প্রেমে পড়লে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। অনেক সময়ই ভাল-মন্দ বোঝার বোধগুলি দরজা বন্ধ করে দেয়। পরিণতি পাওয়ার আগেই দুঃখজনক ভাবে শেষ হয় সেই সব প্রেমের উপাখ্যান। যে প্রেম ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায় তাকে কুক্ষিগত করে রাখার আপ্রাণ চেষ্টার ফল সব সময় মিলনান্তক হয় না। বরং তাতে মিশে থাকে আক্রোশ, রাগ, প্রতিশোধস্পৃহার গল্প।
প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে আঘাত সহ্য করতে না পেরে প্রতিশোধ নেওয়ার উদাহরণ ভূরি ভূরি। তা সে রুপোলি পর্দাই হোক বা বাস্তব। কঠিন সত্য মানতে না পেরে অনেকেই এমন কাণ্ড ঘটান যে তার কর্মফল ভুগতে হয় সারা জীবন ধরে। এমনই একতরফা প্রেমের গল্প শেষ হয়েছিল জেলের গরাদের পিছনে। এটি ৩৩ বছর বয়সি জ্যাকলিন ক্লেয়ার অ্যাডেসের আগ্রাসী প্রেমের কাহিনি।
২০১৭ সালে ‘লাক্সি’ নামের একটি ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমে এক ধনকুবেরের সঙ্গে আলাপ হয় তাঁর। ধনী এবং অবিবাহিত পুরুষ ও মহিলাদের জন্য এটি বিখ্যাত ডেটিং সাইট। সেখানে পরস্পরকে পছন্দ করার পর জ্যাকলিন এক সন্ধ্যায় সেই ধনকুবেরের সঙ্গে ডেটে গিয়েছিলেন। যদিও সেই আলাপের পরিসমাপ্তি ঘটে সেই রাতেই। মাত্র কয়েক ঘণ্টা ছিল সেই ডেটের আয়ু।
জ্যাকলিনকে ওই ব্যক্তি ডেটের পরে স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে, তিনি আর দেখা করতে বা যোগাযোগ রাখতে চান না। সম্পর্কে ইতি টেনে দেন একটি সংস্থার সিইও সেই ধনকুবের। কিন্তু জ্যাকলিনের মনে ছিল অন্য পরিকল্পনা। ছিনে জোঁকের মতো ডেটিংয়ে আলাপ হওয়া পুরুষের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যান তিনি।
‘পাগলামি’ এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে সময়-অসময়ে ধনকুবেরের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন জ্যাকলিন। এই ‘অত্যাচার’ সহ্য করতে না পেরে বাধ্য হয়ে পুলিশ ডাকেন ওই ধনকুবের। পুলিশ আধিকারিকেরা সেখান থেকে সরিয়ে দেন জ্যাকলিনকে। এর পরই জ্যাকলিনের মাথায় যেন খুন চড়ে যায়। ডেটের সঙ্গীকে একের পর এক হুমকি দিতে শুরু করেন তিনি।
এমনকি অভিযোগকারীকে হেনস্থা করার জন্য তাঁর কর্মক্ষেত্রে গিয়েও হানা দেন। সেখানে নিজেকে ওই ব্যক্তির স্ত্রীর মিথ্যা পরিচয় দিতে শুরু করেন। ২০১৮ সালে আরও একটি কাণ্ড ঘটান ওই তরুণী। বাড়িতে বসানো ক্যামেরায় ওই ধনকুবের দেখতে পান তাঁর শোয়ার ঘরের বিছানার চাদর লন্ডভন্ড। পাশের বাথরুমের মেঝেয় মহিলাদের পোশাক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, সেখানে এক জন তরুণী নগ্ন হয়ে স্নান করছেন।
তাঁকে ভাল করে দেখে চিনতে পারেন ওই ধনকুবের। অনুপ্রবেশকারী আর কেউ নন, যাঁর সঙ্গে তিনি দেড় বছর আগে ডেটে গিয়েছিলেন তিনিই। যৌন নির্যাতন এবং অপরাধমূলক অনুপ্রবেশের অভিযোগ আনেন ওই ধনকুবের।
অনুপ্রবেশের মামলায় জ্যাকলিনকে গ্রেফতার করা হয়। সেই মামলার তদন্তে উঠে আসে হাড়হিম করা সব তথ্য। পুলিশকে অভিযোগকারী ব্যক্তি জানিয়েছিলেন, তাঁকে ফোনে প্রায় ১০ মাস ধরে ১ লক্ষ ৫৯ হাজারটি বার্তা প্রেরণ করেছিলেন জ্যাকলিন। দিনে প্রায় ৫০০টি করে মেসেজ করতেন জ্যাকলিন।
সেই বার্তাগুলির সব ক’টি গদগদ প্রেমের ছিল না বলে তদন্তে উঠে আসে। একটি বার্তায় জ্যাকলিন লিখছেন, ‘‘আমি তোমার রক্তে স্নান করতে চাই।’’ অন্য একটি বার্তায় লেখা, “তোমাকে আমার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতে হবেই। তুমি আমার সঙ্গে চিরকাল থাকবে।’’ তৃতীয় বার্তার ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে জিঘাংসা। তাতে লেখা ছিল, ‘‘আমি তোমার কিডনি দিয়ে সুশি আর তোমার হাতের হাড় দিয়ে চপস্টিক বানাব।’’
আবার কিছু বার্তায় অর্থের উল্লেখ রয়েছে বলে তদন্তকারী আধিকারিকেরা আদালতকে জানিয়েছিলেন। সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ার পর জ্যাকলিনের পরিচিতেরা অনেক তথ্য জানাতে শুরু করেন সংবাদপত্রে। জ্যাকলিনের বন্ধুরা জানিয়েছিলেন, তিনি ধনী ব্যক্তির পিছনে যে ভাবে ছুটছেন তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ বরাবরই অর্থবান প্রেমিক বা সঙ্গীকে প্রেমের ফাঁদে ফেলবার চেষ্টা করে গিয়েছেন জ্যাকলিন।
ওই তরুণীর বন্ধুদের অনেকেই জানিয়েছেন বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন জ্যাকলিন। প্রায়ই তিনি নিজের মার্সেডিজ় বেঞ্জ নিয়ে লস অ্যাঞ্জেলস, মিয়ামি বিচ, লাস ভেগাসে চষে বেড়াতেন। রাতের দিকে তাঁকে অভিজাত রেস্তরাঁয় ধনী পুরুষসঙ্গীদের সঙ্গে পান-ভোজনে মত্ত থাকতে দেখা যেত। সমাজমাধ্যমেও বেশ সক্রিয় ছিলেন জ্যাকলিন।
তাঁর পোষ্য ও বেড়াতে যাওয়ার মুহূর্তের ছবি ও ভিডিয়ো পোস্ট করতেন ইনস্টাগ্রামে। বিশ্বখ্যাত সব ব্র্যান্ডের পোশাক, চশমা, ব্যাগ ব্যবহার করতেন তিনি। এমনটাই জানিয়েছেন পরিচিতেরা। সমাজমাধ্যমে সে সবের ছবিও দিতেন এই তরুণী। এক বন্ধু জানিয়েছেন, জ্যাকলিন জিপসিদের মতো উদ্দাম জীবন যাপন করতেন।
জ্যাকলিনকে যে দিন গ্রেফতার করা হয় সে দিনও তাঁর গাড়ি থেকে একটি মাংস কাটার ধারালো ছুরি উদ্ধার করে পুলিশ। গ্রেফতারির পর সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে জ্যাকলিন জানান, যাঁর সঙ্গে তিনি মাত্র একটি রাত কাটিয়েছেন সেই ব্যক্তিই নাকি তাঁর আত্মার সঙ্গী।
জ্যাকলিন জানিয়েছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশে নালিশ জানানো ওই ব্যক্তিকে কখনও আঘাত করার কোনও উদ্দেশ্য তাঁর ছিল না এবং তিনি তাঁকে অর্থলোভের বশবর্তী হয়ে শিকারের চোখে দেখেননি। শুধুমাত্র ধনকুবেরের ভালবাসার পাত্রী হয়ে আজীবন তাঁর সঙ্গে কাটাতে চেয়েছিলেন।
২৩ বছর বয়সি ওমর চ্যাটি নামের এক তরুণ সংবাদমাধ্যমে জানিয়েছিলেন, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে সপ্তাহান্তের ছুটিতে তিনি মিয়ামিতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে জ্যাকলিনের সঙ্গে তাঁর মাত্র এক রাতের যৌন সম্পর্ক ঘটেছিল। জ্যাকলিন তাঁকে জানিয়েছিলেন যে, তিনি সাউথ বিচের একটি হোটেলে থাকেন এবং তাঁর এক জন ধনী প্রেমিক আছেন যিনি তাঁর জীবনযাত্রার সমস্ত খরচ বহন করেন।
মামলা চলাকালীন জ্যাকলিনের আইনজীবী আদালতকে জানিয়েছেন যে তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন। তাই তাঁকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হোক। আদালত সেই আবেদন অগ্রাহ্য করে। ২০১৯ সালে চলা মামলায় নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেন জ্যাকলিনও। তবে সমস্ত প্রমাণ তাঁর বিরুদ্ধে যায়। জেলের সাজা হয় তাঁর।
তার পর জ্যাকলিনের কী হল সে সম্পর্কে বিশেষ কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। তিনি জেল থেকে মুক্ত হয়েছেন কি না তার সর্বশেষ কোনও তথ্যও পাওয়া যায়নি।