রাতের অন্ধকারে অজগরের মতো শুয়ে থাকা সড়ক চিরে দ্রুত গতিতে বেরিয়ে যাচ্ছে একের পর এক গাড়ি। গাড়িগুলিকে দিশা দেখাচ্ছে উজ্জ্বল, চোখধাঁধানো সবুজ আলো। ঠিক যেন কোনও কল্পবিজ্ঞানের পাতা থেকে উঠে আসা ‘সাই-ফাই’ সিনেমা। লাইটহাউস যেমন নাবিককে পথ দেখায় তেমনই সবুজ আলোগুলি চালকদের সঠিক দিশা দেখাতে ‘জ্বলে’ উঠত আঁধার নামলেই।
পরিকল্পনা ছিল দেশের সমস্ত রাস্তায় আলোর বদলে জ্বলবে সবুজ রঙের বিশেষ এক রাসায়নিক আলো। পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের দেশ মালয়েশিয়া। ২০২৩ সালে প্রথম রাস্তায় সাদার বদলে অন্য ধরনের রঙের ব্যবস্থা করেছিল এ দেশের সেমেনিহ শহরে। শহরটি সেলেঙ্গ প্রদেশে। পরে ধীরে ধীরে রাজধানী কুয়ালালামপুর-সহ অন্যান্য বড় শহরের রাস্তার রং পালটে অত্যাধুনিক রূপ দেওয়ার কথা মাথায় ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটির।
রাতের দিকে দৃশ্যমানতা কমে যাওয়ায় দুর্ঘটনার মুখে পড়তে হত গাড়িগুলিকে। বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলগুলিতে। আলোর অভাবে প্রায়ই সড়ক দুর্ঘটনার মুখোমুখি হতেন চালকেরা। গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে দৃশ্যমানতার উন্নতি ঘটানোর জন্য সবুজ আলোয় মুড়ে দেওয়া হয় সেমেনিহের কয়েকশো কিলোমিটার।
২৪৫ মিটার দীর্ঘ এই রাস্তাটি কয়েক বছর ধরেই দুর্বল পরিকাঠামো এবং আলোর অভাবে ধুঁকছিল। সাধারণত সন্ধ্যা নামলে সড়কের ধারে বা মাঝখানে সারি দেওয়া বৈদ্যুতিক আলো জ্বলে ওঠে। চালকদের পথ দেখায় আলোগুলি। গাড়িকে সঠিক দিশা বা লেন ঠিক রাখতে সাহায্য করে এই আলো।
চিরাচরিত আলোর ব্যবস্থা না করে একটু ভিন্ন ভাবে ভেবেছিল মালয়েশিয়া। থার্মোপ্লাস্টিক স্ট্রাইপ দিয়ে নয়, বরং অন্ধকার দূর করতে ‘ফোটোলুমিনেসেন্ট’ প্রযুক্তি ব্যবহার করেছিল দেশটি। এই পদ্ধতিতে নেদারল্যান্ডস এবং জাপানেও সড়ক আলোকিত করার পরীক্ষানিরীক্ষা করা হয়েছিল। তবে সেই প্রকল্পগুলি মূলত সাইকেল লেন বা স্বল্প দৈর্ঘ্যযুক্ত সড়কের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল। মালয়েশিয়ার কর্মসূচিটির পিছনে সরকারের উচ্চাকাঙ্ক্ষা যথেষ্ট ছিল।
শহরের উপকণ্ঠে বা গ্রামাঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত অংশে ফোটোলুমিনেসেন্ট প্রযুক্তি প্রচলিত আলোর ব্যবস্থাকে সরিয়ে দিয়ে কার্যকর হয়ে উঠতে পারে কি না, তা মূল্যায়ন করার জন্য প্রকল্পটি হাতে নেয় মালয়েশিয়া সরকার। সীমিত বৈদ্যুতিক পরিকাঠামো রয়েছে এমন গ্রামীণ এলাকায় রাস্তার আলোর সাশ্রয়ী বিকল্প হিসাবে এই পাইলট প্রকল্পটি চালু করা হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া যথেষ্ট আশাব্যঞ্জকও ছিল।
সমাজমাধ্যমে দৃশ্যতই সেই সবুজ আলো ঝলমলে রাস্তার দৃশ্য দেখে সেটিকে ‘মালয়েশিয়ার সবচেয়ে সুন্দর ও নিরাপত্তা বন্দোবস্ত’ বলে প্রশংসা কুড়িয়েছিল। মালয়েশিয়ার পূর্ত বিভাগ (জেকেআর) দাবি করেছিল, কুয়াশা বা ভারী বৃষ্টিতেও এই আলোর দৃশ্যমানতা পরিপূর্ণ ভাবে বজায় ছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রাতের গাড়ি চালানোর সংজ্ঞা পাল্টে দিয়েছিল সবুজ ‘ভিন্গ্রহী’ আলো।
ফটো লুমিনেসেন্ট হল এমন একটি পদ্ধতি যেখানে কোনও পদার্থ আলো শোষণ করার পর তা থেকে নিজে থেকেই আলো বিকিরণ করে। এই ক্ষমতাসম্পন্ন পদার্থগুলি সাধারণত অন্ধকারে উজ্জ্বলতা প্রদান করে। তাই এদের ‘গ্লো-ইন-দ্য-ডার্ক’ বলে ডাকা হয়। রাস্তায় বসানো দাগগুলি সূর্যালোক শোষণ করবে। রাতে সেই দাগগুলি থেকে দৃশ্যমান আভা নির্গত হবে। বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে না। এই ছিল সেই সবুজাভ আলোর প্রকল্পের মূল বিষয়।
সারা দিন সূর্যের উত্তাপ শুষে নিত ফোটোলুমিনেসেন্ট দাগ। সেই উত্তাপকে কাজে লাগিয়েই রাত নামলেই আলোর প্রভা ছড়াতে শুরু করত দাগগুলি। সেই আলোয় পথ দেখতে সুবিধা হত গাড়িচালকদের। মোটামুটি ১০ ঘণ্টা ধরে এই দাগগুলি আলো ছড়াতে কার্যকর ছিল।
ঢাক-ঢোল পিটিয়ে রাস্তার আলোকসজ্জার প্রকল্পটি চালু হলেও এক বছরের মধ্যেই আলোর প্রভা ম্রিয়মাণ হতে শুরু করে। ২০২৪ সালের শেষের দিকে, আক্ষরিক এবং রূপক— উভয়ে অর্থেই সেই আলোর উজ্জ্বলতা ম্লান হয়ে গিয়েছিল।
সবচেয়ে বড় ধাক্কা এসেছিল রং থেকেই। স্ট্রন্টিয়াম অ্যালুমিনেট থেকে তৈরি ফোটোলুমিনেসেন্ট আবরণের দাম প্রতি বর্গমিটারে প্রায় ১৫ হাজার টাকা পড়ছিল। রাস্তার সাধারণ সাদা রঙের দামের প্রায় ২০ গুণ বেশি। এমনকি একটি ছোট অংশের রঙ বজায় রাখার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন প়ড়ছিল। ফলে বৃহৎ আকারে এই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়েছিল মালয় সরকারের কাছে।
দ্বিতীয় বিষয় যেটি এই প্রকল্পের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছিল সেটি হল মালয়েশিয়ার আবহাওয়া। আর্দ্র গ্রীষ্মমণ্ডলীয় আবহাওয়ার পরিমণ্ডলে ফোটোলুমিনেসেন্ট দাগগুলি নষ্ট হতে শুরু করে। ক্রমাগত বৃষ্টি, তাপ এবং অতিবেগনি রশ্মির সংস্পর্শে আসার ফলে উজ্জ্বল উপকরণগুলি দ্রুত ক্ষয়ে যেতে শুরু করেছে। সেগুলি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আর এক দফা খরচের প্রয়োজন পড়ছে। মালয়েশিয়ার আবহাওয়ায় এই রংগুলি এক থেকে দেড় বছরের বেশি টিকে থাকতে পারছে না বলে খবরে প্রকাশ।
সেলাঙ্গর জুড়ে ১৫টি স্থানে এবং জোহরের ৩১টি সড়কে প্রকল্পটি সম্প্রসারণের প্রাথমিক পরিকল্পনা নেওয়া হলেও পরবর্তী কালে সেগুলি নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করেনি সরকার। সেলাঙ্গর রাজ্য সরকার এবং জোহরের পরামর্শদাতারা, যাঁরা ২০২৪ সালের শুরুতে এই উদ্যোগকে সমর্থন করেছিলেন তাঁরা খরচের বহর দেখে এ ব্যাপারে আর কোনও আগ্রহ দেখাতে চাননি।
এই আলোকসজ্জাটির সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জনসাধারণের উৎসাহ দ্রুত কমে যায়। আমজনতার অতি উৎসাহী মনোভাব ধীরে ধীরে কমে আসতে শুরু করে। নাগরিকেরা সরকারের ব্যয়ের সার্থকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। রাস্তার গর্ত, বিবর্ণ হয়ে যাওয়া দিকনির্দেশের সাইনবোর্ড এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবের মতো সমস্যাগুলি সরকারের অগ্রাধিকারের বিষয় হওয়া উচিত বলে মনে করছেন মালয়ের নাগরিকেরা।