Bongaon Durga Puja

দ্বিভুজা এই বাড়ির দেবী, কিন্তু তিনি অসুরদলনী দুর্গা নন! কেন?

দাঁ বংশ গন্ধবণিকের সম্প্রদায়। তারা আদি গন্ধবণিক কুলতিলক ধনপতি সওদাগরের বংশধর। তাই মা দুর্গা কমলে কামিনী রূপেই পুজো পান।

Advertisement

তমোঘ্ন নস্কর

শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১২:৩৮
Share:

সংগৃহিত চিত্র

দাঁ বংশ গন্ধবণিকের সম্প্রদায়। তারা আদি গন্ধবণিক কুলতিলক ধনপতি সওদাগরের বংশধর। তাই মা দুর্গা কমলে কামিনী রূপেই পুজো পান।

Advertisement

কোথায় পূজিত হন এই দেবী?

একচালা প্রতিমা। দেবী দুর্গাকে ঘিরে রয়েছেন তাঁর চার সন্তান লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ। মনে হবে, হ্যাঁ এই তো বাঙালির পুরাতন পূজো। কিন্তু না, এখানেই রয়েছে পরিবর্তন। দেবীর মাত্র দু’টি হাত, তাতেও তিনি মহিষাসুরকে সংহার করছেন না। বরং উদ্ধার করছেন এক অসহায় মানুষকে। এমন অদ্ভুত রূপেই প্রায় তিনশো বছর ধরে পুজো পেয়ে আসছেন দাঁ বাড়ির কমলেকামিনী দুর্গা তথা শ্রীমন্ত সওদাগরের দেবী দুর্গা।

Advertisement

দাঁ বংশ গন্ধবণিকের সম্প্রদায়। তারা আদি গন্ধবণিক কুলতিলক ধনপতি সওদাগরের বংশধর। তাই দেবী দুর্গা কমলে কামিনী রূপেই পুজো পান। দুর্গার এই কমলেকামিনী রূপের বর্ণনা মেলে মঙ্গল কাব্যে।

সে কাহিনি সংক্ষেপে এমন–

বণিককুলের শ্রেষ্ঠ বণিক ধনপতি সদাগর। আর্থিক প্রতিপত্তির সঙ্গেই ভীষণ অহঙ্কারী। শিব ছাড়া কাউকে দেবতা বলে মানে না। এমনকী, দেবীর পুজোও করে না।

ধনপতি নৌকা নিয়ে শ্রীলঙ্কা (সিংহল) যায়। তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী দেবীর পুজো করতে বললে অগ্রাহ্য করে। অসহায়া স্ত্রী স্বামী ও আসন্ন পুত্রের কল্যাণে দেবীর আরাধনা করে, ক্ষমা প্রার্থনা করে।

তাই দেবী ভাবলেন ভীষণ শাস্তি না দিয়ে অল্পের উপরে শিক্ষা দেবেন ধনপতিকে। জলপথে যেতে যেতে ধনপতি সমুদ্রের মাঝে দেখে, এক নারী ঘুষি পাকিয়ে দুই হাতিকে মারছে! সে ভাবল, এ তো ভারী অদ্ভুত জিনিস! বন্দরে নেমে রাজা শালিবাহনকে এ কাহিনি বলে বেশ খুশি করা যাবে। রাজা তোষামোদে খুশি হলে তার ব্যবসায় সুবিধাও হবে।

ধনপতির সঙ্গীরা বাধা দিল। বলল, সদাগর আমরা কিন্তু কিছু দেখিনি। তুমি একাই দেখেছো। বলাটা কি ঠিক হবে? ঝড়বৃষ্টির মধ্যে গভীর রাত্রে কী দেখতে কী দেখেছো… কিন্তু ওই যে লোভ! ধনপতি কারও বারণ শুনল না। রাজাকে সবই বলল।

রাজা বিশ্বাস করেন না। স্বাভাবিক। কেউ কি এমন কথায় বিশ্বাস করতে পারে! অহঙ্কারী ধনপতিও জেদ ধরে, এ দৃশ্য সে রাজাকে দেখাবেই। কিন্তু সেখানে গিয়ে কিছুরই দেখা মেলে না। ক্রুদ্ধ রাজা ধনপতিকে জেলে আটকে রাখলেন।

বছর কাটে, ধনপতি আর ফেরে না। ছেলে শ্রীমন্তও বড় হয়েছে। বাবার খোঁজে ছেলেও সিংহল যাত্রা করল।

ওমা, ছেলেও সেই হস্তিনিধন কমলেকামিনী রূপ দেখল। আর বাবার মতো একই ভুল করে কারাগারে গেল। এ বার রাজা দারুণ রেগে গেলেন। এদের কালই শূলে দেবেন।

এমন সময় ছেলের মায়ের কথা মনে পড়ে। তার মা এই জৈষ্ঠ মাসে মঙ্গলবারে ব্রত করত আর বলত, বিপদে মা মঙ্গলচণ্ডীই ভরসা।

বাপ-ব্যাটায় কেঁদে কেঁদে দেবীকে ডাকে। মা কি আর সন্তানের উপরে রাগ করে থাকতে পারেন! সাড়া দেন। শেষ বারের মতো তাদের কাতর অনুনয় শুনতে রাজি হন রাজা শালিবাহন। যান দহের মাঝখানে। এ বারেও সহজে দেখা দেন না দেবী। ক্রুদ্ধ হয়ে দু’জনকে জলে ফেলে দেন রাজা। আর তখনই সেখানে দেবী কমলে কামিনী রূপে উত্থিতা হয়ে হাত ধরে জল থেকে টেনে তুলে উদ্ধার করেন ধনপতি ও শ্রীমন্তকে।

এই স্বপ্নটি পুনর্বার দেখেন দাঁ বংশের আদিপুরুষ কৃষ্ণচন্দ্র দাঁ। প্রায় তিনশো বছর আগে তখন তারা বৈঁচি গ্রামে বসবাস করছেন। সেখানেই মায়ের এমন মূর্তি গড়ে পুজো শুরু হয়। প্রতিমা লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সেখানে দেবী শ্রীমন্তের হাত ধরে রয়েছেন, যেন জল থেকে তুলছেন। পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে স্বপ্নের রূপটিই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে প্রতিমায়।

জন্মাষ্টমীর পরদিন মাটি পড়ে। আস্তে আস্তে গড়ে ওঠে প্রতিমা। অষ্টমীর দিন সাড়ম্বরে পালিত হয় কুমারী পুজোও। নবমীর দিন ধুনুচি নাচের পরে আপামর সাধারণের জন্য হয় নরনারায়ণ সেবা।

তবে বনগাঁ এই পূজাটি ৫৪ বছরের। কৃষ্ণচন্দ্র দাঁ-র উত্তরপুরুষ অজিত দাঁ যখন বনগাঁয় চলে আসেন, তখন পাকাপাকি ভাবে দেবীও আসেন ১৯৭১ সালে। সেখানেই তাঁদের পুজো শুরু হয়। এ ভাবেই একটানা পুজো পেয়ে আসছেন দেবী— দুর্গাপুজোয় কমলেকামিনী রূপে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement