যে কোনও দেশ আর্থিক ভাবে কতটা শক্তিশালী তা সেই দেশের বৈদেশিক মু্দ্রাভান্ডারের উপর নির্ভর করে। সেই বিদেশি মু্দ্রাভান্ডারের একটি অংশ জুড়ে থাকে হলুদ ধাতু। বহু শতাব্দী ধরেই এই ধাতব সম্পদটি নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে বিশ্ব জুড়ে পরিচিত। ঔজ্জ্বল্য এবং ক্রমবর্ধমান মূল্যের কারণে বিশ্ব জুড়ে সোনা আদৃত। সমস্ত দেশেই সোনাকে এমন গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যে, অন্য কোনও ধাতু এর ধারেকাছে আসতে পারেনি।
সোনাকে সম্পদ ও ক্ষমতার প্রতীক বলে ধরা হয়। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সোনা মজুত রয়েছে আমেরিকার ফেডেরাল রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কে। সোনা কিনে ভান্ডার ভরানোর নিরিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সমস্ত দেশকে টেক্কা দিয়েছে। তবে মাটির নীচে সবচেয়ে বেশি সোনার মজুতদার কিন্তু আমেরিকা নয়, অন্য একটি দেশ।
খনি থেকে পাওয়া সোনার সঞ্চয়ের বেশির ভাগই রয়েছে শীর্ষ পাঁচটি দেশের হাতে। যদি তা উত্তোলন করা হয় তবে এর মূল্য দাঁড়াবে কয়েক লক্ষ কোটি ডলার। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রায় ২ লক্ষ ৩৮ হাজার ৩৯১ মেট্রিক টন সোনা ইতিমধ্যেই উত্তোলন করা হয়েছে। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার অনুমান, পৃথিবীতে এখনও পর্যন্ত ৭০ হাজার ৫৫০ মেট্রিক টন সোনা রয়েছে যা উত্তোলন করা সম্ভব।
এই সম্ভাব্য পরিমাণ নিয়ে অবশ্য কিছুটা দ্বিমত প্রকাশ করেছে ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল। সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে সোনার মজুতের পরিমাণ ৬০ হাজার ৩৭০ মেট্রিক টন। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের মতে, ১ লক্ষ ৪৫ হাজার ৬২৬ টন সোনা ভূপৃষ্ঠে লুকিয়ে থাকতে পারে। তবে এই সঞ্চিত ভান্ডার থেকে সমস্ত সোনা উত্তোলনের সম্ভাবনা বেশ কম বলে জানিয়েছে কাউন্সিল।
খনি থেকে প্রাপ্ত সোনা এবং সারা বিশ্বের দেশগুলির হাতে মজুত হলুদ ধাতু যোগ করলে দেখা যাবে, মোট ২ লক্ষ ৭৭ হাজার টন থেকে প্রায় ৩ লক্ষ টন সোনায় পরিপূর্ণ এই গ্রহ। এই সোনার বেশির ভাগই চিন, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা এবং দক্ষিণ আফ্রিকা-সহ মাত্র কয়েকটি দেশের খনি থেকে পাওয়া যায়। খনি থেকে উদ্ধার না হওয়া সোনার সবচেয়ে বড় মজুত রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় পাওয়া যায়।
এই সমস্ত দেশগুলিতে বিশাল ভূগর্ভস্থ ভান্ডার রয়েছে। মাটির নীচে লুকিয়ে থাকা সোনার নিরিখে অস্ট্রেলিয়া প্রধান পাঁচটি দেশের মধ্যে শীর্ষস্থান দখল করে রেখেছে। ১২ হাজার মেট্রিক টনের বেশি সোনা জমা রয়েছে দেশটির ভূর্গভে। মূল্য ৭২ হাজার কোটি ডলার।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধান খনিগুলি মূলত সে দেশের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত। সুপার পিট, ক্যাডিয়া এবং বোডিংটনেই জমা রয়েছে সোনার আকরগুলি। খনিতে সোনা জমার নিরিখে অস্ট্রেলিয়া ‘ফার্স্ট বয়’ হলেও উৎপাদনের নিরিখে ক্যাঙারুর দেশ তৃতীয়। ২০২৩ সালে দেশটি ১২ হাজার টন সোনা উৎপাদন করেছে। হলুদ ধাতুর রফতানিকারক দেশগুলির মধ্যে অন্যতম শীর্ষস্থানীয় এটি। রফতানির মধ্যে ৫০ শতাংশই সোনা। দেশটির জিডিপিতেও উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে কাঞ্চনের।
অস্ট্রেলিয়ার পর রয়েছে রাশিয়া। ২০২৩ সালে ১১ হাজার ১০০ টন সোনা উৎপাদন করে সেই দেশ। ২০১০ সাল থেকে এটি এখনও ইউরোপের শীর্ষ সোনা সরবরাহকারী দেশ হিসাবে নিজের জায়গা পাকা করে রেখেছে। রাশিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত সোনার খনিগুলির মধ্যে রয়েছে সাইবেরিয়ার অলিম্পিয়াডা খনি। এই খনিটি দেশের বৃহত্তম স্বর্ণখনি।
খনিতে পাওয়া সোনার মজুতে রাশিয়া অস্ট্রেলিয়ার সমান। পুতিনের দেশেও প্রায় ১২ হাজার মেট্রিক টন অব্যবহৃত সোনা রয়েছে। সুখয় লগ এবং অলিম্পিয়াডার মতো খনিগুলিতে সঞ্চিত সোনা রাশিয়াকে তালিকায় এগিয়ে রেখেছে। বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও, রাশিয়ার সোনার মজুত একটি কৌশলগত সম্পদ। ব্লাগোডাটনয়ে, নাটালকা, কুপোল, ডভোইনয়ে এবং ভার্নিনস্কয়ের মতো অন্যান্য খনিগুলি থেকে বিপুল পরিমাণে সোনা উত্তোলিত হয়।
দক্ষিণ আফ্রিকায় ৩ হাজার ২০০ মেট্রিক টনেরও বেশি সোনা মাটির নীচে অবশিষ্ট আছে। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলিতে মহাদেশটিতে উৎপাদন কমে গেছে। একসময় ‘সোনার খনির রাজা’ বলে পরিচিত উইটওয়াটারস্র্যান্ড বেসিনে এখনও যা সোনা জমে রয়েছে তা বিস্ময়ের উদ্রেক ঘটায়।
প্রায় ৩ হাজার মেট্রিক টন মাটিতে থাকা সোনার মজুত নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চতুর্থ স্থান ধরে রেখেছে। নেভাদা বলয়ের বিস্তীর্ণ খনি অঞ্চলের প্রধান সোনার খনিগুলির মধ্যে রয়েছে গোল্ডস্ট্রাইক খনি (সবচেয়ে বড় খনিগুলির মধ্যে একটি)। এ ছাড়াও রয়েছে কর্টেজ, কার্লিন, ফিরোজা রিজ, ফিনিক্স এবং লং ক্যানিয়ন-এর মতো অন্যান্য খনি। ২০২৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৩ হাজার টন সোনা উৎপাদন করেছিল।
এত বিপুল পরিমাণ উত্তোলনের নেপথ্যে রয়েছে নেভাদা এবং কলোরাডো। এই দুই রাজ্যের সোনার উৎপাদন বৃদ্ধি। ২০২১ সালে নেভাদার একারই আমেরিকান সোনা উৎপাদনে ৭৮ শতাংশ অবদান ছিল। আলাস্কার মতো অন্যান্য অঞ্চলও এই উৎপাদনে হাত মিলিয়েছে। এই কারণে দেশটি ২০২১ সালে ৯০০ কোটি ডলারের সোনা রফতানি করতে সক্ষম হয়েছিল।
এশিয়ার ক্ষুদ্র দেশ। খনিতে সোনা মজুতের নিরিখে চিনকেও টপকে গিয়েছে। ২ হাজার ৬০০ মেট্রিক টনের ভান্ডার নিয়ে তালিকায় পাঁচ নম্বর স্থান দখল করে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া। বিশাল ভূগর্ভস্থ সোনার ভান্ডার রয়েছে সে দেশের পাপুয়া প্রদেশে অবস্থিত ‘গ্রাসবার্গ কমপ্লেক্স’ খনিটিতে। বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম সোনা এবং তামার খনি এটি। এই খনির মধ্যে একটি সম্পূর্ণ আবাসিক এলাকাও রয়েছে, যেখানে কর্মীদের জন্য স্কুল ও হাসপাতাল-সহ অন্যান্য সুবিধাও রয়েছে।
দেশটি ২০২৩ সালে ২ হাজার ৬০০ টন সোনা উৎপাদন করেছিল। দেশের অন্য গুরুত্বপূর্ণ খনিগুলি হল ডিপ মিল লেভেল জ়োন এবং মার্টেবল খনি।দেশটি ২০২৩ সালে ২ হাজার ৬০০ টন সোনা উৎপাদন করেছিল। দেশের অন্য গুরুত্বপূর্ণ খনিগুলি হল ডিপ মিল লেভেল জ়োন এবং মার্টেবল খনি।
ভূত্বকের নীচে হাজার হাজার টন সোনার সন্ধান পাওয়া গেলেও এটি পৃথিবীতে জমে থাকা সোনার একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন এই গ্রহের প্রায় ৯৯ শতাংশ সোনা আমাদের নাগালের বাইরেই পড়ে রয়েছে। ভূপৃষ্ঠের গভীরে চাপা পড়ে আছে সেই কুবেরের সম্পদ। ভূতত্ত্ববিদদের একাংশের মতে পৃথিবীর ভূত্বকে ৪৪.১ কোটি টন পর্যন্ত সোনা লুকিয়ে থাকতে পারে। এর বেশির ভাগটাই পাথর এবং সমুদ্রের জলে ক্ষুদ্র কণার আকারে মিশে আছে।
কেবলমাত্র সমুদ্রের জলেই ২ কোটি টন বা তার বেশি সোনা লুকিয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা ভূ-বিজ্ঞানীদের। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই সোনার মূল্য ২ কোয়াড্রিলিয়ন ডলার হতে পারে। অর্থাৎ, প্রায় ২০০০০০০০০ কোটি ডলার। সেই মূল্য যে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে তা বলাই বাহুল্য।