হাতের কাছে বিদেশ বলতে আমাদের যে দেশটির কথা সাধারণত মাথায় আসে সেটি হল তাইল্যান্ড। কম খরচে বিদেশভ্রমণের স্বাদ চাখিয়েছে এই দেশটি। ভারতের পূর্বের প্রতিবেশী মায়ানমার। তার ঠিক পূর্ব সীমান্তে রয়েছে তাইল্যান্ড। তাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাঙ্কক জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র। ভারত থেকে প্রতি বছর অগণিত পর্যটক ব্যাঙ্ককে ঘুরতে যান। বাঙালি পর্যটকের সংখ্যাও নেহাত কম নয়।
নীল সমুদ্র, ঝকঝকে আকাশ, বালিয়াড়ির টানে ভারতীয়দের বিদেশভ্রমণের তালিকায় তাইল্যান্ড পরিচিত নাম। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটির নীল জলের সমুদ্র, মনোরম সৈকত, পাহাড়, পর্বত, ঐতিহাসিক স্থাপত্যের মিশেল পর্যটকদের কাছে বরাবরই লোভনীয় গন্তব্য।
আকাশছোঁয়া বহুতল, ঝাঁ-চকচকে রাস্তা, বৌদ্ধমন্দিরের টানও কম নয়। তবে তাইল্যান্ডে বেড়াতে গেলে যার অমোঘ আকর্ষণ এড়াতে পারেন না বহু পর্যটক সেটি হল তাই মাসাজ। কথায় আছে তাইল্যান্ডে যাঁরা মাসাজের পরিষেবা দেন তাঁদের হাতে নাকি জাদু আছে।
দেশের অর্থনীতিও অনেকটাই পর্যটন-নির্ভর। তাইল্যান্ডের পর্যটকদের বড় অংশই যান চিন এবং ভারত থেকে। সারা বছর ধরে পর্যটকদের আনাগোনা দেখে মনে হতে পারে দেশটির অর্থনীতির মেরুদণ্ড শক্ত রাখার জন্য পর্যটনশিল্প প্রধান চালিকাশক্তি। একমুখী অর্থনীতির দ্বারা পরিচালিত তাইল্যান্ড— এই সরল সমীকরণটি সম্পূর্ণ ভুল।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটি বহুমুখী অর্থনীতির দ্বারা চালিত। পর্যটনের পাশাপাশি কৃষি, রফতানি, শিল্প এবং পরিষেবাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাইল্যান্ডের জিডিপিতে পর্যটনশিল্প ২০ শতাংশ অবদান রাখলেও বাকি ক্ষেত্রগুলিও জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে বড়সড় ভূমিকা নেয়।
বিশ্বের অধিকাংশ দেশেরই ধারণা তাইল্যান্ড পর্যটন ও মাসাজের ব্যবসার বলে বলীয়ান হওয়া একটি অর্থনীতি। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। জেনে নেওয়া যাক অন্যান্য কোন কোন খাতের মাধ্যমে দেশটির অর্থনীতি মজবুত হয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ার পর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ তাইল্যান্ড। ২০১২ সালে সে দেশের মাথাপিছু আয় ছিল ৫ হাজার ৩৯০ ডলার। গোটা এশিয়ার নবম বৃহত্তম অর্থনীতির তকমা উঠেছে তাইল্যান্ডের গায়ে।
গোটা বিশ্বের চালের চাহিদার সিংহভাগ মেটায় তাইল্যান্ড। এটি বিশ্বের বৃহত্তম চাল রফতানিকারক দেশ। একটি বিশেষ গন্ধযুক্ত চালের কদর রয়েছে গোটা বিশ্বে। সেটি হল জেসমিন রাইস বা ‘জুঁই চাল’। স্থানীয় ভাষায় এর নাম তাই হোম মালি বা তাই সুগন্ধি চাল। আন্তর্জাতিক বাজারে খুবই জনপ্রিয় এই সুগন্ধি চাল।
জেসমিন রাইস তার স্বাদ, সুগন্ধ এবং আকৃতির জন্য পরিচিত। চিন, ইন্দোনেশিয়া, আমেরিকা, সাউথ আফ্রিকা, ইরাকের মতো দেশগুলিতেই মূলত এই চাল রফতানি করে বিদেশি মুদ্রার ভান্ডার ভরায় তাইল্যান্ড। ২০২১ সালে শুধু চাল পাঠিয়েই ৬০০ কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা তহবিল গড়েছিল দেশটি। ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে অবশ্য সেই পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। চলতি বছর ৭৫ লাখ টন চাল অন্যান্য দেশে রফতানির পরিকল্পনা রয়েছে ব্যাঙ্ককের।
পর্যটনের পাশাপাশি তাইল্যান্ড চাষবাসেও প্রভূত উন্নতি করেছে। দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ জীবিকা নির্বাহের জন্য কৃষির উপর নির্ভরশীল। চাল ছাড়াও যে সব ফসলের বিদেশে রফতানির চাহিদা রয়েছে তাদের মধ্যে রাবার, ভুট্টা, গ্রীষ্মকালীন ফল অন্যতম। বিশেষ করে সামুদ্রিক খাবার আর ফল চাষে আন্তর্জাতিক বাজারে এখন বিশেষ কদর দক্ষিণ এশীয় দেশটির।
চিংড়ি, স্কুইড এবং মাছের বিশাল রফতানির বাজার গড়ে উঠেছে এ দেশের বন্দরগুলিকে কেন্দ্র করে। গ্রামীণ অর্থনীতির হালও মজবুত করেছে মৎস্যকেন্দ্রগুলি।
তাইল্যান্ডকে ‘এশিয়ার ডেট্রয়েট’ বলা হয়। কারণ এখানে জাপান, আমেরিকা এবং ইউরোপীয় সংস্থাগুলিকে ঘিরে অটোমোবাইল শিল্প বিকশিত হয়েছে। বিদেশি গাড়ি নির্মাতা সংস্থাগুলির উৎপাদনকেন্দ্র রয়েছে প্রধান শহরগুলিতে।
টয়োটা, হোন্ডা, ফোর্ড এবং ইসুজুর মতো সংস্থাগুলি বৃহৎ পরিসরে যানবাহন তৈরি করে। এ ছাড়াও ইলেকট্রনিক্স, কম্পিউটার হার্ডঅয়্যার এবং বয়নশিল্পের উন্নয়ন তাইল্যান্ডের শিল্পশক্তির উত্থানের গুরুত্বপূর্ণ কারণ। দেশীয় শিল্পের প্রসার এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, উভয় ক্ষেত্রেই যথেষ্ট অবদান রেখেছে এই শিল্পগুলি।
তাইল্যান্ডের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রায় ৬০ শতাংশ নির্ভর করে কৃষিজাত পণ্য, যানবাহন এবং ইলেকট্রনিক্স পণ্য রফতানির উপর। প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদারদের মধ্যে রয়েছে চিন, জাপান, আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলি।
পর্যটনও আয়ের একটি প্রধান উৎস। ২০২৪ সালে প্রায় ৩ কোটি ৫০ লক্ষ বিদেশি পর্যটক সে দেশে পা রেখেছিলেন। এর ফলে প্রায় ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার জমা পড়েছিল সে দেশের সরকারি তহবিলে।
বহু পর্যটকের মতে, তাইল্যান্ড হল পর্যটন-পরিকাঠামোয় অন্যতম সেরা দেশ। আবার অনেকের ধারণা রয়েছে তাইল্যান্ড মানেই সেক্স-ট্যুরিজ়ম। তাইল্যান্ডের যা প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে তা দিয়ে বিশ্বমানের পরিষেবা তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করে সে দেশের সরকার।
পাটায়ার বিখ্যাত ওয়াকিং স্ট্রিট পর্যটকদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। নৈশ প্রমোদের অন্যতম কেন্দ্র এই অঞ্চলটি। সেখানে যৌনব্যবসা ভীষণ ভাবে প্রচলিত। কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি রয়েছে প্রশাসনের হাতে।
সীমিত সম্পদ ও নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তাইল্যান্ড নিজেকে গড়ে তুলেছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসাবে। এশিয়া তো বটেই, ইউরোপ, আমেরিকার বহু বড় বড় বাণিজ্যিক সংস্থা এখানে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ খুঁজে পেয়েছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ব্যবসা-বান্ধব নীতির কারণে তাইল্যান্ড বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি পছন্দের গন্তব্য হয়ে উঠছে।
প্রাকৃতিক গ্যাস, টিন এবং টাংস্টেনের মতো খনিজ পদার্থের উৎপাদন ক্ষেত্রগুলিতে বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে জাপান, আমেরিকা এবং চিনের বহুজাতিক সংস্থাগুলি। এ ছাড়া স্বাস্থ্যসেবা, বিশেষ করে চিকিৎসা পর্যটন দেশটিকে আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
এ সবই সম্ভব হয়েছে দেশটির সুশাসনের কারণে। একটা বিষয় অনস্বীকার্য যে, কোনও দেশে সুশাসন না থাকলে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। সঙ্গে ছিল উন্নত প্রযুক্তিভিত্তিক পরিকাঠামো, নতুন নতুন ব্যবসার সুপরিকল্পিত উদ্যোগের বাস্তবায়ন। বাহ্যিক এবং মানবসম্পদ পরিকাঠামোকে বৈশ্বিক মানদণ্ডের নিরিখে গড়ে নজির তৈরি করেছে তাইল্যান্ড।