India-Japan Fighter Jets

মোদীর আহ্বানে আদা-জল খেয়ে জেট ইঞ্জিন তৈরিতে মন! বুলেট ট্রেনের কায়দায় জাপানি প্রযুক্তিতে যুদ্ধবিমান বানাবে ভারত?

সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে লড়াকু জেটের ইঞ্জিন তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আর তাই জাপানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়বেন এ দেশের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা? তুঙ্গে জল্পনা।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১৭ অগস্ট ২০২৫ ০৭:৫৩
Share:
০১ ২০

এ বার ঘরের মাটিতে জেট ইঞ্জিন তৈরি করুক ভারত। স্বাধীনতা দিবসে লালকেল্লা থেকে দেওয়া ভাষণে সেই আহ্বান জানান স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে ইতিমধ্যেই কোমর বেঁধে লেগে পড়েছেন এ দেশের প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। শুধু তা-ই নয়, এ ব্যাপারে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্র জাপানের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে পারে নয়াদিল্লি, খবর সূত্রের।

০২ ২০

সংবাদসংস্থা ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এত দিন যৌথ উদ্যোগে লড়াকু জেটের ইঞ্জিন তৈরির জন্য কেবলমাত্র ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের সাহায্য চাইছিল ভারতীয় প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও (ডিফেন্স রিসার্চ ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজ়েশন)। কিন্তু সম্প্রতি এ ব্যাপারে জাপান আগ্রহ প্রকাশ করায় ওই নীতিতে এসেছে বড় বদল। যদিও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অনুমোদন নিতে হবে ডিআরডিও-কে।

Advertisement
০৩ ২০

এ দেশের প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে লড়াকু জেটের ইঞ্জিন তৈরিতে যথেষ্ট আগ্রহী গাড়ি নির্মাণকারী কিংবদন্তি ব্রিটিশ সংস্থা রোলস-রয়েস। এ ছাড়া ফরাসি প্রতিরক্ষা কোম্পানি সাফরানও নয়াদিল্লিকে দিয়েছে প্রায় একই রকমের ‘মেগা অফার’। সূত্রের খবর, দু’টি সংস্থার সঙ্গেই আলোচনা চালাচ্ছে কেন্দ্র। তাদের প্রস্তাব মূল্যায়ন করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক।

০৪ ২০

দ্য ফিন্যানশিয়াল টাইমস জানিয়েছে, এই দৌড়ে এ বার ঢুকে পড়েছে জাপানও। সূত্রের খবর, ডিআরডিও বা কোনও বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যৌথ ভাবে জেট ইঞ্জিন বানাতে আগ্রহী ‘মিৎসুবিশি হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ়’। তবে এ ব্যাপারে টোকিওর থেকে খোলাখুলি ভাবে কোনও প্রস্তাব কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার পেয়েছে কি না, তা স্পষ্ট নয়।

০৫ ২০

১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত চলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে প্রতিরক্ষা শিল্পে অভূতপূর্ব উন্নতি করে প্রশান্ত মহাসাগরীয় ওই দ্বীপরাষ্ট্র। লড়াইয়ের বছরগুলিতে লড়াকু জেট এবং বোমারু বিমান— দুটোই বিপুল সংখ্যায় ঘরের মাটিতে তৈরি করত টোকিও। এ ছাড়াও শত্রুর যুদ্ধজাহাজ ডোবাতে ‘টর্পেডো-বম্বার’ নামে বিশেষ এক ধরনের বোমারু বিমান তৈরি করে গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেন জাপানি গবেষকেরা।

০৬ ২০

তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জাপানি নৌবাহিনীকে বিশেষ একটি যুদ্ধবিমান সরবরাহ করত মিৎসুবিশি। তার নাম ছিল ‘এ৬এম জ়িরো’। মূলত বিমানবাহী রণতরীতে ব্যবহার হত এই লড়াকু জেট। পরবর্তী কালে সামনের অংশে বিস্ফোরক ভরে একে আরও ঘাতক বানিয়ে তোলে নির্মাণকারী সংস্থা। ফলে লড়াইয়ের সময়ে ‘আত্মঘাতী’ হামলা চালিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন টোকিওর যোদ্ধা পাইলটেরা।

০৭ ২০

১৯৩৯-’৪৫ সালের মধ্যে ১০ হাজারের বেশি ‘এ৬এম জ়িরো’ তৈরি করেছিল মিৎসুবিশি। ১৯৯৫ সালে তাদের বানানো ‘এফ-২’ নামের একটি মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান হাতে পায় জাপানি বিমানবাহিনী। জনপ্রিয় মার্কিন প্রতিরক্ষা সংস্থা ‘লকহিড মার্টিন’-এর হাত ধরে সংশ্লিষ্ট লড়াকু জেটটি তৈরি করে তারা। আমেরিকার ফলে সংশ্লিষ্ট যুদ্ধবিমানটির মডেলটিতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ছাপ।

০৮ ২০

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের অধিকাংশেরই দাবি, ‘এফ-২’ জাপানি গবেষকদের তৈরি করা কোনও অত্যাধুনিক লড়াকু জেট নয়। এটি প্রকৃতপক্ষে আমেরিকার ‘এফ-১৬ ফাইটিং ফ্যালকন’-এর নকল বা আদলে নির্মিত একটি যুদ্ধবিমান। ফলে এর দক্ষতা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। আর তাই গত শতাব্দীর ৩০ এবং ৪০-এর দশকের মতো নিজস্ব লড়াকু জেট তৈরি করতে চাইছে টোকিও।

০৯ ২০

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ১৯৫১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তিতে আবদ্ধ হয় ‘উদীয়মান সূর্যের দেশ’। আমেরিকার সান ফ্রান্সিসকোতে হওয়া ওই সমঝোতা অনুযায়ী জাপানের যাবতীয় নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করে ওয়াশিংটন। তার পরই প্রতিরক্ষা খাতে খরচ একেবারে নামমাত্র স্তরে নামিয়ে আনে টোকিও। প্রায় বন্ধ হয়ে যায় অত্যাধুনিক হাতিয়ার নিয়ে গবেষণা।

১০ ২০

কিন্তু, ২০১৪ সালের পর থেকে সেই বিধিনিষেধ শিথিল করে টোকিও। কারণ, তত দিনে চিনের উত্থানে ‘উদীয়মান সূর্যের দেশে’ শুরু হয়ে গিয়েছে নিরাপত্তা সঙ্কট। ২০১০ সালের পর থেকে জাপানি দ্বীপগুলিতে মারাত্মক ভাবে ‘দৌরাত্ম্য’ শুরু করে ‘আগ্রাসী’ বেজিঙের ‘পিপল্‌স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ নৌবাহিনী। সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জকে নিজের বলে দাবি করে বসে তারা। নাম বদলে ড্রাগন ওই এলাকাকে বলে ‘দিয়াওউ তাই’।

১১ ২০

টোকিওর অভিযোগ, বর্তমানে ঘন ঘন তাদের জলসীমায় ঢুকছে চিনা রণতরী। জাপান সাগরের ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ বা ইইজ়েডের (এক্সক্লিউসিভ ইকোনমিক জ়োন) সম্পদ কব্জা করার দিকে নজর রয়েছে তাদের। সান ফ্রান্সিসকো চুক্তি অনুযায়ী, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রটিতে রয়েছে একাধিক মার্কিন সামরিক ঘাঁটি। তা সত্ত্বেও পিএলএ নৌবাহিনীর ‘দাদাগিরি’তে ওয়াশিংটন ‘নিশ্চুপ’ থাকায় ক্ষুব্ধ জাপান ফের হাতিয়ার তৈরিতে মন দিতে শুরু করেছে।

১২ ২০

প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, এই পরিস্থিতিতে যৌথ ভাবে জেট ইঞ্জিন তৈরির জন্য টোকিও হাত বাড়িয়ে দিলে, ভারতের ক্ষেত্রে সেটা ‘গেম চেঞ্জার’ হতে পারে। এর নেপথ্যে একাধিক কারণের কথা বলেছেন তাঁরা। প্রথমত, এতে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবে নয়াদিল্লি। দ্বিতীয়ত, এতে যুদ্ধবিমানের ক্ষেত্রে পশ্চিমি নির্ভরশীলতা কাটানোর মিলবে সুবর্ণসুযোগ।

১৩ ২০

তবে লড়াকু জেটের ইঞ্জিন তৈরিতে জাপানি প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যাও রয়েছে। দীর্ঘ দিন প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত গবেষণা থেকে দূরে রয়েছে টোকিও। ফলে মিৎসুবিশির মতো সংস্থার হাতে বিশ্বমানের অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন তৈরির গবেষকের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। তা ছাড়া এ ব্যাপারে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রের কী কী শর্ত থাকবে, তা-ও স্পষ্ট নয়।

১৪ ২০

উদাহরণ হিসাবে ২০১৬ সালের কথা বলা যেতে পারে। ওই বছরে ডুবোজাহাজের জন্য ৩,৫০০ কোটি ডলারের প্রতিরক্ষা চুক্তি করে অস্ট্রেলিয়া। সেই দৌড়ে ছিল মিৎসুবিশিও। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত বরাত পাওয়ার থেকে ছিটকে যায় ওই জাপানি সংস্থা। তবে শেষ পাঁচ থেকে সাত বছরে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম নির্মাণের পরিমাণ বাড়িয়েছে ‘উদীয়মান সূর্যের দেশ’।

১৫ ২০

সূত্রের খবর, ২০২৭ সালের মধ্যে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) দুই শতাংশ পর্যন্ত প্রতিরক্ষা খাতে খরচের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে জাপান। বর্তমানে ফ্রিগেট শ্রেণির অত্যাধুনিক রণতরী তৈরিতে মন দিয়েছে টোকিও। অস্ট্রেলীয় নৌবাহিনীকে ওই ধরনের যুদ্ধজাহাজ সরবরাহ করার কথা রয়েছে মিৎসুবিশির।

১৬ ২০

অন্য দিকে, সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে দু’টি যুদ্ধবিমান তৈরির লাগাতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ভারত। তার মধ্যে একটি হল সাড়ে চার প্রজন্মের ‘তেজস’। অপরটির নাম অ্যামকা বা ‘অ্যাডভান্স মাল্টিরোল কমব্যাট এয়ারক্র্যাফ্‌ট’। দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট অ্যামকা পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান হতে চলেছে বলে জানা গিয়েছে।

১৭ ২০

চলতি বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর চণ্ডীগড় বায়ুসেনা ঘাঁটিতে অবসর নেবে গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) তৈরি ‘মিগ-২১’ যুদ্ধবিমান। ফলে বিমানবাহিনীর লড়াকু জেটের বহর (পড়ুন স্কোয়াড্রন) কমে দাঁড়াবে ২৯। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে যা অন্তত ৪২ হওয়া উচিত বলে মনে করেন এ দেশের আকাশযোদ্ধারা। বর্তমান পরিস্থিতিতে লড়াকু জেটের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় উদ্বেগ বেড়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকেরও।

১৮ ২০

‘মিগ-২১’ যুদ্ধবিমানের জায়গায় ‘তেজস’কে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করে রেখেছে ভারতীয় বিমানবাহিনী। কিন্তু, ইঞ্জিনের অভাবে সংশ্লিষ্ট লড়াকু জেটটি দ্রুত গতিতে বায়ুসেনাকে সরবরাহ করতে পারছে না নির্মাণকারী রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ‘হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড’ বা হ্যাল। এর জন্য ২০২৩ সালের জুনে মার্কিন প্রতিরক্ষা সংস্থা ‘জেনারেল ইলেকট্রনিক্স’-এর সঙ্গে একটি চুক্তি করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক।

১৯ ২০

সংশ্লিষ্ট চুক্তি অনুযায়ী ১৪টি জেট ইঞ্জিন হ্যালকে সরবরাহ করার কথা রয়েছে ওই মার্কিন প্রতিরক্ষা সংস্থার। কিন্তু, নয়াদিল্লির অভিযোগ, টাকা নিয়েও সময়মতো সেগুলি পাঠাচ্ছে না ‘জেনারেল ইলেক্ট্রনিক্স’। তে‌জস তৈরিতে বিলম্বের নেপথ্যে একেই সবচেয়ে বড় কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।

২০ ২০

ভারতের রেল এবং মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে কখনও পিছপা হয়নি জাপান। টোকিওর হাত ধরেই বুলেট ট্রেন চালানোর স্বপ্ন দেখছে কেন্দ্রের মোদী সরকার। এ বার যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন তৈরিতেও কি তাদের সাহায্য নেবে নয়াদিল্লি? এর উত্তর দেবে সময়।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement