১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি। প্রেক্ষাগৃহে তখন মুক্তি পেয়েছে শশী কপূর, অমিতাভ বচ্চন, পরভিন ববি, নীতু সিংহ অভিনীত যশ চোপড়ার ‘দিওয়ার’। ‘মেরে পাস মা হ্যায়’ সংলাপটি তখন দর্শকের মুখে মুখে। এই ছবিতে ‘বিজয়’ নামের চরিত্রে অভিনয় করে বলিউডে ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’ হিসাবে নিজের পরিচিতি তৈরি করে ফেলেন অমিতাভ।
এই সিনেমায় বিজয়ের ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করে নজর কেড়ে নিয়েছিলেন এক শিশুশিল্পী। স্বল্পদৈর্ঘ্যের চরিত্র হলেও সেই অভিনয় দিয়ে দর্শকের মন জয় করে নিয়েছিলেন সেই খুদে অভিনেতা। ৭০ ও ৮০-র দশকের একাধিক সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন তিনি। বলিজগতে পরিচয় গড়ে তুলেছিলেন শক্তিশালী শিশুশিল্পীর। শতাধিক সিনেমায় মুখ দেখিয়েছিলেন সেই খুদে অভিনেতা।
‘সীতা অউর গীতা’, ‘মজবুর’ এবং ‘দিওয়ার’-এর মতো ক্লাসিক ছবি দিয়ে বলিউডের জমিতে পা রেখেছিলেন অলঙ্কার জোশী। শুরুটা মন্দ না হলেও ধীরে ধীরে বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে যান এই অভিনেতা। সেই যুগের জনপ্রিয় তরুণ প্রতিভা হিসাবে পরিচালকদের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছিলেন তিনি। শিশু অভিনেতার চরিত্রে উল্কার গতিতে উত্থান হলেও কালক্রমে বলিপাড়া থেকে উধাও হয়ে গিয়েছেন তিনি।
সেই অলঙ্কার এখন সফল ব্যবসায়ী। দেশ ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে আমেরিকা প্রবাসী। প্রায় ৩৫ বছর তিনি দেশছাড়া। বলিউ়়ডে কেরিয়ার গড়তে না পেরে সিনেমাকে বিদায় জানিয়েছিলেন অলঙ্কার। তবে বলিউড তারকা হতে না পারলেও তাঁর বাণিজ্যে বসত করেছে লক্ষ্মী। একদা শিশুশিল্পী হিসাবে কেরিয়ার শুরু করা অলঙ্কার আজ সফল ব্যবসায়ী।
‘দিওয়ার’ ছবিতে অমিতাভের চরিত্র বিজয়ের ছোটবেলার ভূমিকায় তাঁর অভিনয় আজও সিনেমাপ্রেমীদের মনে গেঁথে আছে। এ ছাড়া ‘শোলে’ ছবিতেও ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অলঙ্কার। তবে ‘দিওয়ার’ ছবিতে অলঙ্কারের অভিনয় করাটা আকস্মিকই। কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা যশ চোপড়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর অনুঘটকের কাজ করেন অমিতাভ।
দিলীপ কুমার এবং ঋষি কপূরের মতো অভিনেতাদের সঙ্গেও কাজ করেছেন অলঙ্কার। শশী কপূর অভিনীত ‘কিস্সা কাঠমান্ডু মে’ টেলিভিশন সিরিজ়ে তোপসের ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখা গিয়েছিল অলঙ্কারকে।
অলঙ্কারের পরিবারের সদস্যেরা বলিউডের নামজাদা অভিনেতা ও পরিচালক। অলঙ্কারের এক দিদি জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত অভিনেত্রী পল্লবী জোশী। তার বড় দিদি পদ্মশ্রী জোশীও মরাঠী সিনেমার বিশিষ্ট অভিনেত্রী। পল্লবীর স্বামী ‘কাশ্মীর ফাইল্স’খ্যাত পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী। পল্লবী এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, ‘দিওয়ার’ ছবিতে নিজের ছোটবেলার চরিত্রের জন্য তাঁর ভাইকে পছন্দ করেছিলেন স্বয়ং বলিউডের শাহেনশাহই।
পল্লবী স্মৃতিচারণ করে বলেন, “‘দিওয়ার’-এর জন্য আমার ভাইকে ডাকা হয়েছিল। আমরা যশ চোপড়ার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। এই দিন আমিও অলঙ্কারের সঙ্গী হয়েছিলাম। যখন আমরা সেটে দেখা করতে গিয়েছিলাম সেই দিনের একটা ঝাপসা স্মৃতি মনে আছে।’’
পল্লবী জানান, ইতিমধ্যেই ছবির শুটিং শুরু হয়ে গিয়েছিল। অমিতাভ বচ্চন ভাইকে দেখে চিনতে পারেন ও নিজেই খোঁজখবর করতে শুরু করেন। তার পর তিনি পরিচালককে অনুরোধ করেন যেন তাঁর ছোটবেলার চরিত্রে অভিনয় করার জন্য অলঙ্কারকে সুযোগ দেওয়া হয়। নায়কের অনুরোধ মেনে নেন যশ চোপড়া।
১৯৭৫ সালে মুক্তি পায় যশ চোপড়া পরিচালিত ‘দিওয়ার’। এ ছবির একাধিক সংলাপ ভারতীয় চলচ্চিত্রের অসংখ্য অনুরাগীর কাছে আজও অত্যন্ত জনপ্রিয়। সে বছর একাধিক পুরস্কার জিতেছিল তারকাখচিত এই ছবিটি।
শিশু ও কিশোর বয়সে অভিনেতা হিসাবে সেঞ্চুরি পার করেও পরবর্তী কালে নায়ক বা অভিনেতা হিসাবে নিজেকে উপস্থাপিত করতে পারেননি অলঙ্কার। ৯০-এর দশকে তাঁর হাতে থাকা ছবির সংখ্যা কমে আসতে শুরু করে। একটি সাক্ষাৎকারে অলঙ্কার তাঁর শৈশবের দিনগুলির কথা মনে করে স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়েছিলেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুটিং, রাতেও কাজ করতে হত। জনসমক্ষে বেরোলেই অনুরাগীদের ছেঁকে ধরা। সবই উপভোগ করেছেন ৭০ ও ৮০-এর দশকে।
তিনি বলেছিলেন, ‘‘হিন্দি চলচ্চিত্র জগতের কিংবদন্তিদের সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। বেশির ভাগ মানুষের সঙ্গে আমার ভাল সম্পর্ক ছিল। কেউ কেউ অত্যন্ত স্নেহ করতেন। আজ আমি নিজেকে এক জন অবসরপ্রাপ্ত বলেই ভাবি। অভিনয় সঙ্গে সম্পর্ক শেষ, রয়ে গিয়েছে শুধু স্মৃতি।’’
৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে বলিউডে কাজ কমতে থাকায় কিছু দিন মরাঠী সিনেমায় নির্দেশনা এবং প্রযোজক হিসাবে কাজ করতে শুরু করেন অলঙ্কার। তাতেও বিশেষ সুবিধা করতে না পেরে রুপোলি দুনিয়ার সঙ্গে সমস্ত যোগসূত্র ছিন্ন করে পাড়ি দেন আমেরিকায়। অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি লেখাপড়াও সমান তালে চালিয়ে গিয়েছিলেন। বিদেশে গিয়ে সফ্টঅয়্যার প্রোগ্রামিংয়ের কেরিয়ারে মনোনিবেশ করেন।
একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় দু’বছর কাজ করার পর অলঙ্কার এক বন্ধুর সঙ্গে যৌথ ভাবে নিজের সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। তিন দশক কেটে গিয়েছে। ধাপে ধাপে সেই সংস্থাকে ২০০ কোটি টাকার ব্যবসায় পরিণত করেছেন তিনি।
প্রায় ৩৫ বছর ধরে আমেরিকায় বসবাস করছেন অলঙ্কার। স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে সুখী সংসার তাঁর। তিনি অভিনয় ছাড়লেও তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের রক্তের মধ্যে চারিয়ে গিয়েছে অভিনয়ের শিক়ড়। অলঙ্কারের যমজ কন্যা, আনিশা এবং অনুজা জোশী হলিউডের সঙ্গে যুক্ত। একমাত্র পুত্র সঙ্গীতজগতে নিজের পরিচিতি গড়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
অলঙ্কারের মতো সেই যুগের অনেক শিশু অভিনেতাই রুপোলি পর্দা থেকে দূরে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁরাও কালের নিয়মে দর্শকের মন থেকে মুছে গিয়েছেন। বলিউডে শিশু অভিনেতা হিসাবে জনপ্রিয়তা পাওয়ার পরও সাফল্যের সিঁড়ি চড়তে না পেরে ভেঙে পড়েননি অলঙ্কার। খ্যাতির অস্থিরতা বুঝতে পেরে সময়মতো দূরদর্শিতার পরিচয় দেন। খ্যাতির আকর্ষণ তাঁকে কখনও পিছু ফিরতে বাধ্য করেনি। তাই তিনি আজ কয়েকশো কোটির সফল ব্যবসায়ী।