ্ট হবে। কলকাতার প্রতিস্পর্ধা পরিণত হবে চর্চায়।

Advertisement