দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান এবং জাপানের বিরুদ্ধে চিনের যুদ্ধজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে বুধবার বেজিঙে সামরিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হয়। চিনের সেই বিজয় দিবস অনুষ্ঠানে চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে একই মঞ্চে দেখা গিয়েছিল ডেমোক্র্যাটিক পিপল্স রিপাবলিক অফ কোরিয়ার (উত্তর কোরিয়া) অবিসংবাদী নেতা কিম জং উনকে।
গত ২ সেপ্টেম্বর সাঁজোয়া সবুজ ট্রেনে করে বেজিং পৌঁছোন উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা। সঙ্গে ছিলেন তাঁর দেহরক্ষী এবং সরকারি কর্তারা। কালো পোশাকে এক কিশোরীকেও দেখা গিয়েছিল কিমের সঙ্গে। চিনের উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের সঙ্গে হেসে হেসে কুশল বিনিময় করতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে।
তার পর থেকেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, কে এই কিশোরী? কী তাঁর পরিচয়? কিমের চিন সফরেও বা কী করছিলেন তিনি? অনেকের মতে, ওই রহস্যময়ী কিশোরী আসলে উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতার কন্যা।
অনেকে দাবি করেছেন, চিন সফরই সম্ভবত কিম-কন্যার প্রথম বিদেশযাত্রা। সেই আবহে কিশোরীকে পরমাণু অস্ত্রধর দেশটির শাসক পরিবারের সম্ভাব্য উত্তরসূরি বলেও জল্পনা তৈরি হয়েছে।
উত্তর কোরিয়ার তরফে কিম-কন্যার নাম বা বয়স কখনও প্রকাশ করা হয়নি। যদিও সে দেশের বিভিন্ন সামরিক অনুষ্ঠানে একাধিক বার উপস্থিত হতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। এর পর থেকেই উত্তরসূরি হিসাবে কিম সেই কন্যাকেই বেছে নিতে পারেন বলে হাওয়ায় খবর ভাসছিল। বেজিং সফরের পর সেই জল্পনা আরও তীব্র হয়েছে।
বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ কোরিয়া (রিপাবলিক অফ কোরিয়া)-র গোয়েন্দাদের বিশ্বাস, কিমের কিশোরী কন্যার নাম কিম জু এ। তেমনটা জানিয়েছিলেন আমেরিকার প্রাক্তন বাস্কেটবল খেলোয়াড় ডেনিস রডম্যানও।
২০১৩ সালে কিমের পরিবারের সঙ্গে সময় কাটিয়েছিলেন রডম্যান। সেই সময় সংবাদমাধ্যম ‘দ্য গার্ডিয়ান’কে এক সাক্ষাৎকারে প্রাক্তন বাস্কেটবল খেলোয়াড় বলেছিলেন, ‘‘আমি শিশু জু এ-কে কোলে নিয়েছিলাম এবং কিমের স্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলেছিলাম।’’
কিমের বেজিং সফরে ওই কিশোরীকে দেখে এখন জল্পনা তৈরি হয়েছে, ওই কিশোরীই আসলে কিম-কন্যা জু এবং তাকেই উত্তর কোরিয়ার পরবর্তী শাসক হিসাবে বেছে নিতে চলেছেন কিম।
বুধবার বেজিঙে সামরিক কুচকাওয়াজের সময় জিনপিঙের সঙ্গে একই মঞ্চে দেখা গিয়েছিল কিমকে। কিন্তু সামরিক কুচকাওয়াজের আগে তিয়েনআনমেন স্কোয়্যারে কিম যখন লাল গালিচায় হাঁটছিলেন, তখন আর ওই কিশোরীকে তাঁর ধারেকাছে দেখা যায়নি।
আমেরিকার স্টিমসন সেন্টারের উত্তর কোরিয়া বিশেষজ্ঞ মাইকেল ম্যাডেনকে উদ্ধৃত করে সংবাদসংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘‘এই মুহূর্তে জু উত্তর কোরিয়ার পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা হিসাবে এগিয়ে আছেন।’’
উত্তর কোরিয়ার পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা হিসাবে বিদেশযাত্রার সময় সরকারি আদবকায়দা কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্যই জু সম্ভবত চিন সফরে এসেছিলেন বলে মনে করছেন মাইকেল।
কিম জং উন কিশোর বয়সে বাবা কিম জং ইলের সঙ্গে কখনও বিদেশভ্রমণে গিয়েছিলেন বলে শোনা যায়নি। তবে পঞ্চাশের দশকে কিম জং ইল তাঁর বাবা তথা উত্তর কোরিয়ার প্রতিষ্ঠাতা কিম ইল সুং-এর সঙ্গে বিদেশভ্রমণ করেছিলেন।
কিমের সঙ্গে জু-কে এই প্রথম উত্তর কোরিয়ার বাইরে দেখা গিয়েছে বলে জানিয়েছেন মাইকেল। কিন্তু সত্যিই কি উত্তর কোরিয়ার পরবর্তী উত্তরসূরি হতে পারেন কিমের কিশোরী-কন্যা?
১৯৪৮ সালে কিম ইল সুঙের হাতে উত্তর কোরিয়া তৈরি হওয়ার পর থেকে ক্ষমতা রয়েছে একই পরিবারের হাতে। বংশপরম্পরায় একনায়কতন্ত্র চলে আসছে সে দেশে।
১৯৯৪ সালে বাবার মৃত্যুর পর উত্তর কোরিয়ার শাসক হিসাবে ক্ষমতায় আসেন কিম জং ইল। তার ১৭ বছর পর ইলের মৃত্যু হওয়ায় শাসকের পদে বসেন কিম জং উন।
কিন্তু ১৯৪৮ সালের পর থেকে কোনও মহিলা কখনও উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতার আসনে বসেননি। ফলে কিমের কন্যার প্রথম আন্তর্জাতিক উপস্থিতি উস্কে দিয়েছে জল্পনা।
আন্তর্জাতিক মহলের অনেকেই মনে করছেন, জু-কে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করছেন কিম। উত্তরসূরি হিসাবে কন্যার হাতেই নাকি তিনি শাসনভার তুলে দিতে চাইছেন।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, জু উত্তর কোরিয়ার শাসক হতে পারেন এমন জল্পনা ভবিষ্যতে বাস্তবায়িত হতেও পারে। সে দেশের বিভিন্ন সামরিক অনুষ্ঠানে কিম-কন্যাকে যে ভাবে সম্মান প্রদর্শন করা হয়, তাতে সেই সম্ভাবনা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও মনে করছেন ওই বিশেষজ্ঞেরা।
দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা জু-কে উত্তর কোরিয়ার সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসাবে বলে মনে করলেও শেষ পর্যন্ত সব সময় পুরুষের হাতে ক্ষমতা থাকা উত্তর কোরিয়া শাসক নির্বাচনের ক্ষেত্রে ছক ভাঙবে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
প্রসঙ্গত, কিমের সন্তানদের নিয়ে সব সময়ই কড়া গোপনীয়তা বজায় রেখেছে উত্তর কোরিয়া। তাদের নাম এবং বয়স প্রকাশ্যে আনা হয়নি কখনও। তবে কিমের সঙ্গে তাঁর কন্যাকে প্রথম বার দেখা গিয়েছিল ২০২২ সালে।
মনে করা হয় কিম-কন্যা জুয়ের বয়স ১৩-১৪ বছর। আবার কারও মতে তাঁর বয়স ১৮ বছর। অতীতে উত্তর কোরিয়ার একাধিক সামরিক অনুষ্ঠানে দেখা গিয়েছে তাঁকে। গত মে মাসে রাশিয়ার দূতাবাসের একটি অনুষ্ঠানেও যোগ দিয়েছিলেন তিনি।