রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে তৎপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর জন্য আলাস্কায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন তিনি। ১৫ অগস্ট মুখোমুখি হওয়ার কথা রয়েছে দুই ‘সুপার পাওয়ার’ রাষ্ট্রনেতার। এর পরেই বদলে যাবে কিভের ভাগ্য? না কি এ বারও পূর্ব ইউরোপে শান্তি ফেরাতে ব্যর্থ হবেন যুক্তরাষ্ট্রের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা? ট্রাম্প-পুতিন সাক্ষাতের পারদ চড়তেই এই নিয়ে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের দাবি, মার্কিন প্রেসিডেন্টের পক্ষে রাশিয়া-ইউক্রেন লড়াই থামানো মোটেই সহজ নয়। কারণ, কোনও রকম ‘ট্রাম্প-কার্ড’ না নিয়েই ‘বেপরোয়া’ ভাবে পুতিনের সঙ্গে দর কষাকষির টেবিলে বসছেন তিনি। অন্য দিকে, মস্কোর হাতে রয়েছে বড় দাঁও মারার সুযোগ। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের গুপ্তচরবাহিনী কেজিবির এককালের সদস্য তথা ক্রেমলিনের সর্বময় কর্তা সেটা যে ছেড়ে দেবেন না, তা বলাই বাহুল্য।
সংঘাত থামানোর ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই নিজের অবস্থান কিছুটা স্পষ্ট করেছে রাশিয়া। পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনকে দু’টুকরোয় ভেঙে বড় অংশটা নিজের কাছে রাখতে চান পুতিন। সে ক্ষেত্রে ক্রিমিয়া ও পূর্বের ডনবাস এলাকার বাইরেও দেশের মধ্যবর্তী এলাকার জমি মস্কোর হাতে তুলে দিতে হবে কিভকে। পাশাপাশি, কৃষ্ণসাগরের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ যাবে ক্রেমলিনের সেনাকর্তাদের কাছে।
দ্বিতীয়ত, রাশিয়ার কুর্স্ক এলাকার কিছু অংশ কব্জা করে লড়াইয়ের মোড় ঘোরানোর মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কি। যুদ্ধ শেষের শর্ত হিসাবে সেখান থেকে ওই বাহিনীর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার চাইছেন পুতিন। সম্প্রতি, খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ উত্তর-পূর্বের সুমি এলাকার প্রায় পুরোটা দখল করতে সক্ষম হয়েছে মস্কোর ফৌজ। ফলে সেখান থেকে ক্রেমলিনের পিছু হটার কোনও প্রশ্নই নেই, বলছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
পুতিনের এই শর্ত ট্রাম্প মেনে নিলে রাতারাতি বদলাবে পূর্ব ইউরোপের মানচিত্র। শুধু তা-ই নয়, এতে বিপন্ন হবে ইউক্রেনের অস্তিত্ব। দেশটির বিভাজন হয়ে গেলেও যুদ্ধ থামানোর ক্ষেত্রে আরও কিছু শর্ত দিতে পারেন রুশ প্রেসিডেন্ট। তার মধ্যে অন্যতম হল কোনও অবস্থাতেই মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় শক্তিজোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’ বা নেটোর (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) সদস্যপদ নিতে পারবে না সংশ্লিষ্ট কিভের পশ্চিমাংশ।
ইউক্রেনের খনিজ সম্পদের উপরে ‘বেজায় লোভ’ রয়েছে ট্রাম্পের। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সেগুলির দখল নিতে জ়েলেনস্কির সঙ্গে বিশেষ চুক্তি করেন তিনি। কিন্তু যুদ্ধ থামানোর শর্ত হিসাবে সুমি-সহ পূর্ব ইউক্রেনের বিশাল এলাকা পুতিন নিজের দখলে রাখলে মাঠে মারা যাবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সেই স্বপ্ন। ফলে দর কষাকষিতে এটা মেনে নেওয়া ট্রাম্পের পক্ষে বেশ কঠিন, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য মনে করেন, এ ক্ষেত্রে মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে সবচেয়ে বড় কাঁটা হল পশ্চিম ইউরোপ। রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমেরিকাকে বাদ দিলে ইউক্রেনকে প্রথম থেকে বিপুল পরিমাণে হাতিয়ার দিয়ে সাহায্য করেছে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানির মতো দেশ। দক্ষিণ ভূমধ্যসাগর ও বলকান এলাকা এবং উত্তরে নর্ডিক এলাকায় মস্কোর আগ্রাসন মানতে নারাজ তারা। কিভের পতন হলে ক্রেমলিনের সামনে সেই রাস্তা যে খুলে যাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আর তাই আলাস্কার বৈঠকে শান্তি সমঝোতায় জল ঢালতে সরাসরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানির জোট। তার আগাম ইঙ্গিত অবশ্য ইতিমধ্যেই দিয়েছেন মস্কোর রাজদূত কিরিল দিমিত্রিভ। ৯ অগস্ট সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘টেলিগ্রাম’-এ করা একটি পোস্টে তিনি লেখেন, ‘‘প্রেসিডেন্ট পুতিন ও ট্রাম্পের মধ্যে আলোচনা ভেস্তে দিতে কিছু দেশ জটিল প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের আচরণ উস্কানিমূলক এবং বিভ্রান্তিকর।’’ সেই তালিকায় কারা রয়েছে, তা অবশ্য স্পষ্ট করেননি তিনি।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় কাঁটার নাম জ়েলেনস্কি। শান্তি বৈঠকের আগেই একটি ভিডিয়োবার্তায় পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। সেখানে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘‘আমাদের বিরুদ্ধে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে বা কিভকে বাদ দিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে, তা শান্তিপ্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করবে।’’ ফেব্রুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকের পর তাঁকে হাতিয়ার সরবরাহ করায় রাশ টানে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও তাতে লড়াই চালিয়ে যেতে জ়েলেনস্কির বাহিনীর তেমন সমস্যা হয়নি।
গত ফেব্রুয়ারিতে আমেরিকা অস্ত্র দেওয়া বন্ধ করতেই কিভের পাশে এসে দাঁড়ায় ব্রিটেন। ওই সময়ে ট্রাম্পের আপত্তি উড়িয়ে জ়েলেনস্কির হাতে বিপুল হাতিয়ার তুলে দেন ইংরেজ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মার। অন্য দিকে, কিভকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ দিতে ইচ্ছুক ফ্রান্স ও জার্মানি। শান্তিচুক্তির ফর্মুলার উপর তাদের চুপ থাকা বা না থাকার বিষয়টি নির্ভর করবে, বলছেন সাবেক সেনাকর্তারা।
বিশেষজ্ঞদের অনুমান, আলাস্কার বৈঠক সফল করতে হলে রাশিয়ার উপরে থাকা ১৬ হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞার অধিকাংশই প্রত্যাহার করতে হবে ট্রাম্পকে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য ‘সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাঙ্ক ফিন্যানশিয়াল টেলিকমিউনিকেশন’ বা সুইফ্ট সিস্টেমের অন্তর্ভুক্তির দাবি জানাতে পারে মস্কো। যুক্তরাষ্ট্র তাতে রাজি হলে দুরন্ত গতিতে ছুটবে ক্রেমলিনের অর্থনীতি। শক্তি বৃদ্ধি পাবে রুশ মুদ্রা রুবল-এর।
তবে জ়েলেনস্কির পক্ষে রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি সমঝোতা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। গত সাড়ে তিন বছরের যুদ্ধে মস্কোর বিপুল সামরিক সম্পত্তি নষ্ট করেছে তাঁর বাহিনী। সেই তালিকায় রয়েছে কৃষ্ণসাগরে মস্কোভা নামের রণতরী ডুবিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে ড্রোন হামলায় ক্রেমলিনের একগুচ্ছ বোমারু বিমান ধ্বংস। এর হিসাব পুতিন যে কড়ায় গণ্ডায় নিতে পারেন, তা ভালই জানেন তিনি।
অন্য দিকে, পুতিনের শর্তে শান্তি ফিরলে ইউরোপে কমবে আমেরিকার আধিপত্য। এমনকি ভেঙে যেতে পারে নেটো শক্তিজোটও। ওয়াশিংটনের কাছে সেটা হবে সবচেয়ে বড় ধাক্কা। ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য ট্রাম্প এত বড় জুয়া খেলবেন কি না, তা নিয়ে বিশ্লেষকদের মনে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তাঁদের অধিকাংশেরই মত, এর জন্য চালাকি করে নিজেই পুরো ব্যাপারটা কেঁচিয়ে দিতে পারেন বর্ষীয়ান মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
জ়েলেনস্কি থেকে স্টার্মার— এর আগে যখনই কোনও দেশের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে, তখনই তাঁকে নিজের বশে রাখার চেষ্টা করেছেন ট্রাম্প। এটা বার বার তাঁর শরীরী ভাষায় ফুটে উঠেছে। সেই ব্যবহার পুতিন মেনে নেবেন এমনটা নয়। ফলে প্রকাশ্যেই দুই নেতার মতবিরোধ দেখা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে।
আলাস্কায় ইউক্রেন যুদ্ধের ফয়সলা হলে অবশ্য আখেরে লাভ হবে ভারতের। তখন আর খনিজ তেল কিনে রাশিয়াকে লড়াইয়ের জন্য অর্থ জুগিয়ে যাওয়ার মতো বিভ্রান্তিকর অভিযোগ নয়াদিল্লির গায়ে সেঁটে দিতে পারবেন না মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। পরবর্তী পর্যায়ে শুল্ক সরাতে পারেন তিনি। দু’দেশের মধ্যে হতে পারে বাণিজ্যিক চুক্তিও।
উল্টো দিকে বৈঠক ব্যর্থ হলে ভারত ও চিনের উপর আরও বড় শুল্ক চাপিয়ে দিতে পারেন ট্রাম্প। তবে সে ক্ষেত্রে রাশিয়া, ব্রাজ়িল-সহ ‘ব্রিক্স’-ভুক্ত দেশগুলির খোলা সমর্থন থাকবে নয়াদিল্লির দিকে। পাশাপাশি, আলাদা ভাবে পশ্চিম ইউরোপ এবং আফ্রিকার দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তির রাস্তাও খুলে যাবে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের সামনে।
৯ অগস্ট নিজের সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ আলাস্কার বৈঠক নিয়ে একটি পোস্ট করেন ট্রাম্প। সেখানে তিনি লেখেন, ‘‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে আমার ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বৈঠকটি আগামী শুক্রবার, ১৫ অগস্ট অনুষ্ঠিত হবে আলাস্কার গ্রেট ইস্টে।’’
ট্রাম্পের ওই পোস্টের পর মার্কিন আধিকারিকেরা ইউরোপীয় কর্তাব্যক্তিদের স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে, যুদ্ধ বন্ধের জন্য পুতিন বেশ কিছু শর্ত রেখেছেন। এর মধ্যে অন্যতম হল রাশিয়ার জন্য ইউক্রেনের বেশ কিছুটা জমি ছাড়া। এর আগে ট্রাম্পের বিদেশদূতের কাছে একই প্রস্তাব দিয়েছিলেন ক্রেমলিনের সর্বময় কর্তা। যেখানে শর্ত ছিল, পূর্ব ডনবাসের বেশ কিছু অঞ্চল ও ক্রিমিয়া চিরতরে ছাড়তে হবে জ়েলেনস্কিকে।
১৮৬৭ সালের মার্চে রাশিয়ার থেকে জলের দরে আলাস্কা কিনে নেয় আমেরিকা। ওই সময় ছ’লক্ষ বর্গমাইল আয়তনের বিশাল ওই ভূমির জন্য মস্কোকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছিল মাত্র ৭২ লক্ষ ডলার। সেই ইতিহাসিক ঘটনার ১৫৮ বছর পর শান্তির খোঁজে বরফে ঢাকা এলাকাটিতে পা পড়বে যুযুধান দুই ‘সুপার পাওয়ার’ প্রেসিডেন্টের। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এর আগে লড়াই থামাতে পশ্চিমি দেশগুলির ডাকা কোনও বৈঠকেই আমন্ত্রণ পায়নি ক্রেমলিন। আর এ বার পাচ্ছে না ইউক্রেন।
দ্বিতীয় বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার জন্য প্রবল আগ্রহী হয়েছেন ট্রাম্প। এর জন্য প্রকাশ্যেই ভারত-পাকিস্তান-সহ একাধিক দেশের মধ্যে তাঁর উদ্যোগে শান্তি সমঝোতা হয়েছে বলে স্পষ্ট করেছেন তিনি। যদিও তাঁর এই মিথ্যাচারকে উড়িয়ে দিয়েছে নয়াদিল্লি।
রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে শান্তি স্থাপনে সফল হলে একটি বৃত্ত যে ট্রাম্প সফল করতে পারবেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু, তার জন্য ইউরোপীয় ‘বন্ধু’দের হারাতে হতে পারে তাঁকে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমেরিকার গুরুত্ব হ্রাস পাওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য সব কিছু তিনি নিলামে তোলেন কি না, সেটাই এখন দেখার।