উপলক্ষ, একটি নতুন প্রাণের জন্ম। তাকে ঘিরে কত না হিসেবনিকেশ! হবু মায়ের উদ্দেশে পদে পদে উপদেশ বৃষ্টি— এটা খেয়ো না, ও দিকে যেয়ো না, এ ভাবে চুল খুলে রেখো না... আরও কত কী! আসলে সবাই চান, তাঁদের পরিবারে যে নতুন টুলটুলে মুখটি আর ক’দিন পরেই যোগ হতে চলেছে, তার আসার পথটা যেন হয় মাখনমসৃণ। সে যেন হয় সর্বাঙ্গসুন্দর। কোনও খুঁত যেন তার আবির্ভাব পর্বে না থাকে। সমস্যা হল, অনেক সময়ই এহেন উপদেশগুলোয় স্নেহের মাত্রার চেয়েও বেশি থাকে বিশ্বাস আর কুসংস্কার, আসলে যার কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তিই নেই। প্রেগন্যান্সি যদি স্বাভাবিক হয়, কোনও জটিলতা না থাকে, তা হলে অহেতুক নিয়ম মানার কোনও প্রয়োজন নেই। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের সঙ্গে তেমনই কিছু প্রচলিত ধারণা নিয়ে আলোচনা করলাম। আসুন, সত্যিটা জেনে নেওয়া যাক।
গর্ভাবস্থায় অনেক মেয়েকেই শুনতে হয়, ফলের মধ্যে পেঁপে, আনারস একদম খেতে নেই এই সময়। খেলেই মিসক্যারেজ নিশ্চিত। সত্যিই কি তাই? বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মোটেই তেমন কোনও নিয়ম নেই। অন্তত চিকিৎসাশাস্ত্র তো তেমন কিছু বলে না। এমনিতেই প্রতি ১০০টি প্রেগন্যান্সির মধ্যে ১৯-২০টি মিসক্যারেজের ঘটনা দেখা যায়। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই মিসক্যারেজের ঘটনা ঘটে প্রথম তিন মাসে। এর প্রধান কারণ হল, ভ্রূণের মধ্যের কিছু জিনগত ত্রুটি। এই ত্রুটির জন্যই প্রকৃতি সেই অস্বাভাবিক ভ্রূণকে নষ্ট করে দিতে চাইবে। এখন কোনও মা যদি দুর্ভাগ্যবশত সেই ১৯-২০ জনের এক জন হন, তা হলে তাঁরও মিসক্যারেজ হবে। এর সঙ্গে কোনও নির্দিষ্ট খাবারের যোগ নেই। আর কোনও আলাদা সাবধানতা নেওয়ারও প্রয়োজন নেই। প্রথম তিন মাসের মিসক্যারেজ স্বাভাবিক ঘটনা। খুব সাবধান হয়েও তাকে অনেক সময়ই ঠেকানো যায় না।
আর একটি মিথ ওজন বাড়াকে ঘিরে। গর্ভাবস্থায় তরতরিয়ে ওজন না বাড়লেই নাকি রোগা, অসুস্থ বাচ্চার জন্ম হবে। এমন মোক্ষম বাণীতে তটস্থ মা প্রথমেই ঘরে একটি ওজন মাপার যন্ত্র বসিয়ে ফেলেন। আর রোজই এক বার করে ওজনটা মেপে নেন, ঠিকঠাক বাড়ছে তো! আধুনিক চিকিৎসকরা কিন্তু অন্য কথাই বলছেন। যে মায়ের ওজন ৩০ কেজি বা যাঁর ওজন ১০০ কেজি, তাঁদের ক্ষেত্রে ওজন নিয়ে চিন্তার কারণ আছে। কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা এমন ঘন ঘন ওজন নেওয়ার বিরুদ্ধে। বাচ্চার ওজন ঠিক আছে কি না, সে ঠিকমত বাড়ছে কি না, জানার জন্য এখন আলট্রা সাউন্ড আছে। আগে বাচ্চার বৃদ্ধি মাপা হত হাতের সাহায্যে। হাত দিয়ে সন্দেহ হল, বাচ্চা ঠিকমত বাড়ছে না, সঙ্গে মায়ের ওজনটাও বাড়েনি। তখন তাঁরা অন্য কথা ভাবতেন। কিন্তু এখন হাত দিয়ে কোনও সন্দেহ হলেই, তা ঠিক কি না দেখে নেওয়ার জন্য আলট্রা সাউন্ডের সাহায্য নেওয়া যায়। ফলে, মায়ের ওজন নেওয়ার আর প্রয়োজন পড়ে না। বরং ঘন ঘন ওজনের দিকে তাকিয়ে থাকাটা মায়ের স্ট্রেস বাড়ায়, যেটা মোটেও ঠিক নয়।
মিথ রয়েছে আরও অনেক কিছুকে ঘিরে। টালিগঞ্জের অমৃতা যেমন মাছ-মাংস মুখেই তুলতে পারত না, গা গুলিয়ে বমি আসত বলে। বাড়ির লোক মহা দুশ্চিন্তায়। প্রোটিনটাই তো পাচ্ছে না বাচ্চা, কী হবে এ বার! কাঁদকাঁদ মুখে অমৃতা দৌড়ল ডাক্তারের কাছে। আর মহা ধমক খেল। ডাক্তারবাবু স্পষ্ট জানালেন, এ দেশে যাঁদের মাছ-মাংস জোটে না বা যাঁরা নিরামিষাশী, তাঁদেরও তো দিব্যি বাচ্চা হচ্ছে। সুস্থ বাচ্চাই জন্মাচ্ছে। তা হলে? মাছ-মাংস না খেলে অন্য উপায়ে সে চাহিদা মেটাতে হবে।
আসলে, একটা শিশুর জন্মকে ঘিরে থাকে অনেক সংশয়। কখনও খারাপ কিছু হলে নানা যুক্তি খোঁজে মন। তাই এমন সব আশ্চর্য নিদানের জন্ম। বোয়াল মাছ খেলে অমন দেখতে বাচ্চা জন্মাবে, পেটে কখনও ঠুক করে আঘাত লাগলে বাচ্চার মাথাটা নির্ঘাত চ্যাপ্টা হবে, এই সময় শারীরচর্চা নয়, যৌন মিলন নয় ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে সবার উপরে বোধ হয়, ছেলে হবে না মেয়ে— তা নিয়ে রকমারি আন্দাজ। যেমন, হবু মায়ের পেটের গড়ন লম্বাটে না কোমর চওড়া, মায়ের রূপ ফেটে পড়ছে, না চোখের তলায় গাঢ় কালো পোঁচ— এ সব দেখে মা-জেঠিমারা শিশু পৃথিবীর আলো দেখার ঢের আগেই নিশ্চিত হয়ে যান, কে আসবে তাঁদের সংসারে। এগুলো কোনওটাই সত্যি নয়। অন্তত চিকিৎসকরা সত্যি বলে মানেন না।
গর্ভাবস্থা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। আনন্দেরও। তাতে যদি কোনও জটিলতা না থাকে, তা হলে তাকে চুটিয়ে উপভোগ করুন। বিন্দুমাত্র সন্দেহ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। আর সব দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে ফুরফুরে থাকুন। গান শুনুন, বই পড়ুন, সিনেমা দেখুন... যা খুশি করুন। মা-ঠাকুমারা কিন্তু এই একটা পরামর্শ একদম ঠিক দিয়ে থাকেন।