১১৫ বছর আগের ‘ঐতিহাসিক ভুল’-এর পুনরাবৃত্তি! ‘মহামন্দা’র আশঙ্কায় ভুগছে ‘সুপার পাওয়ার’ আমেরিকা। এর জন্য এক জনকেই দায়ী করছেন দুনিয়ার তাবড় আর্থিক বিশ্লেষকেরা। তিনি হলেন, স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। শুল্ক নিয়ে তাঁর ‘পাগলামি’ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ছিন্নভিন্ন করতে পারে বলে এ বার সতর্ক করল খোদ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজ়েশন বা ডব্লিউটিও) এবং আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড বা আইএমএফ)।
চলতি বছরের ৮ অগস্ট বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যে ট্রাম্পের বসানো শুল্ক নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে আইএমএফ এবং ডব্লিউটিও। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি সামগ্রীতে গড়ে শুল্কের পরিমাণ ২০.১ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছে। ১৯১০ সালের পর আর কখনওই বিদেশি পণ্যে এতটা শুল্ক চাপায়নি আমেরিকা, যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ওই দুই আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
গত ৭ অগস্ট ভারত-সহ বেশ কয়েকটি দেশের আমদানি পণ্যকে ‘পারস্পরিক শুল্ক’ নীতির আওতায় আনেন ট্রাম্প। ফলে সামগ্রিক ভাবে শুল্ক এক লাফে বেড়ে ২০.১ শতাংশে পৌঁছে যায় বলে জানিয়েছে আইএমএফ এবং ডব্লিউটিও। এ বছরের জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট হিসাবে তিনি শপথ নেওয়ার সময় এই পরিমাণ ছিল মাত্র ২.৪ শতাংশ। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, কুর্সিতে বসেই উচ্চ হারে শুল্ক চাপানোর ক্ষেত্রে মূলত চিন, ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), ব্রাজ়িল এবং মেক্সিকোর পণ্যকে নিশানা করেছেন ট্রাম্প।
২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রথম বার প্রেসিডেন্ট থাকালীন চিনের সঙ্গে শুল্কযুদ্ধে জড়ান ট্রাম্প। ওই সময়ে আমদানি করা পণ্যে গড় শুল্ক ছিল মাত্র তিন শতাংশ। কিন্তু বেজিঙের পণ্যে উচ্চ হারে কর আরোপ হওয়ায় সেটা বেড়ে আট থেকে ন’শতাংশে গিয়ে পৌঁছোয়। কিন্তু, তাতেও দমে গিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করেননি ট্রাম্প। দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসে তিনি যে আক্রমণের ঝাঁজ বাড়িয়েছেন তা বলাই বাহুল্য।
ট্রাম্প মূলত ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম, বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম, গাড়ি, কাপড় এবং অন্যান্য দৈনন্দিন ব্যবহারের সামগ্রীর উপর উচ্চহারে শুল্ক বসিয়েছেন। ভারতীয় পণ্যে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশ। তবে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম, স্মার্টফোন এবং বিরল খনিজ পদার্থকে নতুন শুল্কনীতির বাইরে রেখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট। তাঁর সাফ যুক্তি, কর থেকে বাঁচতে হলে ঘরের মাটিতে পণ্য উৎপাদন করুক আমেরিকার শিল্পপতিরা, যা রাতারাতি কোনও ভাবেই সম্ভব নয় বলে স্পষ্ট করেছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
তথ্য বলছে, ১৯১০ সালে আমদানি করা পণ্যে ২০ শতাংশের বেশি শুল্ক নিত তৎকালীন মার্কিন সরকার। কিন্তু পরবর্তী তিন দশকে সেই সূচক ক্রমান্বয়ে নেমে পৌঁছোয় পাঁচ শতাংশে। গত শতাব্দীর ১৯৩০-এর দশকে ‘মহামন্দা’র ঢেউ আমেরিকায় আছড়ে পড়লে ফের লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে শুল্কের অঙ্ক। ১৯৩৫ সালের মধ্যে সেটা ফের চলে যায় ২০ শতাংশে। তার পর অবশ্য ২০২৫ সাল পর্যন্ত ক্রমাগত নিম্নমুখী থেকেছে এই সূচক।
১৯১০ সালে আমেরিকায় শুল্ক হার বেশি থাকার নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ। প্রথমত, ওই সময়ে বিশ্ব জুড়ে বাণিজ্যিক সম্পর্কে জড়িয়ে ছিল না যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয়ত, ইউরোপের অবস্থা ছিল টালমাটাল। সংঘাতের আশঙ্কায় ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, অটোমান তুরস্ক এবং রাশিয়ার মতো দেশগুলি হাতিয়ার জমা করতে শুরু করে, যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে মাত্র চার বছরের মধ্যে বেধে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ইউরোপের এই অস্থিরতা আমেরিকার আমদানি-রফতানিকে প্রভাবিত করেছিল।
১৯৩০-এর দশকে ‘মহামন্দা’র ঢেউ আমেরিকার বাজারে আছড়ে পড়লে স্মুট-হাওলে শুল্ক আইন পাশ করে মার্কিন ‘কংগ্রেস’ (যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট)। এর উদ্দেশ্য ছিল চাষিদের স্বার্থরক্ষা। আর তাই কৃষি পণ্য-সহ আমদানি করা ২০ হাজারের বেশি সামগ্রীর উপরে চড়া হারে শুল্ক বসিয়ে দেয় ওয়াশিংটন। এর ফল হয়েছিল হিতে বিপরীত। যুক্তরাষ্ট্রের ঘরোয়া বাজারে মুদ্রাস্ফীতির হার চরম সীমায় পৌঁছোয়। ফলে রাতারাতি অগ্নিমূল্য হয়ে যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে ১৯৪০-এর দশকে ধীরে ধীরে স্মুট-হাওলে শুল্ক আইন থেকে সরে আসেন মার্কিন রাজনীতিবিদেরা। এতে আমেরিকার আমজনতা স্বস্তি পেয়েছিল। লড়াই থামলে ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে কার্যকর হয় ‘শুল্ক ও বাণিজ্য সংক্রান্ত সাধারণ চুক্তি’ বা গ্যাট (জেনারেল এগ্রিমেন্ট অফ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ)। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শুল্ক হ্রাসই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। ১৯৯৫ সালে এর স্থলাভিষিক্ত হয় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বা ডব্লিউটিও।
গত কয়েক দশকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং বিশ্বের অর্থনৈতিক গতিকে ঊর্ধ্বমুখী করার নেপথ্যে গ্যাট এবং ডব্লিউটিও-র বড় ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু ট্রাম্পের জন্য সেই ছন্দে পুরোপুরি তাল কাটার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না আর্থিক বিশ্লেষকেরা। তাঁদের দাবি, মার্কিন প্রেসিডেন্টের ‘খামখেয়ালি’ নীতির জন্য বিশ্ব জুড়ে বেধে যেতে পারে বাণিজ্যিক যুদ্ধ। এতে নামবে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্টস) সূচক। দেখা দিতে পারে খাদ্যসঙ্কট।
এ ছাড়াও বেকারত্বের হার হু-হু করে বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই আর্থিক ধাক্কা থেকে বাঁচবে না আমেরিকাও। আর তাই ডব্লিউটিও-র জারি করা সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, ট্রাম্প ‘বাড়াবাড়ি’ বন্ধ না করলে আগামী দিনে স্বাভাবিক ভাবেই অন্যান্য দেশ আমদানি করা মার্কিন পণ্যে উঁচু হারে চাপাবে শুল্ক। তাতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির গোড়ায় ‘কুড়ুলের কোপ’ পড়তে পারে।
দ্বিতীয়ত, ট্রাম্পের শুল্কনীতির জন্য আগামী দিনে ভারত ও চিনের মতো শত্রুভাবাপন্ন দু’টি দেশের আরও কাছাকাছি আসার সম্ভাবনা রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, আমেরিকাকে বাদ দিয়ে নতুন বাজার পেতে অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি সেরে ফেলতে পারে নয়াদিল্লি। সে ক্ষেত্রে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় ‘বিশ্বস্ত বন্ধু’কে হারাবে ওয়াশিংটন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একঘরে হয়ে যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।
তৃতীয়ত, ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধের জেরে ‘ব্রিক্স’-ভুক্ত দেশগুলির মধ্যে গড়ে উঠছে শক্তিশালী সমন্বয়। এই আন্তর্জাতিক সংগঠনটিতে রয়েছে ভারত-সহ মোট ১০টি দেশ। ইতিমধ্যেই ‘ব্রিক্স’-এর অন্যতম সদস্য ব্রাজ়িলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা আমেরিকার শুল্ক মোকাবিলায় ফোনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে কথা বলেছেন। আগামী দিনে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যচুক্তি হওয়ার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না কেউই।
এ বছরের অগস্টের গোড়ায় ‘সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা’ বা এসসিও-র (সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজ়েশন) বৈঠকে যোগ দিতে চিন সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। কিছু দিনের মধ্যেই ভারতে আসার কথা রয়েছে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের। এ ছাড়া নয়াদিল্লি আসার কথা সমাজমাধ্যমে পোস্ট করে জানিয়েছেন ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।
ট্রাম্পের চাপানো শুল্ক নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে জাপান, কানাডা এবং ইইউ-এর মতো আমেরিকার ‘বন্ধু’ রাষ্ট্রগুলির। ফলে এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে তাদের সঙ্গে সম্পর্কে চিড় ধরতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের। এ ছাড়া পশ্চিম এশিয়ার আরব দেশগুলিও আমেরিকার উপরে খুশি নয়। সংযুক্ত আরব আমিরশাহির প্রধানমন্ত্রীকে তো ইতিমধ্যেই রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দেখা গিয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের শুল্ক নিয়ে ‘পাগলামি’র কড়া সমালোচনা করেছেন আমেরিকার সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বা এনএসএ (ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইসার) জন বোল্টন। ট্রাম্পের প্রথম কার্যকালের মেয়াদে ওই পদে ছিলেন তিনি। সিএনএন-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বোল্টন বলেছেন, ‘‘ভারতকে রাশিয়া ও চিনের থেকে দূরে রাখার চেষ্টা দীর্ঘ দিন ধরে করা হয়েছে। সদ্য সেই কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় সাফল্য পেয়েছিল ওয়াশিংটন। কিন্তু জল ফের সম্পূর্ণ উল্টো দিকে বইতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রকে এর মূল্য চোকাতে হবে।’’
যদিও যাবতীয় সতর্কবার্তা বা সমালোচনাকে গায়েই মাখছেন না ট্রাম্প। উল্টে তাঁর যুক্তি ‘সঠিক’ শুল্কনীতি নেওয়ার কারণেই চাঙ্গা রয়েছে মার্কিন শেয়ার বাজার। সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধিতেও এটি অনুঘটকের কাজ করছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের আদালত যদি তাঁর শুল্ক-সিদ্ধান্তের উপর স্থগিতাদেশ জারি করে, তা হলে সেটা হবে অত্যন্ত হতাশাজনক। এ ব্যাপারে ১৯২৯ সালের ‘মহামন্দা’র প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন তিনি, যার আঘাত টানা ১০ বছর সহ্য করতে হয়েছিল আমেরিকাকে।
গত ৮ অগস্ট নিজের সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ এই ইস্যুতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ পোস্ট করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। সেখানে তিনি লেখেন, ‘‘শুল্কবৃদ্ধি শেয়ার বাজারে বিরাট ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। প্রায় প্রতি দিনই নতুন নতুন রেকর্ড তৈরি হচ্ছে। ফলে শয়ে শয়ে ডলার সরকারি কোষাগারে ঢুকছে।’’ যদিও তাঁর এই ব্যাখ্যাকে ‘সম্পূর্ণ ভুল’ বলে দাবি করেছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ট্রাম্প যে আর্থিক লাভের কথা বলছেন, সেটা আসছে আমেরিকাবাসীদের পকেট থেকেই। তাঁরই চাপানো শুল্কের জন্য অনেক পণ্যকেই বেশি দামে কিনতে হচ্ছে তাঁদের। এতে মার্কিন বাজারে মুদ্রাস্ফীতির হার দ্রুত গতিতে ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে বলে স্পষ্ট করেছেন তাঁরা।
ভারতের ক্ষেত্রে শুল্ক সংঘাত না মিটলে বাণিজ্যচুক্তি সম্ভব নয় বলে বিবৃতি দিয়েছেন ট্রাম্প। প্রাক্তন এনএসএ বোল্টনের দাবি, এতে দুই দেশের তিক্ততা বাড়ছে। ইতিমধ্যেই রাশিয়া ও চিনের অনেকটা কাছাকাছি চলে গিয়েছে নয়াদিল্লি। সেখান থেকে মোদী সরকারকে ‘ইউ টার্ন’ নিতে বাধ্য করা বেশ কঠিন। দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কে এর ছাপ থাকবে বলে জানিয়েছেন তিনি।