ইরানের সঙ্গে রাশিয়ার যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে, তা বার বার স্বীকার করেছে তেহরান এবং মস্কো। তবে এ বার দুই বন্ধু মিলে এমন একটি পদক্ষেপ করতে চলেছে, যা চাপে ফেলতে পারে পশ্চিমি শক্তিগুলিকে। অন্তত তেমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
কিন্তু পশ্চিমি বিশ্বের নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ে, কোণঠাসা এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে কী এমন পদক্ষেপ করতে চলেছে ইরান এবং রাশিয়া, যা ওয়াশিংটনও অবরোধ করতে পারবে না বলে মনে করা হচ্ছে? উত্তর, ১৬২ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি রেলপথ, যা বিশ্ববাণিজ্যের ভোল চিরতরে বদলে দিতে পারে!
রাশ্ত থেকে আস্তারা পর্যন্ত ওই রেলপথ কেবল ইস্পাত এবং কংক্রিটের তৈরি কোনও লাইন নয়, এটি আন্তর্জাতিক উত্তর-দক্ষিণ পরিবহণ করিডরের (আইএনএসটিসি) এমন একটি সংযোগ, যা বাণিজ্যের খরচ ৩০ শতাংশ কমিয়ে দিতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, ওই রেলপথ চালু হলে ৩৭ দিনের বদলে পণ্য পরিবহণ করা সম্ভব হবে মাত্র ১৯ দিনে। অর্থাৎ, সুয়েজ খাল দিয়ে পণ্য পরিবহণ করতে যত সময় লাগে, তার প্রায় অর্ধেক সময়ে পণ্য পৌঁছে যাবে এক দেশ থেকে অন্য দেশে।
ফলে বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর নিষেধাজ্ঞার কোপে পড়া দু’টি অর্থনীতি— রাশিয়া এবং ইরানের জন্য, এটি একটি বিশাল স্বস্তি হিসাবে প্রমাণিত হতে পারে।
রাশ্ত থেকে আস্তারা পর্যন্ত তৈরি হতে চলা এই রেলপ্রকল্প ২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে মস্কো এবং তেহরানের স্বাক্ষরিত ২০ বছরের ব্যাপক কৌশলগত অংশীদারি চুক্তির অংশ।
রেলপ্রকল্পটির জন্য খরচ হচ্ছে প্রায় ১৬০ কোটি ইউরো। টাকা ঢালছে মূলত মস্কোই। তৈরির দায়িত্বও রয়েছে রাশিয়ার ইঞ্জিনিয়ারদের হাতে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রেল করিডরটি রাশিয়া এবং ইরান— উভয় দেশকে একটি সমান্তরাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বিচ্ছিন্ন দেশ থেকে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ে পরিণত করতে পারে।
রেলপথটি সম্পূর্ণ হলে এটি বছরে ২ কোটি টন পর্যন্ত পণ্য পরিবহণ করবে। পরিবহণ করা হতে পারে তেল, গ্যাস, ইস্পাত, খাদ্য এবং যন্ত্রপাতি।
রেল করিডর হওয়ায় এই পথে পশ্চিমি নৌশক্তির কোনও প্রভাবই থাকবে না। সুয়েজ খাল বা মলাক্কা প্রণালীর মতো সামুদ্রিক পথে দু’দেশের পণ্য পরিবহণের সময় আমেরিকা যে খবরদারি চালাত, তা থেকেও মুক্তি পেতে পারে দেশ দু’টি।
অন্য দিকে, বেজিংয়ের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ আইএনএসটিসির সঙ্গে পুরোপুরি মিলিত হয়েছে, যা দক্ষিণ চিন সাগর থেকে বাল্টিক পর্যন্ত একটি নিরবচ্ছিন্ন বাণিজ্য নেটওয়ার্ক তৈরি করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
তার মধ্যেই ব্রিকস এবং সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (এসসিও) মতো রাশিয়া-ইরান জোটও চুপচাপ পশ্চিমি নিষেধাজ্ঞার তোয়াক্কা না করেই নিজেদের বাণিজ্যপথ বিস্তার করার দিকে মন দিয়েছে।
তেহরান এবং মস্কোর মধ্যে রাশ্ত-আস্তারা রেলপথ নির্মাণের জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষিত চুক্তি স্বাক্ষরের কথা নিশ্চিত করেছেন ইরানের সড়ক ও নগর উন্নয়নমন্ত্রী ফারজ়ানেহ সাদেক।
রবিবার সাদেক সেই ঘোষণা করে এ-ও মন্তব্য করেন যে, আইএনএসটিসি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে রেলপথ নির্মাণ একটি বড় পদক্ষেপ হতে চলেছে।
১৬২ কিলোমিটার দীর্ঘ কৌশলগত রেল করিডরটি ইরান, রাশিয়া এবং আজ়ারবাইজ়ানের মধ্যে পণ্য পরিবহণ সহজতর করে তুলবে বলেও জানিয়েছেন সাদেক।
সাদেক এ-ও উল্লেখ করেছেন, গত দু’সপ্তাহে আজ়ারবাইজ়ান এবং পাকিস্তান সফর করেছেন তিনি। পরিবহণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা মাথায় রেখে প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্যই নাকি এই সক্রিয় কূটনীতি কৌশল অবলম্বন করেছে তেহরান।
ইরানের সড়ক ও নগর উন্নয়নমন্ত্রী আরও জানিয়েছেন, পাকিস্তানে তাঁর সাম্প্রতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ইরানের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে ইউরেশিয়ান এবং ককেশীয় দেশগুলির মধ্যে সংযোগ স্থাপন এবং পাকিস্তানের মাধ্যমে চিন ও ইরানের মধ্যে সংযোগ স্থাপন। পাশাপাশি, চিন থেকে ইরান এবং অবশেষে পাকিস্তানের মাধ্যমে ইউরোপে পণ্য পরিবহণ।