Follow us on

Download the latest Anandabazar app

© 2021 ABP Pvt. Ltd.

Advertisement

২৩ এপ্রিল ২০২৪ ই-পেপার

Debshankar Halder: কলকাতার দর্শক একই সঙ্গে তারিফ এবং তিরস্কার দুই-ই করতে পারেন

কলকাতার হাত ধরে যাঁরা হেঁটেছেন, তাঁরা একই সঙ্গে এই শহরের সঙ্গীত, মূর্ছনা এবং একটি নাছোড়বান্দা টান অনুভব করেছেন।

দেবশঙ্কর হালদার
কলকাতা ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৩:৩৭

এই কলকাতার সঙ্গে আমার ভালবাসা ও একই সঙ্গে ঘৃণার সম্পর্ক আছে।

তবু যেন জংলা আদিম জলা/ জুড়ে আছে আজো বুকের তলা’...

কলকাতা বলতেই আমার প্রেমেন্দ্র মিত্রের এই দুটি লাইন মনে পড়ে। কলকাতা শহরের মধ্যে অনেক আধুনিক ঘটনা যেমন আছে, তেমনই একটি জংলা ব্যাপারও আছে। সেটা বাইরে থেকে দেখা যায় না। কলকাতায় যাঁরা অনেক দিন থেকেছেন তাঁরা দেখতে পেয়েছেন। আমি একেবারে নিখাদ উত্তর কলকাতার মানুষ। আমার কাছে কলকাতা একই সঙ্গে আদিম এবং আধুনিক। এবং এটাই কলকাতার আসল মজা বলে আমার মনে হয়।

Advertisement

আমার শৈশব এবং বড়বেলার যাপন জুড়ে কলকাতা ভীষণ ভাবে রয়েছে। কাজের সূত্রে দক্ষিণ কলকাতা এবং বর্ধিত কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ আছে বটে। কিন্তু কলকাতা আমাকে যে ছবিটা দেখায় তাতে আমি দেখতে পাই অজস্র গলি, বিবর্ণ হয়ে যাওয়া বাড়ি। সাপের মতো এলোমেলো হয়ে যাওয়া গলি এবং বর্ণহীন বাড়িগুলি থেকে আমি এক ধ্রুপদী সুরের মূর্ছনা শুনতে পাই।

একই সঙ্গে আমি যখন অনেক রাতে বাড়ি ফিরি তখন কলকাতা চুপ করে থাকে এবং যে সুরটি ভাঁজে আমার কাছে সেটা খুবই আরামদায়ক। সকাল হলেই কলকাতা আবার অন্য রাগ, অন্য বর্ণমালা, অন্য স্বরলিপির গান গায়। পৃথিবীর আর অন্য কোনও শহরে এত বৈচিত্রময় শব্দ, ধ্বনি, সুর আর ভালবাসা আছে কিনা আমি জানি না। এখানে ধোঁয়া আছে, ধুলো আছে, নক্ষত্ররাও আছে। এ কলকাতার মধ্যে আছে আর একটি কলকাতা। কলকাতাকে হেঁটে দেখতে শিখতে হবে এবং কলকাতার হাত ধরে হাঁটতে হবে। কলকাতার হাত ধরে যাঁরা হেঁটেছেন তাঁরা একই সঙ্গে এই শহরের সঙ্গীত, মূর্ছনা এবং একটি নাছোড়বান্দা টান অনুভব করেছেন। আমি সেই সৌভাগ্যবানদের মধ্যে এক জন। আমি কলকাতার উপর অনেক রাগ করেছি। এখনও করি। কিন্তু রাগ করে যখন শহর ছেড়ে চলে যেতে চাই কলকাতা পিছন থেকে আমার জামা ধরে টান দেয়। আমি এই টানকে অস্বীকার করতে পারি না। আবার পুরোপুরি স্বীকারও করি না। এই কলকাতার সঙ্গে আমার ভালবাসা ও একই সঙ্গে ঘৃণার সম্পর্ক আছে।

আমার শৈশব এবং বড়বেলার যাপন জুড়ে কলকাতা ভীষণ ভাবে রয়েছে।

আমার শৈশব এবং বড়বেলার যাপন জুড়ে কলকাতা ভীষণ ভাবে রয়েছে।
ছবি: সংগৃহীত


ছোটবেলায় যে থিয়েটার পাড়া, নাটকের মঞ্চ দেখে বড় হয়েছি এখন আর সেগুলি নেই। তবু যখন থিয়েটার পাড়া দিয়ে হাঁটি সেই সংলাপ, সেই কনসার্ট কানে বাজে। ‘অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস’ কলকাতার এমন এক ক্ষেত্র বা প্রান্তর যেখানে আমি জন্মেছি বলে মনে হয়। আমার থিয়েটার যাপন শুরু হয়েছে ওই মঞ্চে অভিনয় করে। অ্যাকাডেমির মঞ্চে প্রথম অভিনয় করেছি যখন রোমাঞ্চ হয়েছে। আবার ওখান থেকে অনেকটা সরে এসে উত্তর কলকাতার বাগবাজার স্ট্রিটের মধ্যে গঙ্গা থেকে নোনা হাওয়া এসে লাগে এই রকম একটি জায়গা, গিরিশ মঞ্চে যখন অভিনয় করেছি তখন সেই জায়গাটি অন্য এক আনন্দ দিয়েছে। গিরিশ মঞ্চ থেকে যখন অভিনয় করতে ছুটে গিয়েছি ঢাকুরিয়ার মধুসূদন মঞ্চে তখন সেই জায়গার সংস্কৃতি, চাহিদা আমাকে এক অন্য অনুভূতি এনে দিয়েছে।

সিনেমার ক্ষেত্রে ইন্দ্রপুরী স্টুডিও, টেকনিশায়ন স্টুডিও, দাশানি স্টুডিও, ভারতলক্ষ্মী স্টুডিও— এই জায়গাগুলিও আমার নিজস্ব জায়গা বলে মনে হয়েছে। তেমন করেই কলকাতার কিছু কিছু বিশেষ বাড়ি যেমন, আমার বাড়ির কাছে বেলগাছিয়া রাজবাড়ি, লাহা বাড়ি মতো কিছু ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিবাহী বাড়িগুলির কাছে অভিনয়ের সূত্রে বারবার ফিরে গিয়েছি। সব মিলিয়ে এই বাড়ি, স্টুডিও, মঞ্চগুলি পরিধেয় অঙ্গসজ্জার মতো কলকাতাকে সাজিয়ে রেখেছে। অন্তত আমি এই ভাবেই দেখতে পাই।

অভিনেতার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি দর্শকের প্রশংসা। কলকাতার দর্শক একই সঙ্গে তারিফ এবং তিরস্কার, দুই-ই করতে পারেন। শিক্ষানবীশ অভিনেতা যাঁরা, তাঁদের জন্য কলকাতার দর্শক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। উত্তর,দক্ষিণ, মধ্য— এলাকা ভেদে কলকাতার দশর্কের একটি আলাদা চরিত্র আছে এবং তাঁদের প্রতিক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে তা তাঁরা অভিনেতাকে জানান দেন। বুঝিয়ে দেন আমরা কিন্তু কলকাতার দর্শক। এটা এক জন অভিনেতা অনেক দিন অভিনয় করতে করতে বুঝতে পারেন। আমার কাছে তো কলকাতার দর্শক একেবারে পরীক্ষা নেওয়ার মতো মাষ্টারমশাই বটে।

Advertisement