সংসদে নতুন আয়কর বিল পেশ করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। করদাতাদের স্বার্থে নতুন বিলটিকে নিজেদের পোর্টালে আপলোড করেছে আয়কর দফতর। সেখানে ঢুকে যে কেউ পুরনো এবং নতুন আইনের ধারাগুলি মিলিয়ে দেখতে পারেন। নতুন বিলে আমজনতা সহজেই আইনের ধারাগুলি বুঝতে পারবে, করদাতাদের পোয়াতে হবে কম ঝক্কি এবং হ্রাস পাবে আয়কর সংক্রান্ত মামলা-মোকদ্দমা। বিল পেশ করে জানিয়েছে কেন্দ্র।
অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন সংসদে বলেন, ‘‘১৯৬১ সালের আয়কর আইনকে বদলাতে এই বিল আনা হয়েছে।’’ নতুন বিলে যেহেতু ধারার সংখ্যা কম রাখা হয়েছে, তাই পোর্টালে গিয়ে পুরনো ধারাটি উল্লেখ করলেই তার বিষয়বস্তু নতুন বিলের কোন ধারায় রয়েছে, তা দেখতে পাবেন করদাতা। নরেন্দ্র মোদী সরকারের দাবি, নতুন বিলটিকে অনেক বেশি সরল করা হয়েছে।
নতুন আয়কর বিলে শব্দ সংখ্যা এবং পরিচ্ছেদ কমিয়েছে সরকার। মুছে ফেলা হয়েছে হাজারের বেশি অনুবিধি ও ব্যাখ্যা। তবে আমজনতা যাতে আয়করের হিসাব সহজে করতে পারেন, সেকথা মাথায় রেখে সারণির সংখ্যা ১৮ থেকে বাড়িয়ে ৫৭ করেছেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী নির্মলা। পাশাপাশি, বিলে কিছু সূত্র বা ফর্মুলা দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে সহজেই করের হিসাব করতে পারবে সাধারণ মানুষ।
আয়কর দফতর জানিয়েছে, পোর্টালে ঢুকে কোনও করদাতা পুরনো আইনের ধারা দেখতে চাইলে, তাঁকে ‘ড্রপ ডাউন মেনু’তে যেতে হবে। সেখান থেকে যা দেখতে চাইছেন, সেটা করদাতাকে বেছে নিতে হবে। এর পর সংশ্লিষ্ট বিষয়টি নতুন বিলের কোন ধারায় রয়েছে, তা স্ক্রিনে ফুটে উঠবে। জানা যাবে আইনের ধারাটির ব্যাখ্যাও। বোঝার সুবিধার জন্য প্রতিটি ধারা এবং তার ব্যাখ্যা পাশাপাশি দেখে নেওয়ার (টেব্ল ফর্ম্যাট) সুযোগও রয়েছে ওই পোর্টালে।
নতুন আয়কর বিলে রয়েছে ২৩টি অধ্যায় এবং ১৬টি তফশিল। এতে ধারার সংখ্যা ৫৩৬ রাখা হয়েছে। পুরনো আইনে ধারার সংখ্যা ছিল ৮১৯। নতুন বিলটি ৬২২ পাতার। সেখানে বর্তমান আইনটি ৮২৩ পাতায় লিপিবদ্ধ হয়েছে। অধ্যায় এবং তফশিলের ক্ষেত্রে অবশ্য কোনও বদল করা হয়নি।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, বর্তমানে আইনে ‘কৃষি জমি’র ব্যাখ্যা যথেষ্ট জটিল। কিন্তু নতুন বিলে একে বেশ সরল করা হয়েছে। কাকে ‘কৃষি জমি’ বলা হবে, সেটা বোঝাতে শব্দ সংখ্যা অনেক কমিয়েছে কেন্দ্র। এ ছাড়া ১৯৬১ সালের আয়কর আইনে ‘তবু’ শব্দটির বহুল ব্যবহার রয়েছে। নতুন বিলে অধিকাংশ জায়গায় এই শব্দটিকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে ‘যাই হোক না কেন’ শব্দবন্ধের মাধ্যমে একে বদল করা হয়েছে।
পুরনো আইনে আয়কর রিটার্নের ক্ষেত্রে ‘মূল্যায়ন বছর’ (অ্যাসেসমেন্ট ইয়ার) এবং ‘পূর্ববর্তী বছর’ (প্রিভিয়াস ইয়ার) শব্দ দু’টি রয়েছে। এখানে পূর্ববর্তী বছর বলতে যে সময়কালে করদাতা আয় করবেন, তাকে বোঝানো হয়েছে। আর মূল্যায়ন বছর হল সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অর্জিত আয়ের পরবর্তী বছর। সেখানে আগের বছরের আয় মূল্যায়ন করে কর আরোপ করবে আয়কর বিভাগ।
উদাহরণ হিসাবে ২০২৪ সালের ১ এপ্রিল থেকে চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময়কালকে ধরা যেতে পারে। বর্তমান নিয়মে এই সময়সীমার মূল্যায়ন বছর হবে ২০২৫-’২৬। নতুন বিলে এর বিলোপ ঘটিয়ে ‘করবর্ষ’ (ট্যাক্স ইয়ার) চালু করবে কেন্দ্র। নতুন বিলের তিন নম্বর ধারায় এর উল্লেখ রয়েছে।
অর্থ মন্ত্রক জানিয়েছে, কোনও ব্যক্তি একটি আর্থিক বছরের যে সময়কালে আয় করবেন, তাকেই বলা হয়ে ‘করবর্ষ’। কারণ, এর উপর ভিত্তি করেই ঠিক হবে তাঁর আয়কর। ‘করবর্ষ’কে ১ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া আর্থিক বছরের ১২ মাসের সময়কাল হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে অর্থবর্ষ এবং করবর্ষ সমার্থক।
দ্বিতীয়ত, নতুন ভাবে শুরু করা কোনও ব্যবসা, পেশা বা কোনও আর্থিক বছরে নতুন ভাবে প্রতিষ্ঠিত আয়ের উৎসের ক্ষেত্রে, কর বছর হবে সেই ব্যবসা বা পেশা প্রতিষ্ঠার তারিখ থেকে শুরু হওয়া সময়কাল। আয়ের উৎসের ক্ষেত্রেও যে তারিখ থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি রোজগার করছেন, সেই তারিখ থেকেই শুরু হবে ‘করবর্ষ’। সংশ্লিষ্ট আর্থিক বছরের শেষ দিনে সেটির সমাপ্তি ঘটবে। সহজ করে বলতে গেলে, ২০২৪-’২৫ আর্থিক বছরের করবর্ষও হবে ২০২৪-’২৫।
বর্তমানে দেশে দু’টি কর কাঠামো চালু রয়েছে। সেগুলি হল, পুরনো ও নতুন কর ব্যবস্থা। এর মধ্যে পুরনো কাঠামোতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে লগ্নি করলে ছাড় পেয়ে থাকেন করদাতা। উদাহরণ হিসাবে পাবলিক প্রভিডেন্ট ফান্ড (পিপিএফ), ন্যাশনাল সেভিংস সার্টিফিকেট এবং জীবন বিমার কথা বলা যেতে পারে। এতোদিন পর্যন্ত ৮০সি ধারায় এগুলিতে বিনিয়োগের জন্য ছাড় পেতেন কর দাতা। নতুন বিলে একে বদলে ১২৩ নম্বর ধারা করা হয়েছে।
একই ভাবে নতুন বিলে এখনকার ৮০ডি, ৮০ই, ৮০জ়ি ধারা বদল করছে সরকার। পরিবর্তে চালু হবে ১২৬, ১২৯ এবং ১৩৩ নম্বর ধারা। এতে স্বাস্থ্য বিমা, শিক্ষা ঋণের কিস্তি এবং সমাজসেবায় অনুদান দেওয়ার জন্য ছাড় পাবেন সংশ্লিষ্ট কর দাতা।
চলতি বছরের বাজেটে নতুন কাঠামোতে বিপুল কর ছাড়ের কথা ঘোষণা করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা। তাঁর ঘোষণা অনুযায়ী, চাকরিজীবীদের বছরে ১২ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আয়ে দিতে হবে না একটা টাকাও কর। চাকরিজীবী না হলে বার্ষিক ১২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয়ে পাবেন কর ছাড়। বর্তমান আইনের ৮৭(ক) ধারায় এটি চালু করছেন তিনি। নতুন বিলে এটি বদলে গিয়ে হবে ১৫৭ নম্বর ধারা।
বাড়ি বিক্রি, বন্ড, শেয়ার বা মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত আয়ের ক্ষেত্রে এতোদিন করের বিষয়টি ৫৪ এবং ৫৪(ইসি) ধারা মেনে ধার্য করা হত। সেগুলি বদলে নতুন বিলে ৮২ এবং ৮৫ নম্বর ধারা করেছে আয়কর দফতর। ক্যারি ফরোয়ার্ড লসের ৭০ এবং ৭১ নম্বর ধারা বদলে হচ্ছে ১০৮ এবং ১০৯।
১৯৬১ সালের আয়কর আইনের ১০ নম্বর ধারায় কৃষি থেকে আয়, সংস্থার অংশীদারিত্বের থেকে লভ্যাংশ, পারিবারিক পেনশন, বৃত্তি, এনআরই/এফসিএনআর আমানতের উপর নির্দিষ্ট সুদের উপর ছাড় পেতেন করদাতারা। নতুন বিলে এই বিষয়গুলিকে তফশিল দুই এবং তফশিল সাতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি, আইনের এই জটিল ধারাটিকে অনেকটাই সহজ করা হয়েছে।
বিদ্যমান আয়কর আইনে ১৯৪এ (সুদ), ১৯৪আই (ভাড়া) ১৯৪জে (পেশাদার ফি, কারিগরি পরিষেবার জন্য ফি, রয়্যালটি প্রদান), ১৯৪এইচ (কমিশন) এবং ১৯৪সির (চুক্তি) মতো বেশ কয়েকটি ধারা ছিল। এগুলিকে নতুন বিলে অনেকটাই বদল করা হয়েছে।
এছাড়া ট্যাক্স ডিডাকটেড অ্যাট সোর্স (টিডিএস) এবং ট্যাক্স কালেকটেড অ্যাট সোর্সের (টিসিএস) নিয়ম নতুন বিলে পাল্টেছে সরকার। তবে করের হার এবং কোন কোন আয়ের উপর কর ধার্ষ হবে, সেই নিয়মের কোনও বদল করা হয়নি। অর্থাৎ বেতন, বাড়ি ভাড়া থেকে আয়, ব্যবসায় লাভ, বন্ড-স্টক-মিউচুয়াল ফান্ড থেকে আয় এবং অন্যান্য কোনও জায়গা থেকে আয়ের উপর দিতে হবে কর।
চলতি বছরেই সংসদে নতুন আয়কর বিলটি পাশ হবে বলে মনে করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে ২০২৬ সালের ১ এপ্রিল থেকে এটি কার্যকর করবে সরকার। সংসদে অবশ্য বিলটি নিয়ে আলোচনার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।