কেনিয়ার কোস্ট প্রদেশে মোম্বাসার কাছে বনাঞ্চলে ঘেরা পাহাড়। আশপাশে কিছু জনবসতি থাকলেও আধুনিক প্রযুক্তি এখনও সে ভাবে সেখানে পৌঁছোয়নি। সেই পাহাড় আর বনাঞ্চলই এখন আমেরিকা এবং চিনের মতো তাবড় তাবড় দেশের আগ্রহের জায়গা। ক্রমবর্ধমান স্থানীয় উত্তেজনার কারণও এই প্রকৃতিই। কিন্তু কেন?
কেনিয়ার দক্ষিণের উপকূলীয় অঞ্চলে জঙ্গলে ঘেরা ওই পাহাড়ের নাম মৃমা। বিজ্ঞানীদের দাবি, মৃমার ঘন জঙ্গলের নীচে লুকিয়ে রয়েছে বিরল খনিজ পদার্থের বিশাল ভান্ডার। আর সেই ভান্ডার হাতে এলেই নাকি স্মার্টফোন, বৈদ্যুতিক যানবাহন থেকে শুরু করে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ব্যবস্থা তৈরিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে।
মূল্যবান সেই খনিজ ভান্ডারের প্রতি ইতিমধ্যেই আকৃষ্ট হয়েছে আমেরিকা, চিন এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ। উন্নত প্রযুক্তি এবং শিল্পক্ষেত্রে কম কার্বন নির্গমনের মাধ্যমে বিশ্বের রূপান্তরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ খনিজ হাতে পেতে ক্রমাগত চেষ্টা চালাচ্ছে তারা।
এই সম্পদ কুক্ষিগত করার জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা যেমন তীব্রতর হচ্ছে, তেমনই আশপাশের সম্প্রদায়গুলি তাদের ভূমি, পরিবেশ এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। কেনিয়ার উন্নয়নের জন্য সুযোগ এবং সম্ভাব্য শোষণ— উভয়েরই প্রতীক হয়ে উঠেছে মৃমা পাহাড়।
ভারত মহাসাগরের কাছে অবস্থিত সে দেশের কোয়ালে কাউন্টিতে প্রায় ৩৯০ একর এলাকা জুড়ে অবস্থিত মৃমা পাহাড়। দেখতে সাধারণ জঙ্গলের মতো হলেও এখানেই মাটির নীচে রয়েছে দুর্লভ খনিজ এবং নমনীয় রূপান্তর ধাতু নিওবিয়ামের ভান্ডার।
ব্রিটেন এবং কানাডাভিত্তিক সংস্থা ‘প্যাসিফিক ওয়াইল্ডক্যাট রিসোর্সেস’-এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘কর্টেক মাইনিং কেনিয়া’র ২০১৩ সালের এক প্রতিবেদনে অনুমান করা হয়েছে, এই খনিজ ভান্ডারের মূল্য প্রায় ৬২৪০ কোটি ডলার।
মৃমা পাহাড়ে পাওয়া অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খনিজ নিওবিয়াম শক্তিশালী ইস্পাত তৈরিতে এবং সবুজ শক্তি দ্বারা চালিত উন্নত প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত হয়।
মৃমা পাহাড়ের বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিদেশি শক্তিগুলির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। জুন মাসে, কেনিয়ায় তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্ক ডিলার্ড এই স্থানটি পরিদর্শন করেন, যা আফ্রিকার খনিজ সম্পদের প্রতি ওয়াশিংটনের ক্রমবর্ধমান আগ্রহের ইঙ্গিত দেয়।
একই সময়ে একদল চিনা নাগরিকের জঙ্গলে প্রবেশের চেষ্টার খবর প্রকাশ্যে আসে। যদিও স্থানীয় রক্ষীরা তাঁদের প্রবেশে বাধা দেন।
সম্প্রতি, অস্ট্রেলিয়ার সংস্থা ‘রেয়ারএক্স’ এবং ‘ইলুকা রিসোর্সেস’ও এই অঞ্চলে দুর্লভ মাটির খনি অনুসন্ধানের পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছে, যা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা আরও তীব্র করে তুলেছে।
এই আকস্মিক বিশ্বব্যাপী আগ্রহ মৃমা পাহাড়ের আশপাশের মানুষের মনে আশা এবং উদ্বেগ— দুই-ই জাগিয়ে তুলেছে। স্থানীয় সম্প্রদায়ের কাছে মৃমা পাহাড় এবং তৎসংলগ্ন বনাঞ্চল পবিত্র। আর সে কারণেই বনটি রক্ষার জন্য সংগ্রাম চালাচ্ছে তারা। মৃমা পাহাড়ের আশপাশে মূলত ডিগো জনগোষ্ঠীর বাস।
ডিগোদের সঙ্গে বনের যোগ নিবিড়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তাদের খাদ্য, ওষুধ এবং আধ্যাত্মিক আশ্রয় দিয়ে আসছে মৃমা পাহাড়ের জঙ্গল। জঙ্গলে তাদের আরাধ্য দেবতার মন্দিরও রয়েছে।
ফলে, খনিজ সম্পদের প্রতিশ্রুতি তাদের কাছে ভয় এবং বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক বাসিন্দা আশঙ্কা করছেন, বিদেশি সংস্থাগুলি মুনাফা কামালেও তাঁদের লাভের লাভ কিছু হবে না। উল্টে, তাঁরা জমি হারাবেন।
যদিও ডিগো সম্প্রদায়ের সবাই খনির বিরোধিতা করছেন না। কেউ কেউ এটিকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তির একটি পাকাপাকি সুযোগ হিসেবে দেখছেন।
কেনিয়ার খনি খাত দীর্ঘ দিন ধরে দুর্নীতি, দুর্বল নিয়ন্ত্রণ এবং স্বচ্ছতার অভাবের সঙ্গে লড়াই করছে। ২০১৩ সালে, কেনিয়ার সরকার পরিবেশগত এবং লাইসেন্স সংক্রান্ত আইন লঙ্ঘনের কথা উল্লেখ করে ‘কর্টেক মাইনিং কেনিয়া’ সংস্থার লাইসেন্স বাতিল করে।
যদিও কর্টেক দাবি করেছিল যে, তৎকালীন খনিমন্ত্রী নাজিব বালালাকে ঘুষ দিতে অস্বীকার করার জন্যই শাস্তি পেতে হয়েছে তাদের। তবে বালালা সেই অভিযোগ অস্বীকার করেন।
এর পর ২০১৯ সালে কেনিয়ার সরকার অবৈধ কার্যকলাপ এবং পরিবেশগত ক্ষতি মোকাবিলায় নতুন খনির লাইসেন্স দেওয়া সাময়িক ভাবে নিষিদ্ধ করে। তবে আম্তর্জাতিক বাজারে বিরল খনিজের ক্রমবর্ধমান চাহিদা কেনিয়ার এই খাতকে পুনরুজ্জীবিত করার আগ্রহকে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে।
বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার এবং নিয়ন্ত্রণ জোরদার করার জন্য এ বছর খনি মন্ত্রণালয় একটি বড় সংস্কার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। সংস্কারগুলির মধ্যে রয়েছে কর প্রণোদনা, সরলীকৃত লাইসেন্সিং পদ্ধতি এবং অনুমোদন প্রক্রিয়ায় আরও স্বচ্ছতার প্রতিশ্রুতি।
সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে কেনিয়ার অর্থনীতিতে খনির অবদান জিডিপির এক শতাংশেরও কম থেকে দশ শতাংশে উন্নীত করার অঙ্গীকার নিয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞেরা সতর্ক করে দিয়েছেন, শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান এবং আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ ছাড়া সংস্কারগুলি স্থায়ী সুবিধা আনতে ব্যর্থ হতে পারে।
ফলে বিদেশি বিনিয়োগ আনার পাশাপাশি পরিবেশ ধ্বংস না করে স্থানীয়দের ঐতিহ্য রক্ষা এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সুবিধাগুলি জনগণের কাছে পৌঁছোনো কেনিয়ার কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।