১৯৯৯-এ প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা শুরু করেন। ২০০৩ সালে বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৬ উইকেট নেন তিনি। ২০১১-এ ভারতকে বিশ্বকাপ জেতানোর অন্যতম কান্ডারি। দেশের হয়ে ১৭টি টেস্ট ম্যাচ, ১২০টি একদিনের ম্যাচ, ২৭টি টি২০ ম্যাচ— মোট ১৬৪টি ম্যাচ খেলেছেন ভারতের অন্যতম সেরা বাঁহাতি পেসার আশিস নেহরা।
১৯৭৯ সালের ২৯ এপ্রিল দিল্লির ক্যান্টনমেন্টের সদরবাজারে জন্ম। সলওয়ান পাবলিক স্কুলে পড়েছেন আশিস। বাবা দীপ সিংহ নেহরা, মা সুমিত্রা নেহরা এবং ছোট ভাই বিকাশ নেহরাকে নিয়ে পরিবার ছিল আশিসের। বিয়ে করেন রুশ্মা নামের এক তরুণীকে। তাঁদের দু’টি সন্তান রয়েছে, আরুশ ও আয়রা।
আশিসের বাবা দিল্লি রাজ্য নাগরিক সরবরাহ বিভাগে কাজ করতেন। সরকারি চাকরি হলেও আয় যে খুব বেশি ছিল তেমনটা নয়। তা সত্ত্বেও আশিসের বাবা-মা কখনওই তাঁদের ছেলেদের দারিদ্র অনুভব করতে দেননি। বাবা বরাবরই আশিসকে উৎসাহ দিতেন খেলাধুলার জন্য।
দিল্লির সনেট ক্রিকেট ক্লাবে ক্রিকেট খেলা শুরু করেছিলেন আশিস। সেখানে কোচ হিসাবে পেয়েছিলেন তারক সিংহকে। সেখানে হাতেখড়ির পর দিল্লি দলের হয়ে রঞ্জি ট্রফিতে খেলার সুযোগ পান। সেখানেই বাঁহাতি এই বোলার নজরে আসেন নির্বাচকদের। তার পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে।
সনেট ক্রিকেট ক্লাব থেকেই আশিস নেহরা, আকাশ চোপড়া, অঞ্জুম চোপড়া, শিখর ধওয়ানের মতো ক্রিকেটারের জন্ম। ছাত্রেরা ‘ওস্তাদজি’ ডাকতেন ওই ক্লাবের কোচকে।
নিজের প্রথম গুরুকে বাড়িওয়ালা ঘর ছাড়তে বলায় আশিস তাঁকে বাড়ি কিনে দিয়েছিলেন। সাংবাদিক বিজয় লোকপল্লির লেখা বইয়ে জানা গিয়েছে আশিসের এই বাড়ি কিনে দেওয়ার কথা।
২০০০ সালের কথা, বাড়ি খোঁজার কারণে প্রায়ই দেরি করে অনুশীলনে যেতেন আশিস। একদিন দেরি করে অনুশীলনে যাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করেন কোচ। উত্তরে তাঁর হাতে বাড়ির চাবি ধরিয়ে দেন আশিস। জানান, কোচের জন্য বাড়ি কিনেছেন তিনি। তারকের যাতে কোনও সমস্যা না হয়, সেই কারণেই তাঁকে বাড়ি কিনে দিয়েছিলেন নেহরা।
১৯৯৯ সালে টেস্টে অভিষেক আশিসের। কলম্বোয় শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে খেলেছিল ভারত। যদিও সেই ম্যাচ ড্র হয়। এর পর ২০০১-এ প্রথম ওয়ান ডে ম্যাচ। ভারত বনাম জ়িম্বাবোয়ের সেই ম্যাচে জয়ী হয়েছিল ভারত। যদিও আশিস পেসার হিসাবে তাক লাগিয়েছিলেন ২০০৩-এর বিশ্বকাপে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে একাই ২৩ রানে ৬টি উইকেট নেন আশিস।
খেলতে গিয়ে প্রায়ই নানা রকম চোট ও আঘাত পেতেন। এই কারণে মাঝেমধ্যেই খেলা থেকে দূরে থাকতেন তিনি। আইপিএলে ৫টি দলের হয়ে মোট ৮৮টি ম্যাচ খেলেছেন। খেলার জীবনে শুরুর চেয়ে শেষ দিকে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন আশিস।
২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেন আশিস। ২০১৮-য় আরসিবি ( রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু)-তে কোচিং শুরু করেন তিনি। ২০২২-এ গুজরাত টাইটান্সে প্রধান কোচের পদে নিযুক্ত হন। ওই বছরই কোচ হিসাবে দলকে আইপিএল জিতিয়েছিলেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় কোচ, যিনি আইপিএলে দলকে জয়ের মুকুট এনে দিয়েছেন।
মধ্যবিত্ত পরিবারে বড় হওয়া আশিস আজকের দিনে বহু কোটির মালিক। ক্রীড়াজীবনে বহু বার ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়েছেন। কিন্তু কখনও হার মানেননি এই বাঁহাতি বোলার।
এক সাক্ষাৎকারে আশিস জানিয়েছিলেন, শুরুতে নোকিয়ার মুঠোফোন ব্যবহার করতেন। আইফোন কেনেন বহু দিন পরে। সমাজমাধ্যমে নিজেকে জাহির করতে তেমন পছন্দ করেন না তিনি। বেশ দেরিতেই হোয়াট্সঅ্যাপ ব্যবহার করতে শিখেছেন। সাক্ষাৎকারে তিনি এটাও জানিয়েছিলেন যে, তাঁর স্ত্রীই তাঁর হয়ে ইমেল করা-সহ সমাজমাধ্যমের অন্যান্য কাজ করে দেন।
বর্তমানে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে গোয়ায় এক বিলাসবহুল বাড়িতে থাকেন আশিস। সমুদ্রের কাছে থাকা এই বাসস্থানের দাম প্রায় ২০ কোটি টাকা। বাড়ির অন্দরসজ্জা চোখধাঁধানো। বড় বসার ঘর, সুইমিং পুল, বিশাল বাগান ও অতিথিদের থাকার জন্য আলাদা ব্যবস্থাও রয়েছে ওই বাড়িতে।
আশিসের কাছে যে সব গাড়ি রয়েছে সেগুলির মোট দাম দু’থেকে তিন কোটি টাকা। রয়েছে ‘অডি কিউ ৫’, যার বাজারমূল্য প্রায় ৬৫ থেকে ৭০ লক্ষ টাকা। এ ছাড়াও ৫০ লক্ষ টাকার ‘বিএমডব্লিউ থ্রি সিরিজ়’, এক কোটি টাকার ‘মার্সিডিজ বেঞ্জ’ও রয়েছে। পরিবারের ব্যবহারের জন্য রয়েছে ২৫ লক্ষ টাকার ‘টয়োটা ইনোভা’।
২০২৪ সাল পর্যন্ত পাওয়া হিসাব অনুযায়ী আশিস নেহরা প্রায় ৭১ কোটি টাকার মালিক। তথ্য অনুযায়ী, শুধু কোচিং থেকেই বছরে প্রায় ৩.৫ কোটি টাকা অর্জন করেন তিনি। এ ছাড়াও ভারতীয় ক্রিকেট নিয়ন্ত্রণ বোর্ড (বিসিসিআই) থেকে মাসে প্রায় ৭০ হাজার টাকা পেনশন পান। এক একটি বিজ্ঞাপন থেকে আয় এক কোটি টাকার উপরে। এ ছাড়াও আইপিএলে ধারাভাষ্যকার হিসাবে আশিস কয়েক কোটি টাকা আয় করেছেন। রয়েছে নিজস্ব জিম এবং ফিটনেস সেন্টারও। সব মিলিয়ে তাঁর বার্ষিক আয় ৫ কোটি টাকা।
কোটি কোটি টাকা উপার্জনকারী আশিস অবসরে নিজের পরিবারের সঙ্গে কাটাতে পছন্দ করেন। মুঠোফোনে বা সমাজমাধ্যমে বেশি সময় কাটানোর চাইতে সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটাতে বেশি ভালবাসেন তিনি। এ ছাড়াও সময় কাটে জিম কিংবা সুইমিং পুলে।
২০১৭ সালে বিবিসি হিন্দিতে এক সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় আশিস জানিয়েছিলেন, আইপিএল খেললে একটা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আসে। দীর্ঘ ক্রিকেটজীবনে দল থেকে বেশ কিছু ডাকনাম অর্জন করেছেন আশিস। ড্রেসিং রুম থেকে খেলার মাঠ— আশিস পরিচিত ‘পোপট’, ‘নেহরাজি’, ‘মিস্টার গ্লাস’ ইত্যাদি নামে।