এক দিকে ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তাকে কেন্দ্র করে চলা চার দিনের ‘যুদ্ধে’ বেদম মার খাওয়া। অন্য দিকে, সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত হওয়ায় বেড়ে চলা জলসঙ্কট। পহেলগাঁও হামলার পর ভারতের জোড়া প্রত্যাঘাতে দিশেহারা হয় পাকিস্তান। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক আইন ভেঙে এ বার নয়াদিল্লির হাই কমিশন দফতরকে নিশানা করল ইসলামাবাদ। এ দেশের কূটনীতিকদের মৌলিক সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে চাপ বাড়ানোর কৌশল নিয়েছে পশ্চিমের প্রতিবেশী। ফলে দু’দেশের মধ্যে সংঘাতের পারদ যে আরও চড়ল, তা বলাই বাহুল্য।
ইসলামাবাদে ভারতীয় হাই কমিশন দফতরে রান্নার গ্যাস, পানীয় জল এবং সংবাদপত্রের মতো প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ বন্ধ করেছে পাক সরকার। ফলে সেখানে কর্মরত ভারতীয় কূটনীতিক এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে। শাহবাজ় শরিফ সরকারের এই পদক্ষেপকে ‘ইচ্ছাকৃত’ এবং ‘পূর্ব পরিকল্পিত’ বলে উল্লেখ করেছেন এ দেশের বিদেশ মন্ত্রকের পদস্থ কর্তাব্যক্তিরা।
ইসলামাবাদের ভারতীয় হাই কমিশন দফতর পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে সুই নর্দার্ন গ্যাস পাইপলাইন। এত দিন পর্যন্ত এর মাধ্যমেই রান্নার গ্যাস সরবরাহ করত শরিফ প্রশাসন। সূত্রের খবর, বর্তমানে ওই পাইপলাইনে গ্যাস আসা অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। পাশাপাশি, হাই কমিশন দফতরের কর্মীরা বাইরে থেকে আলাদা করে গ্যাস সিলিন্ডারও কিনতেন। সেখানেও ছেদ পড়েছে বলে খবর প্রকাশ্যে এসেছে।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যে সব সংস্থা এত দিন ভারতীয় হাই কমিশনে গ্যাস সিলিন্ডার সরবরাহ করত, হঠাৎ করেই তাদের সেটা বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে পাক সরকার। ফলে কিছুটা বাধ্য হয়েই সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাইছে তারা। অন্য দিকে, রান্নার গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় বিকল্প হিসাবে ভারতীয় হাই কমিশনের কর্মীদের বাজার থেকে চড়া দামে সিলিন্ডার কিনতে হচ্ছে। এতে আর্থিক ভাবে লোকসান হচ্ছে নয়াদিল্লির।
এই সমস্যা শুধুমাত্র জ্বালানির মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে, এমনটা নয়। ইসলামাবাদের ভারতীয় হাই কমিশনের কর্মীরা নিয়মিত পরিস্রুত পানীয় জল পেতেন। পাকিস্তানের একটি সংস্থা ওই জল সরবরাহ করত তাঁদের। অভিযোগ, শরিফ সরকার সেটাও বন্ধ করে দিয়েছে। এ ছাড়া হাই কমিশনের দফতর ও কর্মী আবাসনে ‘কলের জল’ (ট্যাপ ওয়াটার) আসাও অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। ফলে বিপাকে পড়েছেন সেখানে মোতায়েন থাকা বিদেশ মন্ত্রকের কর্মীরা।
এ ছাড়া ভারতীয় হাই কমিশনে স্থানীয় সংবাদপত্রের সরবরাহ নিষিদ্ধ করেছে পাক সরকার। ইসলামাবাদের ‘ঘরোয়া কোন্দল’ নয়াদিল্লি জানতে পারুক, তা চাইছে না শাহবাজ় প্রশাসন। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এ দেশের বিদেশ মন্ত্রকের দফতরটির উপর যাবতীয় নিষেধাজ্ঞা এক বারে জারি করেনি তারা। সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত এবং ‘অপারেশন সিঁদুর’ পরবর্তী সময়ে এই তীব্রতা ধীরে ধীরে বাড়িয়েছে পাকিস্তান।
ভারতীয় কূটনীতিকদের উপরে ইতিমধ্যেই কড়া নজরদারি শুরু করেছে পাক গুপ্তচরবাহিনী আইএসআই (ইন্টার সার্ভিসেস ইনটেলিজেন্স)। মূলত, তাদের নির্দেশেই গ্যাস, জল এবং সংবাদপত্র হাই কমিশনের দফতরে ঢোকা বন্ধ হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, এ ভাবে চাপ বাড়িয়ে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর প্রতিশোধ নিতে চাইছেন রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা।
১৯৬১ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ঠিক রাখতে ‘ভিয়েনা কনভেনশন অন ডিপ্লোম্যাটিক রিলেশন্স’ নামের একটি আইন পাশ হয়। এই আন্তর্জাতিক আইন মানতে বিশ্বের প্রতিটি দেশ বাধ্য। সেখানে বলা হয়েছে, বিদেশি রাষ্ট্রের কূটনীতিকদের নিরাপত্তা ও যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা সংশ্লিষ্ট দেশটিকে দিতে হবে। তাঁদের কাজ করতে যাতে কোনও সমস্যা না হয়, সেটা দেখাও স্থানীয় সরকারের কর্তব্য। এই আইন অনুযায়ী ভিয়েনা কনভেনশন লঙ্ঘন করছে পাকিস্তান।
ইসলামাবাদ অবশ্য ইতিমধ্যেই যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তবে পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে তাতে ‘ইটের বদলে পাটকেল’ নীতি নিতে পারে নয়াদিল্লি। অর্থাৎ, এখানে পাক হাই কমিশনের দফতরে পরিস্রুত পানীয় জল, রান্নার গ্যাস বা সংবাদপত্রের মতো সুযোগ-সুবিধা বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সূত্রের খবর, ইতিমধ্যেই বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর।
২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সিআরপিএফের কনভয়ে বিস্ফোরকবোঝাই গাড়িতে ফিদায়েঁ হামলা চালায় পাক মদতপুষ্ট জইশ-ই-মহম্মদের এক জঙ্গি। ওই ঘটনায় প্রাণ হারান আধা সেনার ৪০ জওয়ান। এর পরই প্রতিশোধ নিয়ে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়ার বালাকোটে জইশের ক্যাম্পে বোমাবর্ষণ করে ভারতীয় বায়ুসেনা। এর পর ভারতীয় হাই কমিশনের দফতরে সংবাদপত্র বন্ধ করেছিল ইসলামাবাদ।
সাবেক কূটনীতিকদের একাংশ অবশ্য মনে করেন, পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে পাকিস্তানে হাই কমিশনের দফতর পুরোপুরি বন্ধ করতে পারে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। পহেলগাঁও হামলার পর ইসলামাবাদের হাই কমিশনের দফতরের কর্মী ও আধিকারিকের সংখ্যা কমিয়ে অর্ধেক করে দেয় নয়াদিল্লি। পাশাপাশি, পাকিস্তানকেও এখানকার দফতরের কর্মী ও আধিকারিকের সংখ্যা হ্রাস করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
গত মে মাসে ‘অপারেশন সিঁদুর’কে নিয়ে চলা ‘যুদ্ধে’ সংঘর্ষবিরতি হতে না হতেই গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে দিল্লির পাক হাই কমিশনের এক আধিকারিককে ‘অবাঞ্ছিত’ (পার্সোনা নন গ্রাটা) ঘোষণা করে বহিষ্কারের নির্দেশ দেয় কেন্দ্র। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভারত ছেড়ে ইসলামাবাদে চলে যেতে হয়েছিল তাঁকে। বিষয়টি নিয়ে পরে বিবৃতিও দেয় বিদেশ মন্ত্রক।
কেন্দ্র জানিয়েছিল, পাক হাই কমিশনের ওই কর্তা ভারতে তাঁর সরকারি মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন কার্যকলাপে লিপ্ত ছিলেন। দিল্লির পাক শীর্ষ কূটনীতিককে (চার্জ ডি’অ্যাফেয়ার্স) তলব করে এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য এবং নির্দেশিকা (কূটনৈতিক পরিভাষায় ডিমার্শ) দেওয়া হয়। তার পরেই তাঁকে বহিষ্কারের নির্দেশ দেয় মোদী সরকার। যদিও সুনির্দিষ্ট করে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ঠিক কী অভিযোগ উঠেছিল, তা স্পষ্ট করেনি বিদেশ মন্ত্রক।
ঠিক ওই সময়েই দিল্লির পাক দূতাবাসের এক আধিকারিককে জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত ‘স্পর্শকাতর তথ্য’ পাচারের অভিযোগে দু’জনকে গ্রেফতার করে পঞ্জাব পুলিশ। ধৃতদের মধ্যে একজন আবার ছিলেন মহিলা। সূত্রের খবর, সেই মামলার তদন্তের সূত্র ধরেই পাক হাই কমিশনের ওই কর্তাকে বহিষ্কার করে কেন্দ্র। এপ্রিলে পহেলগাঁও-কাণ্ডের পর নয়াদিল্লির পাক হাই কমিশনের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা, নৌসেনা উপদেষ্টা এবং বায়ুসেনা উপদেষ্টাকে ‘অবাঞ্ছিত’ ঘোষণা করে মোদী সরকার।
মে মাসে পাক কূটনীতিককে বহিষ্কারের সময় চুপ করে থাকেনি ইসলামাবাদ। নয়াদিল্লির ওই পদক্ষেপের এক দিনের মাথায় একই কায়দায় ভারতীয় হাই কমিশনের এক আধিকারিককে ‘অবাঞ্ছিত’ (পার্সোনা নন গ্রাটা) ঘোষণা করে বহিষ্কার করে শরিফ প্রশাসন। তবে তাঁর বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির কোনও অভিযোগ আনতে পারেননি রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি কর্তারা। শুধু ওই ব্যক্তি সরকারি মর্যাদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন কার্যকলাপে লিপ্ত বলে উল্লেখ করে দায় সারে ইসলামাবাদ।
এ বছরের ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের বৈসরন উপত্যকার পহেলগাঁওয়ে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গি হামলায় প্রাণ হারান পর্যটক-সহ মোট ২৬ জন। এর পরেই ৬৫ বছরের পুরনো সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করে নয়াদিল্লি। সূত্রের খবর, সিন্ধু অববাহিকার সংযোগকারী নদীগুলিতে সেচখাল তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে কেন্দ্রের। তার জন্য ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে সমীক্ষা। প্রস্তাবিত প্রকল্পটির মাধ্যমে সিন্ধুর বাঁ দিকের উপনদী চন্দ্রভাগার জল পাক পঞ্জাব প্রদেশে যাওয়া বন্ধ করতে চাইছে মোদী সরকার।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, সিন্ধু চুক্তি স্থগিত হওয়ায় এর উপরে বাঁধ তৈরিতে কেন্দ্রের কোনও বাধা নেই। সে ক্ষেত্রে পাকিস্তানে তীব্র হবে জলসঙ্কট। ফলে নানা ভাবে ভারতের উপরে চাপ তৈরি করে চুক্তির উপর থেকে স্থগিতাদেশ তোলাতে চাইছে ইসলামাবাদ। হাই কমিশনের কূটনীতিকদের দৈনন্দিন জীবন ব্যাহত করা তারই অঙ্গ বলে মনে করা হচ্ছে।
এই ইস্যুতে সম্প্রতি নয়াদিল্লিকে চরম হুঁশিয়ারি দিয়েছেন পাক সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। ‘দ্য প্রিন্ট’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী মার্কিন মুলুকের ফ্লরিডায় একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘‘ভারত বাঁধ তৈরি করুক, আমরা অপেক্ষা করব। যখন বাঁধের কাজ শেষ হয়ে যাবে, তখনই ১০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে সেটা ধ্বংস করে দেব। সিন্ধু নদী ওদের পৈতৃক সম্পত্তি নয়। আর আমাদের কাছেও ক্ষেপণাস্ত্রের কোনও অভাব নেই।’’
ফিল্ড মার্শাল মুনিরের পাশাপাশি সিন্ধু জল চুক্তি নিয়ে নয়াদিল্লিকে হুমকি দিয়েছেন শরিফ সরকারের অন্যতম শরিক ‘পাকিস্তান পিপল্স পার্টি’ বা পিপিপির চেয়ারম্যান তথা সাবেক বিদেশমন্ত্রী বিলাবল ভুট্টো জারদারি। দক্ষিণ-পূর্ব পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘যুদ্ধে (নরেন্দ্র) মোদীকে মোকাবিলা করার ক্ষমতা আমাদের আছে।’’ ভারতের সঙ্গে আর এক দফা যুদ্ধ হলে পাকিস্তান সিন্ধু এবং তার পাঁচটি উপনদীরই দখল নেবে বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
এর পাশাপাশি গত ৮ অগস্ট সিন্ধু চুক্তি নিয়ে সালিশি আদালতের দেওয়া রায়কে স্বাগত জানিয়েছে ইসলামাবাদ। ইসলামাবাদের দাবি, সেখানে বলা হয়েছে ভারতকে পশ্চিমের নদীগুলি থেকে জল ছাড়তে হবে, যাতে সেটা পাকিস্তান ‘অবাধে ব্যবহার’ করতে পারে। যদিও সালিশি আদালতের রায়কে স্বীকৃতি দেয়নি নয়াদিল্লি। পাশাপাশি, মুনিরের হুঁশিয়ারির কড়া বিবৃতি দিয়েছে মোদী সরকারের বিদেশ মন্ত্রক।
প্রধানমন্ত্রী মোদী অবশ্য স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যে, ‘‘নদীর জল ও রক্ত একসঙ্গে বইতে পারে না। সীমান্ত পার সন্ত্রাসবাদ বন্ধ না হলে সিন্ধু জল চুক্তির উপর থেকে স্থগিতাদেশ কখনওই সরাবে না ভারত।’’ ১৯৬০ সালে হওয়া এই চুক্তির মধ্যস্থতাকারী ছিল বিশ্ব ব্যাঙ্ক। দীর্ঘ ন’বছর আলোচনা চলার পর চুক্তিটি বাস্তবের মুখ দেখেছিল। চুক্তিতে সই করতে ওই সময়ে করাচি সফর করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু।