সঙ্কটে চিনা অর্থনীতি। খুচরো বাজারে হু-হু করে কমছে বেজিঙের পণ্যের চাহিদা। ফলে ড্রাগনভূমির কারখানাগুলিতে উৎপাদন বৃদ্ধির হার সর্বনিম্ন স্তরে এসে পৌঁছেছে। এর জেরে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে বাড়ছে উদ্বেগ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধের জেরেই কি এ-হেন বিপদের সম্মুখীন মান্দারিনভাষীরা? বর্তমানে হন্যে হয়ে এই প্রশ্নের জবাব খুঁজছেন দুনিয়ার দুঁদে আর্থিক বিশ্লেষকদের একাংশ।
চলতি বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর দেশের আর্থিক বৃদ্ধি সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে চিনের জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো (ন্যাশনাল ব্যুরো অফ স্ট্যাটিসটিক্স বা এনবিএস)। সেখানে বলা হয়েছে, এ বছরের অগস্টে খুচরো বাজারে পণ্য বিক্রির পরিমাণ গত বছরের অগস্টের নিরিখে বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ৩.৪ শতাংশ। অন্য দিকে, কারখানাগুলির উৎপাদন বেড়েছে ৫.২ শতাংশ, ২০২৪ সালের অগস্টের পর থেকে যা সর্বনিম্ন। সংশ্লিষ্ট রিপোর্টটি যে বেজিঙের কর্তাব্যক্তিদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে, তা বলাই বাহুল্য।
চিনের আর্থিক বৃদ্ধি নিয়ে সম্প্রতি একটি সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করে সংবাদসংস্থা রয়টার্স। সেখানে এ বছরের অগস্টে বৃদ্ধির সূচক ৩.৯ শতাংশ থাকবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, বাস্তবে তা হয়নি। শুধু তা-ই নয়, গত জুলাইয়ে আর্থিক বৃদ্ধির অঙ্ক ছিল ৩.৭ শতাংশ। সেখানে অগস্টে সূচকের গতি আরও শ্লথ হয়েছে বলে জানিয়েছে বেজিঙের জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এ বছরের জুলাইয়ে চিনের কারখানাগুলিতে উৎপাদন বৃদ্ধি পায় ৫.৭ শতাংশ। অর্থনীতিবিদদের আশা ছিল যে অগস্টে এই অঙ্ক ধরে রাখতে পারবে বেজিং। কিন্তু সূচক সেখান থেকে নেমে যাওয়ায় হতাশ হয়েছেন তাঁরা। এ ছাড়া ২০২৫ সালের প্রথম আট মাসে স্থায়ী সম্পদের বিনিয়োগ বেড়েছে মাত্র ০.৫ শতাংশ। ২০২০ সালের কোভিড অতিমারির বছরটিকে বাদ দিলে এই বৃদ্ধিকে সবচেয়ে খারাপ বলা যেতে পারে।
চিনা অর্থনীতির বড় অংশ জুড়ে রয়েছে রিয়্যাল এস্টেট ব্যবসা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই সেখানে মন্দা লক্ষ করা যাচ্ছে। মাঝে অবশ্য ‘আকাল’ কাটিয়ে কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছিল বেজিং। এ বছর ছবিটা আবার যে-কে সেই! সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ড্রাগনভূমিতে লাফিয়ে লাফিয়ে কমছে বাড়ি ও ফ্ল্যাটের দাম। গত বছরের নিরিখে ২০২৫ সালে এখনও পর্যন্ত বেজিঙের বাড়ি বিক্রির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে প্রায় ১৯ শতাংশ।
উল্লেখ্য, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মধ্যে চিনে স্থায়ী সম্পদের লগ্নি বৃদ্ধি পায় মাত্র ১.৬ শতাংশ। ফলে প্রথম সাত মাসেই আর্থিক সমস্যার ছায়া স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। অগস্টের পর এই অঙ্ক সামান্য কমে ১.৪ শতাংশে নেমে আসবে বলে পূর্বাভাস দেন আর্থিক বিশ্লেষকদের একাংশ। তা মিথ্যা প্রমাণ করে আরও নিম্নমুখী হয়েছে সূচক। শুধু তা-ই নয়, প্রথম সাত মাসে রিয়্যাল এস্টেটে বিনিয়োগ হ্রাস পেয়েছে ১২.৯ শতাংশ। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও জল সরবরাহ এবং পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে এক বছর আগের তুলনায় লগ্নি বেড়েছে মাত্র ৫.১ শতাংশ।
২০২৫ সালের শুরুটা অবশ্য চিন যে খুব খারাপ ভাবে করেছিল, এমনটা নয়। বছরের গোড়ার দিকে রফতানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ৫.৩ শতাংশ ঊর্ধ্বমুখী ছিল অর্থনীতির সূচক। কিন্তু, গত এপ্রিল থেকে বেজিঙের সঙ্গে কোমর বেঁধে শুল্কসংঘাতে জড়িয়ে পড়েন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ফলে দুই দেশের সম্পর্কে ফাটল ধরে। বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, এর জেরে মার খেয়েছে ড্রাগনের রফতানি বাণিজ্য, যা মান্দারিনভাষীদের আর্থিক বৃদ্ধির সূচককে টেনে নামিয়েছে বলে মনে করছেন তাঁরা।
এই পরিস্থিতিতে গোদের উপর বিষফোড়ার মতো খারাপ পারফর্ম করছে চিনের শেয়ার বাজারও। ফলে সেখান থেকে ক্রমশ মুখ ফেরাচ্ছেন বিদেশি লগ্নিকারীরা। বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে মুখ খুলছেন সমীক্ষক সংস্থা ‘দ্য কনফারেন্স বোর্ড’-এর চায়না সেন্টারের প্রধান ইউহান ঝাং। তাঁর কথায়, ‘‘রাষ্ট্রায়ত্ত উদ্যোগ স্থায়ী সম্পদে লগ্নি কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু পাল্লা দিয়ে কমছে বেসরকারি বিনিয়োগ।’’ একে আর্থিক মন্দার মূল কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন তিনি।
সংবাদসংস্থা ব্লুমবার্গকে ঝাং বলেন, ‘‘কোনও একটা ক্ষেত্র দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করলেই যে আর্থিক বৃদ্ধির সূচক ঊর্ধ্বমুখী হবে, এমনটা নয়। বর্তমানে আমাদের দেশের অর্থনীতিতে একটা অস্থির ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। সরকারি আনুকূল্যে পরিকাঠামো, প্রযুক্তি এবং শিল্পে উন্নতি হয়েছে ঠিকই। কিন্তু রিয়্যাল এস্টেট একেবারে ঝিমিয়ে পড়েছে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছে। ফলে পণ্য বিক্রি আর আগের মতো সহজ বা একচেটিয়া হচ্ছে না।’’
গত অগস্টে চিনের শহুরে বেকারত্বের হার ৫.৩ শতাংশে গিয়ে পৌঁছোয়। ঠিক এক মাস আগে, অর্থাৎ জুলাইয়ে এই অঙ্ক ছিল ৫.২ শতাংশ। জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরো অবশ্য এ ব্যাপারে একটা অদ্ভুত যুক্তি দিয়েছে। তাদের দাবি, এই সময়ে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তরের ফলপ্রকাশ করেছে একাধিক কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়। পাশ করার সঙ্গে সঙ্গেই পড়ুয়াদের পক্ষে চাকরি পাওয়া সম্ভব নয়। ফলে বেকারত্বের হার বেশি বলে মনে হচ্ছে।
জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর রিপোর্ট অনুযায়ী, রিয়্যাল এস্টেটের পাশাপাশি প্রবল অস্বস্তির মধ্যে রয়েছে চিনের গাড়ি শিল্পও। গত বছরের তুলনায় এই অগস্টে ড্রাগনভূমিতে গাড়ি বিক্রি বেড়েছে মাত্র ৩.৭ শতাংশ। গ্রামীণ এলাকায় ভোগ্যপণ্যের চাহিদা শহরের তুলনায় বেশি ছিল বলে জানা গিয়েছে। ২০২৪ সালের অগস্টের নিরিখে যেটা এ বার ৪.৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
আর্থিক বৃদ্ধি সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশের পর গণমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেন এনবিএসের মুখপাত্র ফু লিংহুই। তিনি বলেন, ‘‘ভোক্তা মুদ্রাস্ফীতির হার পরিবর্তনশীল পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে কি না তা বলা বেশ কঠিন। তবে এর সূচক যে অস্থির থাকবে, সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত।’’ ফলে আগামী দিনে চিনের ঘরোয়া বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস যে অগ্নিমূল্য হতে চলেছে, তা একরকম স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে।
তবে আশার কথা হল অগস্টে ভোক্তা মুদ্রাস্ফীতির হার ২০২৪ সালের অগস্টের তুলনায় ০.৪ শতাংশ কমেছে। আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, আগামী দিনে চিনা মুদ্রা ইউয়ান আরও কিছুটা দুর্বল হতে পারে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, নাম না করে আমেরিকার শুল্কনীতি যে বেজিঙের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লোকসান ঘটিয়েছে তা স্বীকার করে নিয়েছেন ফু। পাশাপাশি বিশ্ববাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম বৃদ্ধিকেও ঘরোয়া মুদ্রাস্ফীতির জন্য দায়ী করছেন তিনি।
অগস্টে সোনা, রূপা এবং গয়না বিক্রিতে সর্বাধিক বৃদ্ধি দেখেছে চিন। এক বছর আগের তুলনায় এই ক্ষেত্রে বিক্রি বেড়েছে ১৬.৮ শতাংশ। এ ছাড়া খেলাধুলা এবং বিনোদন পণ্যের বিক্রি ১৬.৯ শতাংশ এবং আসবাবের বিক্রি ১৮.৬ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানা গিয়েছে। চাহিদা কমেছে পেট্রোলিয়াম জাত পণ্য, তামাক এবং অ্যালকোহলের।
এ ছাড়া পর্যটন এবং পরিবহণ পরিষেবার ক্ষেত্রেও বৃদ্ধির সূচকে মন্থর গতি লক্ষ করা গিয়েছে। চিনের এই আর্থিক ধাক্কার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সম্পূর্ণ অন্য যুক্তি দিয়েছেন সমীক্ষক সংস্থা ‘গোল্ডম্যান শ্যাক্স’-এর মুখ্য অর্থনীতিবিদ লিশেং ওয়াং। তাঁর দাবি, গৃহস্থালির বিভিন্ন সামগ্রী এবং বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের ক্ষেত্রে এত দিন ভর্তুকি দিচ্ছিল বেজিঙের কমিউনিস্ট সরকার। কিন্তু, রাশ টানতেই বাজারে মন্দা এসেছে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, সব মিলিয়ে চিনের পণ্য নির্বাচন সূচক ৩০০ পয়েন্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। শতাংশের নিরিখে যেটা মাত্র এক। বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, এই মন্দা অবাক করার মতো নয়। চলতি আর্থিক বছরের (২০২৫-’২৬) তৃতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর) সূচকের আরও দুর্বল হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। কারণ, বেজিঙের সঙ্গে নতুন করে বাণিজ্য যুদ্ধের প্রস্তুতি যে ট্রাম্প নিচ্ছেন ইতিমধ্যেই তার ইঙ্গিত মিলেছে।
গত এপ্রিলেই চিনা পণ্যে বিপুল পরিমাণে শুল্ক চাপিয়ে দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। পরে নভেম্বর পর্যন্ত এ ব্যাপারে কিছুটা ছাড় দেন তিনি। কিন্তু তার আগেই পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নিতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ। বর্তমানে রাশিয়ার থেকে অপরিশোধিত খনিজ তেল কেনার ব্যাপারে শীর্ষস্থানে রয়েছে বেজিং। আর তাতেই বেজায় চটেছেন ট্রাম্প।
এই পরিস্থিতিতে চিনের উপর শুল্ক চাপাতে ক্রমাগত ‘গ্রুপ অফ সেভেন’ (জি-৭) এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় সামরিক জোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’ বা নেটোকে (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) ধাক্কা দিতে শুরু করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তাঁর ‘হুকুম’ মেনে নিলে বেজিঙের পণ্যে ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত কর বসাবে নেটো। সে ক্ষেত্রে ইউরোপের বাজারে ব্যবসা করা ড্রাগনের পক্ষে সবচেয়ে কঠিন হবে। ফলে একে কেন্দ্র করে ভূ-রাজনৈতিক সংঘাত তীব্র হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশ্লেষকদের একাংশ।