China-Japan Escalation

১৩০ বছরের পুরনো শত্রুতার আগুনে নতুন করে পড়ল ঘি, তাইওয়ান-তাসে ড্রাগন-বধের ‘ছক কষছে’ সামুরাই যোদ্ধারা

চিন-জাপান সংঘাতকে কেন্দ্র করে তপ্ত হচ্ছে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকা। টোকিয়োর একটি দ্বীপকে ঘিরতে ইতিমধ্যেই উপকূলরক্ষী বাহিনী পাঠিয়েছে বেজিং। পাল্টা হুঁশিয়ারির সুর শোনা গিয়েছে দ্বীপরাষ্ট্রের মহিলা প্রধানমন্ত্রীর গলায়।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০২৫ ১৬:২১
Share:
০১ ২০

ফের প্রশান্ত মহাসাগরে যুদ্ধের দামামা। রণহুঙ্কারে একে অপরকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে যুযুধান ড্রাগন ও সামুরাই-যোদ্ধারা। এর জেরে ১৩০ বছরের পুরনো শত্রুতার আগুনে নতুন করে ঘি পড়ল বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ। শেষ পর্যন্ত দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধলে তাতে জড়াতে পারে ‘সুপার পাওয়ার’ আমেরিকাও। সে ক্ষেত্রে ওই এলাকায় ফিরবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি। পাশাপাশি, এর আঁচ যে ভারতের গায়েও লাগবে, তা বলাই বাহুল্য।

০২ ২০

চলতি বছরের ৭ নভেম্বর সাবেক ফরমোজ়া তথা দ্বীপরাষ্ট্র তাইওয়ানকে নিয়ে বিবৃতি দেন জাপানি প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি। সংশ্লিষ্ট দেশটিকে চিন কব্জা করতে চাইলে টোকিয়ো যে চুপ করে বসে থাকবে না, তা স্পষ্ট করে দেন তিনি। প্রয়োজনে তাইওয়ানকে সামরিক সাহায্যের কথাও বলতে শোনা গিয়েছে তাঁকে। সামুরাই প্রধানমন্ত্রীর এ-হেন মন্তব্যের পরই পারদ চড়ায় বেজিং। উপকূলরক্ষী বাহিনীর রণতরী ঘিরে ফেলে জাপানের সেনকাকু দ্বীপ।

Advertisement
০৩ ২০

তাইওয়ানকে নিয়ে চিন-জাপানের সংঘাত নতুন নয়। প্রশান্ত মহাসাগরের ওই দ্বীপরাষ্ট্রের সরকারি পরিচয় অবশ্য ‘রিপাবলিক অফ চায়না’ বা আরওসি, যাকে দেশ হিসাবে মানতে নারাজ বেজিং। সাবেক ফরমোজ়াকে ড্রাগনভূমির অবিচ্ছেদ্য অংশ বলেই মনে করে মান্দারিনভাষীদের সরকার। তাদের সাফ কথা, বিশ্বে একটাই চিন রয়েছে, যার সরকারি নাম ‘পিপল্স রিপাবলিক অফ চায়না’ বা পিআরসি। বেজিঙের এই ‘এক চিন’ নীতিই বিরোধের মূল কারণ, বলছেন বিশ্লেষকেরা।

০৪ ২০

২১ শতকের প্রথম দশক কাটতে না কাটতেই এই নিয়ে বাড়তে থাকে জটিলতা। তাইওয়ান ইস্যুতে আরও ‘আগ্রাসী’ হয়ে ওঠে চিনের ‘পিপল্‌স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ নৌবাহিনী। একগুচ্ছ রণতরীতে দ্বীপরাষ্ট্রকে ঘিরে ফেলা বা যখন-তখন লড়াকু জেট পাঠিয়ে সেখানকার আকাশসীমা লঙ্ঘন বেজিঙের নিত্য দিনের অভ্যাসে পরিণত হয়। সাবেক ফরমোজ়ার পাশাপাশি একাধিক জাপানি দ্বীপ এবং গোটা দক্ষিণ চিন সাগর কব্জা করার ছক রয়েছে ড্রাগনের।

০৫ ২০

উদাহরণ হিসাবে সেনকাকুর কথাই বলা যেতে পারে। তাইওয়ান সংলগ্ন ওই জাপানি দ্বীপের নাম হঠাৎ করেই বদলে দিয়াওয়ু করে দেয় চিন। শুধু তা-ই নয়, বেশ কয়েক বার এর জলসীমায় রণতরী পাঠিয়েছে ড্রাগনের লালফৌজ। এই নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে টোকিয়ো বার বার অভিযোগ জানালেও, তাতে পাত্তা দেয়নি বেজিং। উল্টে অন্যায় ভাবে সংশ্লিষ্ট দ্বীপটি জাপান দখল করে রেখেছে বলে পাল্টা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে মান্দারিনভাষীদের সরকার।

০৬ ২০

এই পরিস্থিতিতে সব হিসাব উল্টে দিতে পাল্টা ‘আক্রমণাত্মক’ নীতি নিয়েছেন সদ্য ক্ষমতায় আসা টোকিয়োর প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচি। তাইওয়ানের উপর চিনা ‘আগ্রাসন’-এর নিন্দা করে একে ‘অস্তিত্বের সঙ্কট’ বলে উল্লেখ করেন তিনি। তাঁর ওই মন্তব্যই ছিল জোঁকের মুখে নুন পড়ার সামিল। তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে তৎক্ষণাৎ নাগরিকদের জাপান যেতে নিষেধ করে বেজিং। সরকারি অ্যাডভাইজ়রি জারি হতেই বিমানের টিকিট বাতিলে ভাড়া ফেরানোর প্রতিশ্রুতি দেয় সেখানকার সমস্ত উড়ান সংস্থা।

০৭ ২০

‘দ্য ইউরেশিয়ান টাইম্স’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকারি আবেদনে সাড়া দিয়ে ইতিমধ্যেই জাপান ভ্রমণ বাতিল করেছেন প্রায় পাঁচ লক্ষ চিনা নাগরিক। এর ফলে জাপানি পর্যটনশিল্পে বড় ধাক্কা লেগেছে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, গত বছর (পড়ুন ২০২৪ সালে) সামুরাই-যোদ্ধাদের দেশে বেড়াতে যাওয়া ড্রাগনভূমির বাসিন্দাদের সংখ্যা ছিল ৭০ লক্ষ। সেটা যে এ বার উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

০৮ ২০

বেজিঙের দিক থেকে পর্যটনশিল্পে ধাক্কা আসতেই গত ১৮ নভেম্বর জাপানি নাগরিকদের জন্য পাল্টা নির্দেশিকা জারি করে তাকাইচির সরকার। সেখানে বাড়ির বাইরে চৈনিক বাসিন্দাদের বিষয়ে সকলকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। গত ১৪ নভেম্বর তাইওয়ান ইস্যুতে টোকিয়োকে চরম হুঁশিয়ারি দেয় ড্রাগনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। সাবেক ফরমোজ়া দ্বীপটি নিয়ে নাক গলানো বন্ধ না করলে ‘ধ্বংসাত্মক সামরিক পদক্ষেপ’-এর মুখে পড়তে হবে বলে হুমকি দেয় ড্রাগন।

০৯ ২০

চিনের ওই হুঁশিয়ারি অবশ্য সহ্য করেনি জাপান। ওই দিনই বেজিঙের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে কড়া কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া দেয় টোকিয়ো। পরে এ ব্যাপারে বিবৃতি দেন দ্বীপরাষ্ট্রের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মাইনরু কিহারা। বলেন, ‘‘আমরা দেশ ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি, সেই সঙ্গে রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থাকে বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কেউ আগ্রাসী মনোভাব নিলে পাল্টা জবাব দিতে দেরি করবে না টোকিয়ো।’’

১০ ২০

এ-হেন চিন-জাপান দ্বন্দ্বের শুরুটা অবশ্য হয়েছিল ১৯ শতকে। ওই সময় ঝটিতি আক্রমণে তাইওয়ান দখল করে টোকিয়ো। সামুরাইদের সামরিক অভিযানের সাফল্যের সালটা ছিল ১৮৯৫। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আট বছর আগে, ১৯৩১ সালে সম্পূর্ণ মাঞ্চুরিয়া কব্জা করে জাপান। ওই সময় প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় একরকম অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে দ্বীপরাষ্ট্রের ফৌজ। তাদের আটকানোর কোনও শক্তিই ছিল না বেজিঙের।

১১ ২০

১৯৩৭ সালে মাঞ্চুরিয়ার সীমানা বৃদ্ধিতে চিনের উপকূলবর্তী এলাকাগুলিতে আক্রমণ শানায় জাপানি সেনা। ওই সময় দেশের একটা বিরাট অঞ্চল টোকিয়োর আক্রমণে খুইয়ে বসে বেজিং। এর পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-’৪৫) শুরু হলে গোদের উপরে বিষফোড়ার মতো ভয়ঙ্কর এক গৃহযুদ্ধের মুখে পড়ে ড্রাগনভূমি। ফলে সাঁড়াশি চাপে মৃত্যু হয় শয়ে শয়ে মান্দারিনভাষীর।

১২ ২০

গত শতাব্দীর ৩০-এর দশকের শেষের দিকে শুরু হওয়া চিন-জাপান যুদ্ধ আট বছর স্থায়ী হয়েছিল। তাতে ২ কোটি ২০ লক্ষের বেশি নাগরিক হারায় বেজিং। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান আক্রমণে সর্বাধিক মৃত্যু দেখেছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া)। ড্রাগনভূমির স্থান ছিল ঠিক তার পরেই। শুধু তা-ই নয়, সংখ্যাটা ওই লড়াইয়ে জার্মানি, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্মিলিত হতাহতের দ্বিগুণের বেশি বলে জানা গিয়েছে।

১৩ ২০

১৯৪৫ সালের ৬ এবং ৯ অগস্ট জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক আক্রমণ চালায় আমেরিকা। এর পরেই টোকিয়োর নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। লড়াই থামতেই মাঞ্চুরিয়া-সহ চিনের সমস্ত এলাকা থেকে বাহিনী প্রত্যাহার করে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র। ফলে স্বাধীনতা পায় ড্রাগন। কিংবদন্তি মাও-জ়ে-দঙের নেতৃত্বে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় কমিউনিস্ট শাসন।

১৪ ২০

মাওয়ের নেতৃত্ব অবশ্য চিনের সকলে মেনে নিয়েছিলেন এমনটা নয়। তাঁর কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রবল বিরোধী ছিলেন চিয়াং-কাই-শেখ। আর তাই বেশ কিছু অনুগামীকে নিয়ে সাবেক ফরমোজ়া বা তাইওয়ানে চলে যান তিনি। তাঁর নেতৃত্বে সেখানে গড়ে ওঠে আধুনিক আরওসি। সেই কারণেই ওই এলাকাকে নিজের বলে দাবি করে আসছে বেজিং। সংশ্লিষ্ট দ্বীপটি নিয়ে একটি শব্দও শুনতে রাজি নয় ড্রাগন সরকার।

১৫ ২০

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সামরিক শক্তি অনেকটাই হ্রাস করে জাপান। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে উত্থান হয় চিনের। গোড়ার দিকে তাইওয়ান ইস্যুতে চুপ করে ছিল টোকিয়ো। কিন্তু, অচিরেই ভুল ভাঙে তাদের। সামুরাই-যোদ্ধাদের আশঙ্কা, তাইওয়ান দখলের পর তাদের নিশানা করবে বেজিং। কারণ, বিশ্বের বৃহত্তম নৌবহর থাকায় প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার ‘মুকুটহীন সম্রাট’ হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে ড্রাগন।

১৬ ২০

গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার ইনডেক্স অনুযায়ী, ফৌজি শক্তিতে জাপানের চেয়ে কয়েক যোজন এগিয়ে আছে চিন। ড্রাগনের স্থলবাহিনী বিশ্বের বৃহত্তম। ২০.৩৫ লক্ষ সক্রিয় কর্মী রয়েছে লালফৌজের। সেখানে টোকিয়োর সক্রিয় সৈনিকের সংখ্যা মাত্র ২.৪৭ লাখ। অর্থাৎ, প্রায় ১০ গুণ বড় সেনাবাহিনী আছে বেজিঙের হাতে।

১৭ ২০

কিন্তু জাপানের সঙ্গে মুখোমুখি লড়তে গেলে অন্য সমস্যার মুখে পড়তে পারে চিন। কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিশেষ সামরিক চুক্তি রয়েছে টোকিয়োর। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রটিকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে ওয়াশিংটন। আর তাই সামুরাই-যোদ্ধাদের দেশে অন্তত ১৪টি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে আমেরিকার।

১৮ ২০

জাপানি প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচির সবচেয়ে বড় শক্তি হল দ্বীপরাষ্ট্রে মোতায়েন থাকা ৫৪ হাজার মার্কিন সৈন্য। তাদের কাছে আছে পঞ্চম প্রজন্মের এফ-৩৫ ও এফ-২২ লড়াকু জেট, প্যাট্রিয়ট আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যুদ্ধজাহাজ ধ্বংসকারী টমাহক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র এবং স্ট্যান্ডার্ড-৩ ক্ষেপণাস্ত্র।

১৯ ২০

বিশ্বযুদ্ধের পর আণবিক অস্ত্র নিয়ে তিনটি নীতি নিয়েছিল জাপান। সেগুলি হল, পরমাণু হাতিয়ার তৈরি, নির্মাণ বা সেটা মোতায়েনের কোনও অনুমতি কখনওই দেবে না টোকিয়ো। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেখান থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দিয়েছেন তাকাইচি। দ্বীপরাষ্ট্রে পরমাণু অস্ত্র মোতায়েনের অনুমতি দিতে পারেন তিনি। তখন ওই গণবিধ্বংসী হাতিয়ার বিভিন্ন ছাউনিতে নিয়ে আসতে পারবেন মার্কিন কমান্ডারেরা।

২০ ২০

চিনের দিক থেকে সংশ্লিষ্ট সংঘাতের আরও একটি বিপদ রয়েছে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে কোনও বারই জাপানের সঙ্গে যুদ্ধে এঁটে উঠতে পারেনি বেজিং। লড়াইয়ের ময়দানে সেই মানসিক চাপ থাকবে পিএলএ-র উপর। ফলে শেষ পর্যন্ত জল কোন দিকে গড়ায় সেটাই এখন দেখার।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement