কড়া নাড়া

শহর কলিকাতা নাকি এখনও নিম্নমধ্যবিত্তের স্বর্গ। এহেন খ্যাতির অন্যতম কারণ, এই শহরে এখনও যে দামে ভরপেট খাবার মিলে, তাহা ভারতের অন্য কোনও বড় শহরে কল্পনারও অতীত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৭ ০০:২৬
Share:

শহর কলিকাতা নাকি এখনও নিম্নমধ্যবিত্তের স্বর্গ। এহেন খ্যাতির অন্যতম কারণ, এই শহরে এখনও যে দামে ভরপেট খাবার মিলে, তাহা ভারতের অন্য কোনও বড় শহরে কল্পনারও অতীত। শহরের ব্যস্ত অঞ্চলগুলির ফুটপাথ এক অর্থে ‘ফুডপাথ’— সেখানে হরেক খাদ্যের পসরা। তবে, সেই খাবার খাইয়াও মানুষ বাঁচিয়া থাকে, ইহাকে দৈব অনুগ্রহ ভিন্ন আর কিছু বলিয়া ব্যাখ্যা করা কঠিন। সম্প্রতি পুরসভার বেশ কয়েকটি অভিযানে ধরা পড়িল, কোথাও মর্গের বরফ ব্যবহৃত হইতেছে, কোথাও শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহার্য রং মিশিতেছে খাবারে। ফুটপাথের নোংরা ইত্যাদি তো আছেই। পুরসভা খানিক কঠোর হাতেই এই গোত্রের খাবার দোকানগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করিতে নামিয়াছে। উদার অর্থনীতির যুক্তি খাড়া করিয়া কেহ আপত্তি করিতে পারেন। বলিতে পারেন, ক্রেতারা বিলক্ষণ জানেন, তাঁহারা কী খাইতেছেন। ফুটপাথের সরবত খাইলে কলেরা হইতে পারে, এই কথাটি কার্যত প্রত্যেক মা তাঁহার সন্তানকে পঁই পঁই করিয়া বলিয়া দেন। তবুও যখন ক্রেতারা সেই খাবার খাইতেছেন, তাঁহাদের পছন্দটি— অর্থনীতির ভাষায়— ইনফর্মড চয়েস। অর্থাৎ, এই পছন্দের বিপদ সম্বন্ধে তাঁহারা সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল, এবং ঝুঁকির দিকটি মাথায় রাখিয়াই তাঁহারা পছন্দটি করিয়াছেন। প্রশাসন তাহাতে বাধা দেওয়ার কে? প্রশ্নটির বহুমাত্রিক উত্তর সম্ভব। প্রথম উত্তরটি হইল, উপভোক্তা সর্বদাই যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত করেন, নিজেদের ক্ষতির দিকটি তাঁহারা সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক ভাবে বিচার করিতে পারেন, এমন দাবি অর্থনীতির প্রাথমিক পাঠ্যবই ব্যতীত আর কোথাও নাই। বাস্তব দুনিয়ায় নাই তো বটেই। কাজেই, যাহাকে ‘ন্যানি স্টেট’ বলা হয়, তাহাকে উড়াইয়া দেওয়ার যথেষ্ট কারণ অর্থনীতি দেয় না।

Advertisement

দ্বিতীয়ত, উপভোক্তারা ঝুঁকির কথাটি সম্পূর্ণ ভাবে জানেন, তাহাও সম্ভবত সত্য নহে। রাস্তার বরফ খাইলে পেটখারাপ হইতে পারে, আর সরবতে যে বরফ ব্যবহৃত হইতেছে, তাহা শুধু শিল্পক্ষেত্রেই ব্যবহার্য, খাওয়ার জন্য কখনও নহে— এই দুইটি কথা এক নহে। দুই ক্ষেত্রে ঝুঁকির পরিমাণ পৃথক। ফলে, উপভোক্তা প্রথম ঝুঁকির কথা মাথায় রাখিয়া যে সিদ্ধান্ত করিতেছেন, দ্বিতীয় ঝুঁকির ক্ষেত্রে তাহা প্রযোজ্য নহে। প্রশাসন হস্তক্ষেপ না করিলে তথ্যের অসমতা থাকিয়াই যাইবে। এবং, জনস্বাস্থ্যে তাহার প্রভাব পড়িবে। সেই প্রভাবের আর্থিক তাৎপর্য নেহাত কম নহে। কাজেই, হস্তক্ষেপ করাই কর্তব্য। তাহা না করিলেই বরং প্রশাসনকে দোষ দেওয়া যাইত।

তৃতীয়ত, জনস্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পুরসভার কাজের অন্তর্গত। তাহার জন্য প্রচারও চলে। কিন্তু, শুষ্ক প্রচার কিছু দিনের মধ্যেই গুরুত্ব এবং কার্যকারিতা হারায়। বার্তাটি আর সাধারণ্যের মনে দাগ কাটে না। কিন্তু, কাটা ফলের বিপদ সংক্রান্ত প্রচারের পাশাপাশি প্রশাসন যদি সেই ফল বিক্রয়ের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়, তবে প্রচারের বার্তাটিও মানুষের মনে তাজা হইয়া উঠে। মানুষ এই বিপদ সম্বন্ধে নূতন করিয়া সচেতন হয়, এবং তাহার সিদ্ধান্তেও সেই সচেতনতার ছাপ পড়ে। আচরণগত অর্থনীতির তাত্ত্বিকরা বলিবেন, ইহাই মনের ধর্ম। বিপদ যত ক্ষণ না দরজায় কড়া নাড়ে, তত ক্ষণ অবধি মন তাহাকে ভুলিয়া থাকে। পুরসভার অভিযান আসলে এই কড়া নাড়িবার শব্দ।

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন