Volodymyr Zelenskyy

গলাধাক্কা খাওয়া ঘরে সসম্মানে প্রবেশ, নেটোর অনুচ্ছেদের সুচতুর ব্যবহার, ট্রাম্প-সাক্ষাতে জ়েলেনস্কি বোঝালেন তিনিই ‘বস্’!

ছ’মাসের ব্যবধানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ফের এক বার বৈঠক সারলেন ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কি। সেখানে ফিরে পেলেন সম্মান। নিরাপত্তার নামে আশ্বাস পেয়েছেন সৈন্য ও হাতিয়ার সরবরাহের।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০২৫ ১১:১৪
Share:
০১ ১৮

মাত্র ছ’মাসের ব্যবধান। তাতেই বদলে গেলে যাবতীয় হিসাব। যা যা চেয়েছেন, প্রায় সব কিছুই আদায় করে ছাড়লেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, যে ঘর থেকে ‘চরম অপমান’ করে তাড়িয়ে দেন ‘সুপার পাওয়ার’ প্রেসিডেন্ট, সেখানেই সম্মানের সঙ্গে বরণ করতে হয়েছে তাঁকে। বাধ্য হয়ে তাঁর কাঁধে পর্যন্ত হাত রাখেন ‘মহাশক্তিধর প্রেসিডেন্ট’। এককথায়, বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে শরীরী ভাষায় একটাই কথা বুঝিয়েছেন তিনি। আর সেটা হল, ‘আই অ্যাম দ্য বস্’!

০২ ১৮

তিনি, ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কি। ছ’মাস পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ ফের এক বার খবরের শিরোনামে এনে দিয়েছে তাঁকে। কূটনীতিকদের একাংশের দাবি, এ বার আর ‘সব হারানো’র দলে নয়, ইতিহাসখ্যাত সুচতুর রাষ্ট্রনেতাদের তালিকায় জায়গা পাবেন জ়েলেনস্কি। দেশভাগ ঠেকানো থেকে শুরু করে কিভের নিরাপত্তা— সব কিছুর প্রতিশ্রুতি আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। ফলে ট্রাম্পের সঙ্গে অনেকেই তুলনা টানছেন তাঁর।

Advertisement
০৩ ১৮

চলতি বছরের ১৮ অগস্ট। যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনের ঐতিহ্যশালী ‘শ্বেত প্রাসাদ’-এর (পড়ুন হোয়াইট হাউস) ওভাল অফিসে ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করেন জ়েলেনস্কি। সেখানে গণমাধ্যমের সামনে প্রকাশ্যেই তাঁকে ‘অপমান’ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। স্পষ্ট বলে দেন, ‘‘রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে হারতে চলেছেন আপনি।’’ এর পাশাপাশি তাঁর নির্দেশ মেনে মস্কোর সঙ্গে সংঘর্ষবিরতিতে যেতে জ়েলেনস্কিকে পরামর্শ দেন ট্রাম্প। যদিও পত্রপাঠ তা খারিজ করে দেন ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট।

০৪ ১৮

ওই দিন হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে গণমাধ্যমের সামনে ‘কথা কাটাকাটি’তে জড়ান জ়েলেনস্কি। ফলে ক্ষুব্ধ ট্রাম্প সেখান থেকে ‘দূর দূর’ করে তাড়িয়ে দেন তাঁকে। পাশাপাশি বন্ধ করেন কিভকে দেওয়া যাবতীয় সামরিক সাহায্য। এমনকি আমেরিকার থেকে কৃত্রিম উপগ্রহভিত্তিক তথ্য পাওয়ার আশাও ছাড়তে হয় ইউক্রেনীয় ফৌজকে। তার পরেও দমে না গিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন জ়েলেনস্কি। পাশাপাশি, তলে তলে ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানি-সহ পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রক্ষা করে গিয়েছেন তিনি।

০৫ ১৮

বিশ্লেষকদের দাবি, জ়েলেনস্কির এই কূটকৌশলে লাভবান হয় কিভ। মার্কিন সাহায্য বন্ধ হলেও পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলির থেকে হাতিয়ার পেতে কোনও সমস্যা হয়নি তাঁর। ফলে কৌশলগত আক্রমণ চালিয়ে কিছু ক্ষেত্রে রুশ ফৌজকে ব্যতিব্যস্ত করতে সক্ষম হয় ইউক্রেনীয় সেনা। এর জেরে অচিরেই ফের ভয়ঙ্কর আকার নিতে থাকে পূর্ব ইউরোপের যুদ্ধ। ট্রাম্পও বুঝতে পারেন ওই এলাকায় শান্তি ফেরানো মোটেই সহজ নয়।

০৬ ১৮

গত ১৫ অগস্ট ইউক্রেন যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটাতে যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন ট্রাম্প। সেই খবর কানে যেতেই প্রমাদ গোনেন জ়েলেনস্কি। ছুটে যান জার্মানি, কথা বলেন পশ্চিম ইউরোপের একাধিক রাষ্ট্রনেতার সঙ্গে। পাশাপাশি, স্পষ্ট জানিয়ে দেন যে কোনও অবস্থাতেই দেশভাগ মানবেন না তিনি। গত সাড়ে তিন বছর ধরে দখল করা পূর্ব ইউক্রেনের ডনবাস এলাকা যে কোনও অবস্থাতেই ছাড়া হবে না, তা অবশ্য তত দিনে স্পষ্ট করে দিয়েছে মস্কো।

০৭ ১৮

পুতিনের সঙ্গে একপ্রস্ত আলোচনা সেরে জ়েলেনস্কি-সহ ইউরোপীয় নেতাদের হোয়াইট হাউসে ডেকে পাঠান ট্রাম্প। ১৮ অগস্ট সেখানে তাঁদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। ওই দিনই অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে ইউক্রেন প্রেসিডেন্টকে অভ্যর্থনা জানান যুক্তরাষ্ট্রের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। করমর্দনের পাশাপাশি তাঁর কাঁধে হাত রাখতেও দেখা যায় ট্রাম্পকে। আগের বারের মতো এ বার আর জ়েলেনস্কিকে ‘অকৃতজ্ঞ’ বলে ভর্ৎসনা করেননি তিনি।

০৮ ১৮

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, গোটা ঘটনায় ইউক্রেন প্রেসিডেন্টের কূটনৈতিক সাফল্য প্রশংসনীয়। তিনি যে ‘ফেলনা’ নন, তা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন জ়েলেনস্কি। পাশাপাশি, তাঁকে বাদ দিয়ে পূর্ব ইউরোপের শান্তি আলোচনা যে ফলপ্রসূ হবে না, তা-ও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। এর জেরে ট্রাম্পের পক্ষে গোপনে মস্কোর সঙ্গে কোনও সমঝোতা করে নেওয়া সম্ভব নয়। ‘সুপার পাওয়ার’ রাশিয়ার সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাওয়ায় সকলের সমীহ আদায় করেছেন ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট।

০৯ ১৮

হোয়াইট হাউসের বৈঠকে মানচিত্র খুলে ইউক্রেনের কোন কোন এলাকা রাশিয়া দখলে রেখেছে, তা ট্রাম্পের সামনে ব্যাখ্যা করেন জ়েলেনস্কি। এগুলির দাবি এখনই যে তিনি ছেড়ে দিচ্ছেন এমনটা নয়। পাশাপাশি, শান্তি সমঝোতায় নিরাপত্তার ‘গ্যারান্টি’ চেয়েছেন ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট, যা তাঁকে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। সেই আশ্বাস আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ইউরোপীয় শক্তিজোট ‘উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা’ বা নেটোয় (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) যাওয়ার শামিল, বলছেন বিশ্লেষকেরা।

১০ ১৮

৩২ দেশের সামরিক সংগঠন নেটোর পাঁচ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, যদি কোনও রাষ্ট্র তাদের কাউকে আক্রমণ করে, তা হলে সকলে মিলে হামলাকারী দেশটির উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ঠিক এই কারণে ইউক্রেন ওই সংগঠনে যেতে চাওয়ায় তাতে প্রাথমিক ভাবে বাধা দিয়েছিল রাশিয়া। কিন্তু কিভ নাছোড়বান্দা হওয়ায় শেষ পর্যন্ত পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটিকে আক্রমণের নির্দেশ দেন পুতিন। সূত্রের খবর, যুক্তরাষ্ট্র থেকে নেটোর পাঁচ নম্বর অনুচ্ছেদের মতো সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন জ়েলেনস্কি। অর্থাৎ, মস্কোর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অন্যান্য শক্তিশালী রাষ্ট্রের সামরিক সাহায্য নিশ্চিত করতে পেরেছেন তিনি।

১১ ১৮

ইউরোপীয় দেশগুলির সাফ বক্তব্য, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামানোর ক্ষেত্রে কিভের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে, যাতে আগামী দিনে মস্কো কখনওই আর হামলা না চালায়। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ‘নিউ ইয়র্ক টাইম্স’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ ব্যাপারে বিশেষ একটি বাহিনী তৈরির কথা বলেছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মার। যেটা হবে ‘ইচ্ছাশক্তির জোট’ বা ‘কোয়ালিশান অফ দ্য উইলিং’। যদিও তাতে কোন কোন দেশের সৈনিক থাকবে, তা স্পষ্ট নয়।

১২ ১৮

ট্রাম্প অবশ্য ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন, ইউক্রেনে কোনও সৈন্য মোতায়েন করবেন না তিনি। কিভের দেশটির নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে হবে ইউরোপের অন্যান্য দেশকেই। কিন্তু, তা সত্ত্বেও এটা স্পষ্ট যে নেটোর পাঁচ নম্বর অনুচ্ছেদের মতো নিরাপত্তা পেলে জ়েলেনস্কির আর ওই সংগঠনে যোগ না দিলেও চলবে। সে ক্ষেত্রে নেটোয় যোগ না দিয়েও রুশ আগ্রাসন ঠেকাতে যা যা প্রয়োজন সবই পেয়ে যাবেন তিনি।

১৩ ১৮

দ্বিতীয়ত, গত ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনকে সমরাস্ত্র সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ করে দেন ট্রাম্প। কিন্তু এ বার সেটাও আদায় করতে সমর্থ হয়েছেন জ়েলেনস্কি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, ৯০ হাজার কোটি ডলারের হাতিয়ার কিভকে দেবেন তিনি। তবে সরাসরি ওই অস্ত্র পাবে না ইউক্রেনীয় সেনা। যুক্তরাষ্ট্রের হাতিয়ার কিনবে পশ্চিম ইউরোপের একাধিক দেশ। এর পর সেগুলি জ়েলেনস্কির ফৌজকে সরবরাহ করবে তারা।

১৪ ১৮

তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকের পর হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে একা যাননি জ়েলেনস্কি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মার, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ, জার্মান চ্যান্সেলার ফ্রিডরিখ মেয়ার্ৎজ়, ইটালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, নেটোর মহাসচিব মার্ক রাট এবং ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন। এঁরা প্রত্যেকেই ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের উপর পাল্টা চাপ তৈরি করতে সক্ষম হন ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট।

১৫ ১৮

নিজের দফতরে ইউরোপীয় রাষ্ট্রপ্রধানদের অবশ্য সে ভাবে সম্মান দেখাননি ট্রাম্প। তাঁর বসার টেবিলের সামনে থাকা শীর্ষ আধিকারিকদের চেয়ারেই বসতে হয় ইউরোপীয় রাষ্ট্রপ্রধানদের। পরে সেই ছবি সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় অনেকেই মার্কিন প্রেসিডেন্টের সমালোচনা করেন। এ ব্যাপারে এক্স হ্যান্ডলে (আগে নাম ছিল টুইটার) ভারতের প্রাক্তন কূটনীতিক কানওয়াল সিব্বল লেখেন, ‘‘দেখে মনে হচ্ছে অধস্তন কর্মীদের নির্দেশ দিচ্ছেন ট্রাম্প। ইউরোপীয় নেতাদের কাছে এর চেয়ে অপমানের আর কিছু নেই।’’

১৬ ১৮

ট্রাম্পের অন্ধ সমর্থকেরা অবশ্য এ সব অভিযোগকে কানেই তুলছেন না। তাঁদের যুক্তি, ইউরোপ যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কথা শুনতে বাধ্য, তা আরও এক বার প্রমাণ করে দিয়েছেন তিনি। কূটনীতিকেরা অবশ্য মনে করেন, এতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আগামী দিনে এর চরম মূল্য দিতে হতে পারে আমেরিকাকে।

১৭ ১৮

গত ১ জুন রাশিয়ার একাধিক বিমানঘাঁটিতে ড্রোন হামলা চালায় ইউক্রেন। সেই আক্রমণে ধ্বংস হয় পরমাণু হাতিয়ার বহনে সক্ষম মস্কোর বেশ কয়েকটি কৌশলগত বোমারু বিমান। এই হামলার পোশাকি নাম ‘অপারেশন স্পাইডার ওয়েব’ রাখে জ়েলেনস্কির গুপ্তচরবাহিনী। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, এর জেরেই এখনও নিজের গুরুত্ব ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট।

১৮ ১৮

আগামী দিনে জ়েলেনস্কি ও পুতিনের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় বসার ইঙ্গিত দিয়েছেন ট্রাম্প। মস্কোয় সেই বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু যে ভাবে ইউরোপীয় নেতাদের পাশে নিয়ে ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট নিজের গুরুত্ব বাড়াচ্ছেন, তাতে সমাধানসূত্র বার হওয়া বেশ কঠিন। উল্টে এতে ট্রাম্পের মুখ পোড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে জল কোন দিকে গড়ায় সেটাই এখন দেখার।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement