বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে ধীরে ধীরে গলছে সুমেরু সাগরের বরফ। তারই কুপ্রভাবে বিপর্যস্ত পৃথিবী। দুনিয়া জুড়ে বাড়ছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। কিন্তু, এ-হেন বিশ্ব উষ্ণায়নের একটা ভাল দিক এ বার খুঁজে পেল চিন। সেই ‘ভাল দিক’ কাজে লাগিয়ে পশ্চিম ইউরোপে পণ্য পরিবহণের নতুন রাস্তা আবিষ্কার করে ফেলেছে বেজিং। মান্দারিনভাষীদের দেখানো পথ ধরে এগোলে লাভ হতে পারে ভারতেরও। ফলে গোটা বিষয়টির উপর কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার যে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছে, তা বলাই বাহুল্য।
সম্প্রতি একটি চিনা পণ্যবাহী জাহাজের সুমেরু সাগর পেরিয়ে যাওয়ার খবর প্রকাশ্যে আসতেই দুনিয়া জুড়ে পড়ে যায় শোরগোল। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, মাত্র ছ’দিনে ওই জলযানটি সংশ্লিষ্ট রাস্তা পার করে বলে জানিয়েছে বেজিং। নতুন পথের পোশাকি নাম ‘উত্তর সামুদ্রিক রাস্তা’ বা নর্দার্ন সি রুট। বিশ্ব উষ্ণায়নে সুমেরুর বরফ গলার কারণেই এর সন্ধান পেয়েছেন ড্রাগনভূমির নাবিকেরা। ইউরোপ পৌঁছোনোর এই বিকল্প রাস্তা আগামী দিনে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ‘খেলা ঘোরাবে’ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
উত্তর সামুদ্রিক পথের সূচনা হয়েছে বেরিং প্রণালীতে। রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কার মাঝে সরু এই সামুদ্রিক রাস্তাটির সংকীর্ণতম অংশটি চওড়ায় মাত্র ৮৫ কিলোমিটার। চিনা পণ্যবাহী জাহাজ ওই প্রণালী পেরিয়ে বাঁদিকে বাঁক নিয়ে পৌঁছোয় নরওয়ে সাগরে। মাঝে অবশ্য চুকচি সাগর, পূর্ব সাইবেরিয়া সাগর, ল্যাপতেভ সাগর, কারা সাগর এবং ব্যারেন্ট্স সাগর পেরোতে হয়েছে জাহাজটিকে। উত্তর রুশ উপকূল সংলগ্ন এই এলাকাটি পুরোপুরি ভাবে সুমেরু সাগরের অন্তর্গত।
প্রশান্ত মহাসাগরকে সুমেরু সাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে এই বেরিং প্রণালী। সংশ্লিষ্ট রাস্তার সন্ধান পাওয়ার বিষয়টিকে ‘মাস্টারস্ট্রোক’ হিসাবে দেখার নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, ইউরোপ যাওয়ার প্রথাগত তিনটি পথের তুলনায় এতে পণ্য পরিবহণের সময় লাগবে অনেক কম। তা ছাড়া এই পথ ধরে যথেষ্ট সস্তায় এবং কম জ্বালানি খরচ করে সেখানকার বাজারে বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে যেতে পারবে চিন। কারণ, নতুন পথের কোথাও কোনও শুল্ক দেওয়ার ব্যাপার নেই।
এ ছাড়া উত্তর সামুদ্রিক রাস্তার আরও একটি সুবিধা রয়েছে। এই পথে জলদস্যু-সহ নেই কোনও নিরাপত্তাজনিত সমস্যা। অন্য দিকে ইউরোপ যাওয়ার প্রথাগত সামুদ্রিক রাস্তায় দিন দিন বাড়ছে সেই চ্যালেঞ্জ। এর নেপথ্যে আছে মূলত ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা। ফলত আগামী দিনে বেজিঙের জন্য ওই পথ বন্ধ হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না কেউই।
বিশ্লেষকদের দাবি, চিনা অর্থনীতির চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে তাদের বৈদেশিক বাণিজ্যে। এর সিংহভাগ নিয়ন্ত্রিত হয় সামুদ্রিক রাস্তায়। সেখানকার একাধিক ‘চোক পয়েন্ট’ গত কয়েক বছরে ড্রাগনভূমির রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে, বলা যেতে পারে। উদাহরণ হিসাবে ভারতের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ সংলগ্ন মলাক্কা প্রণালীর কথা বলা যেতে পারে। এই সামুদ্রিক রাস্তায় ৭০ শতাংশ অপরিশোধিত খনিজ তেল নিজেদের বন্দরে নিয়ে যান মান্দারিনভাষী নাবিকেরা।
সাবেক সেনাকর্তাদের কথায়, মলাক্কা প্রণালীতে চিনা পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ হলে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে বেজিঙের অর্থনীতি। আর তাই সীমান্ত সংঘাতকে কেন্দ্র করে সম্পর্কের ওঠাপড়া শুরু হতেই সংশ্লিষ্ট সামুদ্রিক রাস্তাটিকে নিশানা করে নয়াদিল্লি। কিছু দিন আগে সেখানে এ দেশের নৌবাহিনীর টহলদারি শুরু করার ব্যাপারে সম্মতি জানিয়েছে সিঙ্গাপুর। এতে ড্রাগনের রক্তচাপ যে ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
ইউরোপ যাওয়ার পথে চিনের দ্বিতীয় ‘চোক পয়েন্ট’ হল হরমুজ় প্রণালী। ইরানের উপকূল সংলগ্ন এই রাস্তাটি ওমান উপসাগরকে পারস্য উপসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। হরমুজ় প্রণালীর উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে শিয়া মুলুকটির আধা সেনা ‘ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোর’ বা আইআরজিসির। গত দু’তিন বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইজ়রায়েলের সঙ্গে তেহরানের সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় ওই এলাকায় ক্রমশ তীব্র হচ্ছে যুদ্ধের আশঙ্কা।
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা মনে করেন, মুখোমুখি সংঘাত শুরু হলে কৌশলগত অবস্থানের কারণে হরমুজ় প্রণালী বন্ধ করবে আইআরজিসি। তখন ওই রাস্তায় পণ্যবাহী জাহাজ নিয়ে যেতে পারবে না চিন। দ্বিতীয়ত, এর জেরে আন্তর্জাতিক বাজারে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে পারে খনিজ তেলের দাম। কারণ, মূলত হরমুজ় প্রণালী দিয়েই ‘তরল সোনা’ সরবরাহ করে থাকে পশ্চিম এশিয়ার অধিকাংশ দেশ। একই সমস্যা রয়েছে বাব এল-মান্দেব প্রণালীতেও।
আফ্রিকার শিংয়ের (পড়ুন হর্ন অফ আফ্রিকা) উপর অবস্থিত বাব এল-মান্দেব লোহিত সাগরকে জুড়েছে এডেন উপসাগরের সঙ্গে। পশ্চিম এশিয়ার এই এলাকা যুদ্ধবিগ্রহের কারণে সবচেয়ে বেশি অস্থির। এর একপাশে রয়েছে ইয়েমেন, যেখানকার হুথি বিদ্রোহীদের প্রায়ই পণ্যবাহী জাহাজকে নিশানা করতে দেখা যায়। উল্টো দিকে সোমালিয়া। আফ্রিকার ওই দেশটির জলদস্যুরা রীতিমতো দাপিয়ে বেড়ায় বাব এল-মান্দেবে।
লোহিত সাগরকে আবার ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে জুড়েছে সুয়েজ খাল। একে পৃথিবীর সামুদ্রিক রাস্তাগুলির মধ্যে ব্যস্ততম বললে অত্যুক্তি করা হবে না। এ-হেন সুয়েজ খাল আবার রয়েছে মিশরের নিয়ন্ত্রণে। একে হাতিয়ার করে অতীতে বহু বার ইজ়রায়েলকে সমস্যার মুখে ফেলার চেষ্টা করেছে কায়রো। ফলে গত শতাব্দীতে বেশ কয়েক বার দু’পক্ষের বাহিনীকে যুদ্ধে জড়াতে দেখা গিয়েছে। সংঘর্ষের সময়ে সুয়েজ বন্ধ করে আন্তর্জাতিক চাপ তৈরির কৌশল নিতে পিছপা হয়নি ‘পিরামিডের দেশ’।
সুয়েজ খালের ক্ষেত্রে আরও একটি সমস্যা রয়েছে। এই খালে মাঝেমধ্যেই নাব্যতাজনিত সমস্যার কারণে আটকে যায় জাহাজ। তখন বেশ কিছু দিনের জন্য ওই রাস্তায় থমকে থাকে পণ্য পরিবহণ। এই পরিস্থিতিতে পশ্চিম ইউরোপে যাওয়ার আরও একটি রাস্তা রয়েছে। সেটা হল ‘উত্তমাশা অন্তরীপ’ (কেপ অফ গুড হোপ) পেরিয়ে গোটা আফ্রিকা ঘুরে জিব্রাল্টার প্রণালী দিয়ে সেখানে পৌঁছোনো। এই পথটি যথেষ্ট পুরোনো এবং এতে সময় লাগে সবচেয়ে বেশি।
এগুলিকে বাদ দিলে পশ্চিম ইউরোপে পণ্য নিয়ে যেতে চিনের সামনে আরও একটি বিকল্প রয়েছে। সেটা হল পানামা খাল, যা প্রশান্ত মহাসাগরকে আটলান্টিকের সঙ্গে জুড়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট খালটিতে আবার অন্য একটি সমস্যা রয়েছে। এতে জাহাজ চলাচলের জন্য রয়েছে বিশেষ একটি হাইড্রলিক প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে খালের জলস্তর ওঠানামা করিয়ে পণ্যবাহী জলযানকে এক জায়গা থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়।
এই প্রযুক্তি চালু রাখতে প্রচুর পরিমাণে মিষ্টি জলের প্রয়োজন। কারণ, লবণাক্ত সামুদ্রিক জল ব্যবহার করলে সংশ্লিষ্ট হাইড্রোলিক প্রযুক্তিটি দ্রুত নষ্ট হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাড়ে এর রক্ষণাবেক্ষণের খরচ। বর্তমানে পানামা খালের মিষ্টি জলের প্রয়োজন মেটাচ্ছে মিরাফ্লোরেজ় এবং গাতুন হ্রদ। চাগ্রেস নদী এবং লেক আলাজুয়েলাকে বাঁধ দিয়ে দ্বিতীয়টিকে কৃত্রিম ভাবে তৈরি করেছেন প্রকৌশলীরা। সংশ্লিষ্ট খাল দিয়ে একটি জাহাজ যেতে ২০ কোটি লিটার মিষ্টি জলের প্রয়োজন হয় বলে জানা গিয়েছে।
ইউরোপে পণ্য পরিবহণের জন্য পানামা খাল ব্যবহারের ক্ষেত্রে চিনের দু’টি সমস্যা রয়েছে। প্রথমত, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ওই এলাকায় কমেছে বৃষ্টিপাত। ফলে আগের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে মিষ্টি জলের সরবরাহ। ফলে ভারী জাহাজ নিয়ে খালটি পেরোনো ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে। দ্বিতীয়ত, পানামায় বেজিঙের পণ্যবাহী জাহাজের আনাগোনায় একেবারেই খুশি নয় আমেরিকা। এর জেরে ওই রাস্তা ধরলে ওয়াশিংটনের চাপও সহ্য করতে হয় মান্দারিনভাষী নাবিকদের।
এই সমস্ত চ্যালেঞ্জ দূর করতে দীর্ঘ দিন ধরেই বিকল্প রাস্তার খোঁজ চালাচ্ছিল চিন। অবশেষে সুমেরু সাগরের বরফ গলে যাওয়ার কারণে সেই ‘অমূল্য রতন’ বেজিঙের হাতে এল বলা যেতে পারে। বর্তমানে রাশিয়ার থেকে বিপুল পরিমাণে খনিজ তেল কিনছে ড্রাগন সরকার। আগামী দিনে এই রাস্তায় তা ঘরের মাটিতে নিয়ে যাওয়ার সুবিধা পাবে তারা। সে ক্ষেত্রে মলাক্কা প্রণালীর রাস্তা আটকে গেলেও অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে নিতে পারবে বেজিং।
চিনের পাশাপাশি উত্তর সামুদ্রিক রাস্তা আগামী দিনে ব্যবহার করতে পারবে ভারতও। গত বছর প্রশান্ত মহাসাগর দিয়ে রাশিয়া যাওয়ার একটি বিকল্প পথ চালু করে নয়াদিল্লি। রাস্তাটির পোশাকি নাম ‘চেন্নাই ভ্লাদিভস্তক মেরিটাইম করিডোর’। বর্তমানে সুয়েজ খালের বিকল্প রাস্তা হিসাবে এটি ব্যবহার করছেন এ দেশের ব্যবসায়ীরা। এতে পণ্য পরিবহণের রাস্তা কমেছে প্রায় ৫,৬০৮ কিলোমিটার।
পূর্ব রাশিয়ার বন্দর শহর ভ্লাদিভস্তক থেকে বেরিং প্রণালীর দূরত্ব খুব বেশি নয়। ফলে চিনের দেখানো রাস্তায় এ দেশের পণ্যবাহী জাহাজগুলির এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা কিছু নেই। তবে উত্তর সামুদ্রিক পথের অধিকাংশ এলাকা মস্কোর একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের অন্তর্গত। পণ্য পরিবহণের জন্য সেখানে অহরহ বিদেশি জাহাজের আনাগোনা ক্রেমলিন কতটা মেনে নেবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
চিনের ক্ষেত্রে এই রাস্তা ব্যবহারে দ্বিতীয় কাঁটা হল আমেরিকা। কারণ বেরিং প্রণালী সংলগ্ন আলাস্কায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক সেনাঘাঁটি। কৌশলগত দিক দিয়ে জায়গাটার গুরুত্ব অপরিসীম। ফলে সেখানে বেজিঙের পণ্যবাহী জাহাজের আনাগোনা যে মার্কিন সরকার সহজে মেনে নেবে না, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।