ইরমা গ্রেসে। মনে করা হয়, নাৎসিদের কুখ্যাত আউশভিৎজ় ঘাঁটিতে বন্দি ইহুদিদের উপর পুরুষ নাৎসি বাহিনী যে পরিমাণ অত্যাচার চালিয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি অত্যাচার চালিয়েছিলেন এই নাৎসি মহিলা।
আডল্ফ হিটলারের নাৎসি বাহিনীর ইয়োসেফ মেঙ্গেলে থেকে শুরু করে জোসেফ গোয়েবলস পর্যন্ত, যে অত্যাচারী সেনানায়কদের কথা ইতিহাসে উঠে এসেছে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ইরমা। ইহুদিদের উপর অত্যাচারের বহরের জন্য তাঁকে বলা হত ‘দ্য হায়না অফ আউশভিৎজ়’। এ ছাড়াও অত্যাচারী মনেোভাবের জন্য ‘দ্য বিস্ট অফ বেলসেন’ তকমাও পেয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু তিনি যে এত অত্যাচারী, তা তাঁর চোখ দেখে বোঝার উপায় ছিল না। তাঁর চোখ দু’টি নাকি এত উজ্জ্বল আর নিষ্পাপ ছিল যে, তা কল্পনার অতীত। ইরমার নীলবর্ণ আঁখির দিকে তাকিয়ে তেমনটাই মনে হয়েছিল আউশভিৎজ়ের শিবিরে বন্দি মহিলা চিকিৎসক গ্রিসেলা পার্লের। এমন চোখধাঁধানো এবং ডাকসাইটে সুন্দরী তিনি কমই দেখেছিলেন বলে জানিয়েছিলেন জ়িজ়েলা।
নাৎসি শিবিরের সেই সুন্দরী রক্ষী ইরমার চোখ দু’টি যতই নিষ্পাপ হোক না কেন, তাঁর বিরুদ্ধে অসংখ্য ইহুদি বন্দির উপর অকথ্য অত্যাচারের অভিযোগ উঠেছিল। এমনকি, বন্দিদের ধর্ষণের অভিযোগও উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে।
বন্দিদশার বিবরণ দিতে গিয়ে ইরমার কথা তুলে আউশভিৎজ়ের শিবিরে বন্দি সেই চিকিৎসক গ্রিসেলা এক বার লিখেছিলেন, ‘‘ইরমার মতো এত সুন্দরী কখনও দেখিনি। তার শরীরের প্রতিটি ভাঁজ ছিল নিখুঁত। পরিদের মতো স্বচ্ছ মুখাবয়ব। নীল বর্ণের চোখ দু’টি এত নিষ্পাপ, যে কল্পনা করা যায় না। ইরমা গ্রেসে ছিলেন আমার দেখা সবচেয়ে নিষ্ঠুর এবং কল্পনাতীত বিকৃতমতি।’’
১৯২৩ সালের ৭ অক্টোবর জার্মানির উত্তরাঞ্চলে ভ্রেখেনে ইরমার জন্ম। বার্লিন থেকে প্রায় ৮১ কিলোমিটার দূরে মেকলেনবুর্গ এলাকায় বসবাস করতেন ইরমার মা-বাবা বের্টা এবং আলফ্রেড গ্রেসে। তাঁরা ডেয়ারিতে কাজ করতেন। তাঁদের তৃতীয় সন্তান ছিলেন ইরমা।
ইরমা ছাড়াও তাঁর বাবা-মার আরও চার জন সন্তান ছিল। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, গ্রেসের জন্মের ১৩ বছর পরে তাঁর মা আত্মহত্যা করেছিলেন। স্বামী স্থানীয় পানশালার মালিকের মেয়ের সঙ্গে বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়েছেন জানতে পাওয়ার পরই নাকি আত্মঘাতী হন তিনি।
শৈশব থেকেই বিভিন্ন ধরনের মানসিক নির্যাতন সহ্য করে বড় হতে হয়েছিল ইরমাকে। এর মধ্যে বেশির ভাগটাই তাঁর স্কুল থেকে পাওয়া। নথিপত্র ঘেঁটে জানা যায়, ছোটবেলা থেকেই স্কুলের সহপাঠীদের হাতে অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন ইরমা। স্কুল থেকে পালিয়ে বাড়ি চলে আসতেন তিনি। মাত্র ১৫ বছর বয়সে স্কুলের পড়াশোনা ছাড়ার নেপথ্যে সহপাঠীদের অত্যাচার অন্যতম কারণ ছিল বলেও জানা যায়।
অর্থ উপার্জনের জন্য ইরমা প্রথমে একটি পশুখামারে এবং পরে একটি দোকানে কাজ শুরু করেন। জার্মানির অনেক বাসিন্দার মতো তিনিও হিটলারের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এবং মাত্র ১৯ বছর বয়সে, মহিলা বন্দিদের জন্য রাফেন্সব্রুক কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের প্রহরী হিসাবে নিযুক্ত হন।
এক বছর পরে, অর্থাৎ ১৯৪৩ সালে ইরমাকে নাৎসি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে কুখ্যাত আউশভিৎজ়ে পাঠানো হয়। অনুগত, নিবেদিতপ্রাণ, এবং বাধ্য নাৎসি সদস্য ইরমার খুব দ্রুত পদোন্নতি হয়।
শুটজ়স্টাফিরতে সিনিয়র সুপারভাইজ়ার পদে বসানো হয়েছিল ইরমাকে। সে সময় ওই সংগঠনের মহিলাদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ ছিল সেটি। ১৯৪৫ সালে আউশভিৎজ় থেকে বেলসেন শিবিরের ওয়ার্ডেনের দায়িত্ব পান তিনি। আউশভিৎজ় থেকে অসংখ্য বন্দিকে নতুন শিবিরে নিয়ে গিয়েছিলেন ইরমা।
ইরমার হাতে এত বেশি ক্ষমতা এসে গিয়েছিল যে, তিনি ইহুদি বন্দিদের উপর অকথ্য অত্যাচার শুরু করেন। বন্দিদের মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি যৌন নির্যাতনও চালাতে শুরু করেন ইরমা।
মূলত মহিলা ইহুদিদের উপরই যৌন অত্যাচার চলত বেশি। নাৎসি শিবিরগুলিতে বন্দিদের অভিযোগ, একাধিক মহিলা বন্দিকে ধর্ষণ করতেন ইরমা। সেই সঙ্গে চালাতেন অমানবিক নিষ্ঠুরতা। তাঁর বিরুদ্ধে বন্দিদের খুন করারও অভিযোগ উঠেছিল। শোনা যায়, প্রতি দিনই এক জন না এক জন মহিলা বন্দিকে তিনি নিজের হাতে খুন করতেন।
আউশভিৎজ়ের বন্দিরা জানিয়েছিলেন, রক্তাক্ত হয়ে লুটিয়ে না পড়া পর্যন্ত ইহুদি মহিলাদের চাবুক মেরে চলতেন ইরমা। ইহুদি বন্দিদের মৃত্যু হলে তাঁদের চামড়া ছাড়িয়ে নাকি বাতিদানের ‘শেড’ তৈরির কাজে লাগাতেন। নিষ্পাপ চোখের ওই সুন্দরীই যে এত নৃশংস কাজ করতে পারেন, তা অনেক বন্দি বিশ্বাসই করতে পারতেন না।
ইরমা ডাকসাইটে সুন্দরী ছিলেন। তাই তাঁর রূপের আগুনে মন পুড়ত অনেক নাৎসি অফিসারের। আর সেই সুযোগই নিতেন ইরমা। উদ্দাম যৌনতায় মাততেন সেনাকর্তাদের সঙ্গে। শোনা যায়, কখনও কখনও একই সময়ে একাধিক পুরুষ সঙ্গীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতেন ইরমা। পছন্দের পুরুষ ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে পাঠানোর আগেও নাকি তাঁদের সঙ্গে যৌনতায় মেতে উঠতেন। তার পর তাঁদের পাঠিয়ে দিতেন বিষাক্ত গ্যাস চেম্বারে।
আউশভিৎজ় থেকে বেঁচে ফিরে আসা ইহুদি বন্দি ওলগা লেঙ্গিয়েল ‘ফাইভ চিমনিজ়’ বইয়ে লিখেছেন, ইয়োসেফ মেঙ্গেলে-সহ অন্য নাৎসি অফিসারদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল ইরমার। লেঙ্গিয়েল নিজের বইয়ে আরও উল্লেখ করেছেন যে, সুন্দরী ইহুদি মহিলারা ছিলেন ইরমার দু’চক্ষের বিষ। আর সেই কারণে বেছে বেছে রূপসী ইহুদি বন্দিদের গ্যাস চেম্বারে পাঠাতেন তিনি।
অধ্যাপক ওয়েন্ডি এ সার্টির গবেষণা অনুসারে, বন্দি ইহুদি মহিলাদের স্তনে আঘাত করাও ইরমার অভ্যাসে পরিণত হয়। পুরুষ বন্দিদের উপর যৌন নির্যাতন চালানোর সময় তিনি নাকি মহিলা বন্দিদের তা দেখতে বাধ্য করতেন। সার্টির গবেষণায় আরও উল্লেখ রয়েছে যে, নিজের পোষা কুকুরকেও মাঝেমধ্যে বন্দিদের উপর লেলিয়ে দিতেন তিনি। পেরেকযুক্ত জুতো দিয়ে বন্দিদের ক্রমাগত লাথিও মারা হত।
ইরমার অত্যাচারের ভয়াবহতা দেখে তাঁর নাম দেওয়া হয় ‘দ্য হায়না অফ আউশভিৎজ়’। কেউ বা তাঁকে ‘সুন্দরী পশু’ বলে ডাকতেন। নাৎসি জমানার ‘সবচেয়ে কুখ্যাত মহিলা যুদ্ধাপরাধীর’ তকমাও জুটেছে তাঁর।
ইরমার পরিণতিও হয়েছিল করুণ। ১৯৪৫-এর ১৭ এপ্রিল ব্রিটিশ সেনার হাতে গ্রেফতার হন ইরমা-সহ শুটজ়স্টাফির ৪৫ জন সদস্য। এর পর তাঁদের বিরুদ্ধে জার্মানির লুনেবুর্গে মামলা শুরু হয়। বেলসেন মামলা নামে পরিচিত ওই মামলার প্রথম পর্বে ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত শুনানি হয়েছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধাপরাধী হিসাবে দোষী সাব্যস্ত হন ইরমা। আউশভিৎজ় এবং বের্গেন-বেলসেন বা বেলসেন শিবিরের কয়েদিদের প্রতি অত্যাচার এবং খুনের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হন তিনি। ওই মামলায় মাত্র ২২ বছর বয়সে তাঁকে ফাঁসিকাঠে ঝোলায় ব্রিটিশ সরকার।
ন’সপ্তাহের শুনানিতে নিজেকে নির্দোষ হিসাবে বার বার দাবি করেন ইরমা। তবে ইরমা ও তাঁর দুই সহকর্মী ইয়োহানা বোরমান, এলিসাবেথ ফোলকেনরাথ-সহ আউশভিৎজ় এবং বেলসেনের আট পুরুষকর্মীকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত।
জানা যায়, ১৯৪৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর ফাঁসিকাঠে ওঠার আগের রাত থেকে ভোর পর্যন্ত ইয়োহানার সঙ্গে নাৎসি গান গাইতে থাকেন ইরমা। বিংশ শতকে ইরমাই ছিলেন সবচেয়ে কমবয়সি অপরাধী, যাঁর ব্রিটিশ আইন অনুযায়ী ফাঁসি হয়েছিল।