India China EV Row

বৈদ্যুতিন গাড়ির ব্যাটারিতে ‘অনৈতিক ভর্তুকি’, হুমকি দিয়ে চাপ বাড়াতে ভারতের নামে নালিশ ঠুকল ‘ভিজে বেড়াল’ চিন!

বৈদ্যুতিন গাড়ি এবং ব্যাটারিতে ভারত সরকার দেশীয় সংস্থাগুলিকে অনৈতিক ভর্তুকি দিচ্ছে বলে এ বার অভিযোগ তুলল চিন। এ ব্যাপারে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় নালিশও ঠুকেছে তারা। নেপথ্যে বিরল খনিজের ব্যবসায় একচেটিয়া আধিপত্য ধরে রাখার চাল? উঠছে প্রশ্ন।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২৫ ০৭:২৭
Share:
০১ ১৯

ভর্তুকির নামে ‘অন্যায্য’ সুবিধা দিচ্ছে ভারত। ফলে বৈদ্যুতিন গাড়ি বা ইভির (ইলেকট্রিক ভেহিকল) বাজারে কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হচ্ছে না এ দেশের কোনও স‌ংস্থাকে। এই মর্মে এ বার বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বা ডব্লিউটিওতে (ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজ়েশন) অভিযোগ দায়ের করল চিন। এর জেরে আগামী দিনে নয়াদিল্লি ও বেজিঙের মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েন তৈরি হওয়ার আশঙ্কা যে বাড়ল, তা বলাই বাহুল্য। এ ব্যাপারে পাল্টা ড্রাগনের দ্বিচারিতা নিয়ে সরব হয়েছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার।

০২ ১৯

সংবাদসংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের ১৫ অক্টোবর ইভির বাজারে প্রতিযোগিতার বিষয়টি সামনে এনে ডব্লিউটিওতে অভিযোগ দায়ের করে চিনের বাণিজ্য মন্ত্রক। সেখানে বেজিং বলেছে, অন্যায্য ভাবে বৈদ্যুতিন গাড়ি এবং ব্যাটারি উৎপাদনের ক্ষেত্রে দেশীয় সংস্থাগুলিকে ভর্তুকি দিচ্ছে নয়াদিল্লি, যেটা একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইন এবং ড্রাগনের বাণিজ্যিক স্বার্থের পরিপন্থী।

Advertisement
০৩ ১৯

এই বিষয়ে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারকে রীতিমতো হুমকি দিয়েছে চিন। বেজিং জানিয়েছে, ইভিতে ভর্তুকি কমানোর ব্যাপারে ভারত সরকার বা ডব্লিউটিও কোনও ব্যবস্থা না নিলে ‘দ়়ৃঢ় পদক্ষেপ’ গ্রহণ করবে তারা। ড্রাগনের ‘শাস্তিমূলক’ সিদ্ধান্ত কী হতে পারে, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, বাজার গবেষণা সংস্থা রো মোশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ইভি বাণিজ্যের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ রয়েছে মান্দারিনভাষীদের দখলে।

০৪ ১৯

সমীক্ষকদের দাবি, দুই এবং চার চাকা মিলিয়ে বছরে প্রায় ১৩ লক্ষ বৈদ্যুতিন গাড়ি বিক্রি করে থাকে চিন। সংশ্লিষ্ট যানগুলি নির্মাণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল বিরল খনিজ, যার বিশাল ভান্ডার রয়েছে বেজিঙের হাতে। অন্য দিকে বিরল খনিজের ব্যাপারে ড্রাগনের উপর যথেষ্ট পরিমাণে নির্ভরশীল নয়াদিল্লি। সেই রফতানি মান্দারিনভাষীরা বন্ধ করলে কেন্দ্রের মোদী সরকার যে বিপাকে পড়বে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

০৫ ১৯

সম্প্রতি বিরল খনিজের ব্যাপারে চিনা নির্ভরশীলতা কমাতে বিশেষ একটি কর্মসূচির সূচনা করেছে কেন্দ্র। এর পোশাকি নাম ‘জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ খনিজ মজুত’ (ন্যাশনাল ক্রিটিক্যাল মিনারেল স্টকপাইল)। সংশ্লিষ্ট কর্মসূচিটির মূল উদ্দেশ্যই হল বিরল খনিজ খুঁজে বার করা এবং তার উত্তোলন। এ ব্যাপারে আদা-জল খেয়ে কাজে লেগে পড়েছে ‘ভারতীয় ভূতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ’ বা জিএসআই (জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া)।

০৬ ১৯

মজার বিষয়টি হল, কেন্দ্র বিরল খনিজের ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার চেষ্টা করতেই ইভির ভর্তুকি নিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে সরব হল চিন। এ দেশের বৈদ্যুতিন গাড়ি শিল্প লম্বা সময় ধরে সরকারি আনুকূল্য পেলেও এত দিন মুখে কুলুপ এঁটেছিল বেজিং। কিন্তু হঠাৎ করে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় তারা অভিযোগ দায়ের করায়, ড্রাগনের আসল উদ্দেশ্য ঘিরে উঠছে প্রশ্ন। এই ব্যবসায় একচেটিয়া অবস্থা ধরে রাখতে বর্তমানে মরিয়া হয়ে উঠেছে মান্দারিনভাষী দেশটির সরকার।

০৭ ১৯

উল্লেখ্য, ইভি নির্মাণ শিল্পে ভারত সরকার কী পরিমাণে ভর্তুকি দিচ্ছে, তার বিস্তারিত তথ্য রয়েছে নীতি আয়োগের পোর্টালে। সেখানে বলা হয়েছে, দু’চাকার গাড়ি বা দুই কিলোওয়াট/ঘণ্টা ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাটারির ক্ষেত্রে প্রতি কিলোওয়াট/ঘণ্টায় ১৫ হাজার টাকা বা ৪০ শতাংশ পর্যন্ত মিলবে ছাড়। এ ক্ষেত্রে যেটা বেশি সেই হিসাবে ভর্তুকি পাবেন সংশ্লিষ্ট ইভি নির্মাণকারী সংস্থা।

০৮ ১৯

তিন চাকার ইভি বা বৈদ্যুতিন রিকশার ক্ষেত্রে প্রতি কিলোওয়াট/ঘণ্টায় ছাড়ের মাত্রা ১০ হাজার টাকা। পাঁচ কিলোওয়াট/ঘণ্টা আকারের ব্যাটারি পর্যন্ত এই ছাড় বহাল রাখছে সরকার। একই ভাবে চার চাকার গাড়িতে ১০ হাজার টাকা ছাড় মিলছে। এতে অবশ্য ১৫ কিলোওয়াট/ঘণ্টার ব্যাটারিতে ছাড় দিচ্ছে কেন্দ্র।

০৯ ১৯

এ ছাড়া ভর্তুকি রয়েছে ই-বাসের ক্ষেত্রেও। সেখানে প্রতি কিলোওয়াট/ঘণ্টা হিসাবে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ছাড় দিচ্ছে সরকার। এতে আবার ২৫০ কিলোওয়াট/ঘণ্টা আকারের ব্যাটারি পর্যন্ত ছাড় পাবেন নির্মাতারা। এই ভর্তুকির মাধ্যমে ঘরোয়া বাজারে ইভির দাম মধ্যবিত্তের আওতার মধ্যে রাখতে চাইছে কেন্দ্র। জলবায়ু পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে আগামী দিনে জীবাশ্ম জ্বালানির গাড়ির সংখ্যা কমিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে মোদী প্রশাসনের।

১০ ১৯

পরিবেশ দূষণের মাত্রা কমাতে বর্তমানে হাইব্রিড এবং বৈদ্যুতিন গাড়ি বিক্রির সূচক বৃদ্ধির ব্যাপারে ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছে কেন্দ্র। হাইব্রিড হল সেই গাড়ি যাতে ব্যাটারি এবং জীবাশ্ম জ্বালানি (পেট্রল-ডিজ়েল)— দু’ধরনের ইঞ্জিন থাকে। এর জন্য বিশেষ একটি প্রকল্প কার্যকর করতে উঠেপড়ে লেগেছে সরকার। এর পোশাকি নাম ‘ফাস্টার অ্যাডপটেশন অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং অফ (হাইব্রিড অ্যান্ড) ইলেকট্রিক ভেহিকল্স’ বা ফেস। আগামী তিন বছরের জন্য এর দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রচার চালাচ্ছে মোদী সরকার।

১১ ১৯

এ দেশের ঘরোয়া বাজারে বিদেশি সংস্থাগুলির বৈদ্যুতিন গাড়ি বিক্রির অনুমতি রয়েছে। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে আমদানি শুল্কে কোনও ছাড় দিচ্ছে না সরকার। ফলে বিদেশি ইভির দাম সব সময়েই থাকছে খুব চড়া। আরও স্পষ্ট করে বললে মধ্যবিত্তের প্রায় নাগালের বাইরে। গত বছর অবশ্য এসএমইসি নামের একটি প্রকল্পের অনুমোদন দেয় কেন্দ্র। সেখানে বলা হয়েছে, কোনও বিদেশি গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থা এ দেশে কারখানা খুললে আমদানি শুল্কে ছাড় পাবে।

১২ ১৯

গত ৯ অক্টোবর চিনের মাটিতে বিদেশি সংস্থার উত্তোলন এবং প্রক্রিয়াকরণ করা বিরল খনিজের রফতানিতে বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় বেজিং। এই সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তিতে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিঙের সরকার জানিয়েছে, ড্রাগনভূমি থেকে বিদেশি সংস্থাগুলির রফতানি করা পণ্যে বিন্দুমাত্র বিরল খনিজের উপস্থিতি থাকলে তার জন্য বিশেষ অনুমতি নিতে হবে। শুধু তা-ই নয়, ওই বিরল খনিজ দিয়ে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত কোনও যন্ত্রপাতি তৈরি করা যাবে না। কেবলমাত্র ভোগ্যপণ্য তৈরির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট খনিজগুলি ব্যবহার করা যেতে পারে।

১৩ ১৯

বেজিঙের জারি করা এই নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী, এ বার থেকে মুচলেকা দিয়ে বিরল খনিজ নিতে হবে যে কোনও বিদেশি সংস্থাকে। চিনের দাবি, বিশ্বে শান্তি বজায় রাখতে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। আগামী ১ নভেম্বর থেকে নতুন নিয়ম কার্যকর করবে ড্রাগনভূমির সরকার। এই বিধিনিষেধ মেনে নেওয়ার ব্যাপারে প্রবল আপত্তি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের। আর তাই ইতিমধ্যেই চিনা পণ্যে ১০০ শতাংশ শুল্ক চাপানোর হুমকি দিয়েছেন বর্ষীয়ান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

১৪ ১৯

বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই গণমাধ্যমে মুখ খুলেছেন ট্রাম্প প্রশাসনের অর্থসচিব স্কট বেসেন্ট। ‘ফক্স বিজ়নেস’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘এই লড়াই চিন বনাম বাকি বিশ্বের। আমরা বেজিঙের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলছি। আমেরিকা কখনওই মান্দারিনভাষীদের দেশটিকে বিরল খনিজের উপর আধিপত্যকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে দিতে পারে না।’’

১৫ ১৯

এ ব্যাপারে ভারতের সমর্থন পেতে উদ্‌গ্রীব হয়ে উঠেছে আমেরিকা। সাক্ষাৎকারে তা স্পষ্ট করেছেন বেসেন্ট। তাঁর কথায়, ‘‘যে কোনও মূল্যে আমরা সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করব। আর তাই বন্ধু দেশগুলির সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলেছি। এ বার তাদের সঙ্গে দেখা করে সামনাসামনি আলোচনা করা হবে। আশা করি, ভারত, ইউরোপ এবং এশিয়ার অন্য গণতান্ত্রিক দেশগুলির থেকে আমরা সমর্থন পাব।’’

১৬ ১৯

২০২০ সালে গলওয়ান সংঘর্ষের পর ভারতকে বিরল খনিজ রফতানি প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল চিন। কিন্তু গত অগস্ট-সেপ্টেম্বরে ‘সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা’ বা এসসিওর (সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজ়েশন) বৈঠকে যোগ দিতে চিন সফর করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। ওই সময় প্রেসিডেন্ট শি-র সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হয় তাঁর। এর পরই এ দেশে বিরল খনিজ পাঠানোর ব্যাপারে ইতিবাচক আশ্বাস দেয় বেজিং। যদিও সেখান থেকে ড্রাগন প্রশাসন অবিলম্বে সরে আসতে চলেছে বলেই মনে করা হচ্ছে।

১৭ ১৯

বিশ্লেষকদের দাবি, ভারতকে বিরল খনিজ রফতানি বন্ধ করতেই ইভির ভর্তুকির ছুতো দিচ্ছে চিন। গত কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সেমিকন্ডাক্টর হাব গড়়ে তুলেছে নয়াদিল্লি। বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম নির্মাণে এটি অপরিহার্য। এতে বেজিঙের একচেটিয়া ব্যবসায় প্রবল ভাবে ধাক্কা লাগার আশঙ্কা থাকছে। তবে এ ব্যাপারে ডব্লিউটিওতে অভিযোগ জানিয়ে ড্রাগনের যে খুব একটা লাভ হল, এমনটা নয়।

১৮ ১৯

অতীতে উড়ান নির্মাণকারী সংস্থা বোয়িং এবং এয়ারবাসকে ভর্তুকি দেওয়া নিয়ে বহু বার যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলি একে অপরের বিরুদ্ধে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় অভিযোগ দায়ের করেছে। কিন্তু, সেই মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। কারণ, অভিযোগ উঠলেই নাম বদল করে ঘুরপথে নির্মাতা সংস্থাগুলিকে ছাড় দিয়ে গিয়েছে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার। সেই আইনের ফাঁক গলে ভারতও যে বেরিয়ে যেতে পারবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

১৯ ১৯

তা ছাড়া ঘরোয়া ইভি নির্মাণকারী সংস্থাগুলিকে বিপুল অঙ্কের ভর্তুকি দিয়ে থাকে চিনও। বৈদ্যুতিন গাড়ি সংক্রান্ত গবেষণা এবং উন্নয়ন প্রকল্পে সরকারি অর্থানুকূল্য পায় তারা। ফলে ডব্লিউটিওতে এই বিষয়টিও তোলার সুযোগ থাকছে ভারতের হাতে। অন্য দিকে, বিরল খনিজ রফতানিতে রাশ টানা নিয়ে বেজিং বিরোধী যুক্তরাষ্ট্রের জোটে নয়াদিল্লি কতটা আগ্রহী হয়, সেটাই এখন দেখার।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement