মধ্য কলকাতার ১ নম্বর গার্স্টিন প্লেস। রেডিয়োর ইতিহাসে কালজয়ী অনুষ্ঠান ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’র জন্ম এখানেই। এককালে এখানেই ছিল কলকাতার বেতারকেন্দ্র। এখন কেমন আছে সেই বাড়ি?
আজ আর গার্স্টিন প্লেসে গিয়ে সেই বাড়িটার খোঁজ পাওয়া যায় না। কিন্তু কোনও স্মৃতিচিহ্নই কি নেই? ২ নম্বর গার্স্টিন প্লেসের নিরাপত্তাকর্মী অরুণকুমার সিংহ বলেন, ‘‘আর কিছু নেই।’’ পুরনো ভবন ভেঙে ফেলা হয়েছে সেই কবে! অরুণজির হিসাবে, ২৫ বছর আগে।
এখন কী আছে সেখানে? পুরনো বেতারকেন্দ্রের জায়গায় তৈরি হয়েছে বহুতল। ১ থেকে ৩ গার্স্টিন প্লেস, সব ক’টাই নতুন ইমারত। সেই আমলের স্মৃতি আগলে এখনও আছে ৪ নম্বর বাড়িটা। এখন অবশ্য গোটাটাই ধ্বংসস্তূপ। ছাদ নেই, ভিতরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ভাঙা জানলা-দরজা আর কড়ি-বরগা। উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখা যায় সেন্ট জোন্স গির্জার চূড়া।
ব্যাঙ্কশাল আদালতের উল্টো ফুটপাতে, হেয়ার স্ট্রিট থেকে বাঁ দিক ঘুরলেই গার্স্টিন প্লেস। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মেজর জেনারেল জন গার্স্টিনের নামে রাস্তার নাম। গোটা পাঁচেক বাড়ি মিলিয়ে গার্স্টিন প্লেস, ছোট্ট অফিসপাড়া। আইনজীবীদের আনাগোনা, রয়েছে একাধিক ল ফার্ম। গার্স্টিন প্লেসের বাড়িগুলির পিছনেই সেন্ট জোন্স গির্জা। পলাশির যুদ্ধের আগে এই ছোট অফিসপাড়া আর ওই গির্জা, দুটোর কোনওটাই ছিল না।
আজ যেখানে গার্স্টিন প্লেস, পলাশির যুদ্ধের সময় সেখানে ছিল হাসপাতাল। পিছনের গির্জার জমিতে ছিল গোরস্থান। আরও খানিক দূরে, মহাকরণের পাশে, আজ যেখানে সেন্ট অ্যান্ড্রুজ গির্জা। সেখানে ছিল আদালত। যে আদালত মহারাজা নন্দকুমারকে ফাঁসি দিয়েছিল। ওই আদালতের নামেই সামনের রাস্তার নাম ওল্ড কোর্ট স্ট্রিট।
পরবর্তী কালে গোরস্থান উঠে যায়। ভাঙা পড়ে হাসপাতাল। ভাঙা হয় সেই কুখ্যাত আদালত। ভাঙা আদালতের নির্মাণসামগ্রী নিয়েই হেয়ার স্ট্রিট আর চার্চ লেনের পাশে খান পাঁচেক ভবন গড়ে তোলেন মেজর জেনারেল গার্স্টিন। জায়গাটার নাম হয়ে যায় গার্স্টিন প্লেস, আর বাড়িগুলোকে বলা হত গার্স্টিন বিল্ডিংস। দেখতে আহামরি নয়, সাদামাঠা ভবন। ভাড়া দেওয়া হত অফিস।
সাল ১৯২৭, মাস অগস্ট— ১ নম্বর গার্স্টিন প্লেসে বেতারকেন্দ্র খুলল ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি। একে একে যোগ দিলেন বাণীকুমার (বৈদ্যনাথ) ভট্টাচার্য, পঙ্কজকুমার মল্লিকেরা। বছর দশেক পর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
১৯৩৭, মহালয়ার ভোর ৪টেয় প্রথম বার রেডিয়োয় বেজে ওঠে ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’। বাণীকুমারের লেখায় পঙ্কজকুমার মল্লিকের সুর। স্তোত্রপাঠে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। ১৯৩৭-এর আগেও অনুষ্ঠান হয়েছে। কখনও ‘শারদীয় বন্দনা’, কখনও ‘মহিষাসুর বধ’ নামে, ষষ্ঠীর ভোরে। পরের ২০ বছর এখান থেকেই সম্প্রচার। তিন মাসের মহড়া শেষে লাইভ অনুষ্ঠান।
প্রথম দিকে চণ্ডীপাঠের সংস্কৃত উচ্চারণ তরুণ বীরেন্দ্রকৃষ্ণের খটোমটো লাগত। উচ্চারণ ঠিক করার তালিম দিলেন পণ্ডিত অশোকনাথ শাস্ত্রী। এই মানুষটাই বাণীকুমারকে অনুষ্ঠানের স্ক্রিপ্ট লিখতেও সাহায্য করেছিলেন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ছিলেন কায়স্থ। তাই গোঁড়া ব্রাহ্মণ সমাজের আপত্তি ছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণের স্তোত্রপাঠে। আপত্তি ছিল আরও একটা বিষয়েও। মহালয়ার অনুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্রে ছিলেন একাধিক মুসলমান— সারেঙ্গি বাজাতেন মুন্সি, চেলোয় আলি, হারমোনিয়ামে খুশি মহম্মদ। ছিলেন খ্রিস্টান শিল্পীরাও। সে সব আপত্তি ধোপে টেকেনি। ঝড়ঝাপটা সব সামলে নিতেন কলকাতার বেতার কেন্দ্রের দুই স্তম্ভ— বাণীকুমার আর পঙ্কজ মল্লিক।
প্রায় ১০০ বছর ধরে বেজেই চলেছে সেই সুর। এমন কালোত্তীর্ণ অনুষ্ঠান বিশ্ব রেডিয়োর ইতিহাসে বিরল। তাই ‘মহিষাসুরমর্দ্দিনী’কে কেউ কেউ বলেন ‘হাওয়ার তাজমহল’। একঘেয়েমি কাটাতে প্রতি বছর স্ক্রিপ্টে কিছু না কিছু বদল করা হত। ১৯৬২ সাল থেকে লাইভ অনুষ্ঠানে দাঁড়ি পড়ে। এখন মহালয়ার ভোরে যে আলেখ্য বাজে, সেটি যাট ও সত্তরের দশকের কয়েকটি অনুষ্ঠানের সঙ্কলন।
এরই মাঝে আকাশবাণী কলকাতা উঠে আসে ইডেন গার্ডেন্স স্টেডিয়ামের পাশের নতুন ভবনে। ১ নম্বর গার্স্টিন প্লেসের সেই বাড়িটা আজ আর নেই। নেই তার কোনও চিহ্নও। কলকাতার একটি হেরিটেজ হারিয়ে গিয়েছে চিরতরে।