India vs South Africa 2025

সূর্য-শুভমনের টানা ব্যর্থতার সঙ্গে গম্ভীরের উদ্ভট পরীক্ষা-নিরীক্ষা! বিশ্বকাপের আগে ভুলভুলাইয়ায় দিশাহীন ভারতীয় দল

রান নেই সূর্যকুমার যাদব, শুভমন গিলের ব্যাটে। তবু তাঁদের উপর গৌতম গম্ভীরের আস্থা অটুট। অধিনায়ক, সহ-অধিনায়কের ব্যর্থতা ঢাকতে পরীক্ষা চালাচ্ছেন কোচ। তাতে বিশ্বজয়ীদের খেতাব ধরে রাখার স্বপ্ন ঢুকে যাচ্ছে ভুলভুলাইয়ায়।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৬:৫৪
Share:

(বাঁ দিক থেকে) শুভমন গিল, গৌতম গম্ভীর এবং সূর্যকুমার যাদব। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

দু’মাসও বাকি নেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের। তার আগে সূর্যকুমার যাদব এবং শুভমন গিলের ফর্ম উদ্বেগ বাড়াচ্ছে ভারতীয় শিবিরের। তার উপর ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে কোচ গৌতম গম্ভীরের নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা। সব মিলিয়ে গত বারের চ্যাম্পিয়নদের প্রত্যাশিত ছন্দে দেখা যাচ্ছে না।

Advertisement

টেস্ট হোক বা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট— গম্ভীরের পরীক্ষার শেষ নেই। ভারতীয় দলের সাজঘরকে প্রায় ক্রিকেট গবেষণাগারে পরিণত করেছেন। কখনও ওয়াশিংটন সুন্দর, কখনও অক্ষর পটেলকে তিন নম্বরে ব্যাট করতে পাঠাচ্ছেন। সূর্যের ব্যাটিং অর্ডারও পরিবর্তন হচ্ছে প্রায় প্রতি ম্যাচে। ভারতীয় দলের ব্যাটিং অর্ডার যেন ‘মিউজিক্যাল চেয়ার’! গুরুত্বপূর্ণ তিন নম্বর জায়গাকে কোচ নিজের ক্রিকেট গবেষণার আধারে পরিণত করেছেন। প্রতিপক্ষকে ধোঁকা দিতে গিয়ে বার বার দলকে ডোবাচ্ছেন। তবু ভারতীয় ক্রিকেটের পালাবদলের যুক্তিতে অটল তিনি। বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা, রবিচন্দ্রন অশ্বিনের অবসরের পর পালাবদলের যুক্তি লাল বলের ক্রিকেটে প্রযোজ্য হলেও টি-টোয়েন্টিতে নয়। গম্ভীরের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং বিশ্বাসের মূল্য বৃহস্পতিবার মুল্লানপুরেও চোকাতে হয়েছে ভারতীয় দলকে।

শেষ ২০টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে সূর্যের অবদান ১৩.৩৫ গড়ে ২২৭ রান। সর্বোচ্চ অপরাজিত ৪৭। স্ট্রাইক রেট ১২০.১০। একদা বিশ্বের এক নম্বর টি-টোয়েন্টি ব্যাটার ফর্ম খুঁজে চলেছেন। কিন্তু কোনও ২২ গজই তাঁকে রানে ফেরাতে পারছে না। গম্ভীরের বিশ্বাস অটুট। তিনি একাধিকবার বলেছেন, সূর্যের রান না পাওয়া নিয়ে চিন্তিত নন। তাঁর বিশ্বাস, যে কোনও দিন রান পাবেন অধিনায়ক। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো যুক্ত হয়েছে শুভমনের ফর্ম। সহ-অধিনায়কও হতাশ করে চলেছেন ম্যাচের পর ম্যাচ। ডাগআউটে বসে গম্ভীর দেখছেন। হতাশায় মাথা নাড়ছেন। পরে আবার তাঁদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। কোচ হিসাবে হয়তো ঠিকই করছেন। তাতে কি লাভ হচ্ছে ভারতীয় দলের?

Advertisement

সূর্য নিজেও এত দিন পর্যন্ত বলছিলেন, ফর্ম নিয়ে ভাবছেন না। দলের জয়ই তাঁর কাছে আসল। দল জিতলে সতীর্থদের পারফরম্যান্সে আড়ালে চলে যাচ্ছিলেন। দল হারলে সতীর্থদের ব্যর্থতার সঙ্গে মিশে যাচ্ছিলেন। বৃহস্পতিবার হারের পর বোধহয় উপলব্ধি করেছেন, টেলিভিশনের রামায়নের মতো ইন্দ্রজিৎ-ইন্দ্রজিৎ খেলার মঞ্চ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ২২ গজ নয়। সুর নরম করে বলেছেন, ‘‘আমার এবং শুভমনের শুরুটা ভাল করা উচিত ছিল। সব ম্যাচে অভিষেক শর্মা উতরে দেবে, এটা হয় না। দায় আমারই। আরও বেশিক্ষণ ব্যাট করা উচিত ছিল।’’ মুম্বইয়ের সূর্য নিজের ব্যর্থতার সঙ্গে জুড়ে নিয়েছেন পঞ্জাবের শুভমনের নামও। অধিনায়ক এবং সহ-অধিনায়ক কেউই সতীর্থদের সামনে উদাহরণ তৈরি করতে পারছেন না।

সম্ভবত এই চাপ সামলাতে গম্ভীর তিন নম্বরে ব্যবহার করছেন ওয়াশিংটন, অক্ষরদের। হয়তো ফিরিয়ে আনতে চাইছেন ‘পিঞ্চ হিটার’ কৌশল। দ্রুত কিছু রান তুলে স্কোর বোর্ডকে ভদ্রস্থ জায়গায় নিয়ে যেতে চাইছেন। তিন নম্বরে ব্যাট করার জন্য যে ব্যাটিং দক্ষতার প্রয়োজন, তা নেই ওয়াশিংটন, অক্ষরদের। ঘরোয়া ক্রিকেটেও তাঁরা এত উপরে ব্যাট করেন না। গম্ভীরের ‘প্ল্যান বি’ কাজে লাগছে না। ভুগতে হচ্ছে ভারতীয় দলকে।

প্রাক্তন ক্রিকেটার রবীন উথাপ্পা সমালোচনা করে বলেছেন, ‘‘পিঞ্চ হিটার নামিয়ে লাভ হয় না। বড় রান তাড়া করতে হলে দলের সেরা ব্যাটারদের আগে পাঠাতে হয়। যত বেশি সম্ভব বল তাদের খেলার সুযোগ দেওয়া উচিত। ব্যাটারদের কাজ তো রান করা। যখন বেশি রানের প্রয়োজন, তখন তো তাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে। অক্ষরকে নামিয়ে কী লাভ হল? ২১ বলে ২১ রান। এটাকে পিঞ্চ হিট বলে না। এটা কোনও পরিকল্পনা নয়। ব্যাটিং অর্ডারের প্রথম তিনটি জায়গা অন্তত নির্দিষ্ট থাকা উচিত।’’ অক্ষরকে তিন নম্বরে পাঠানোয় বিস্মিত ডেল স্টেনও। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাক্তন ক্রিকেটার বলেছেন, ‘‘অক্ষরকে তিন নম্বরে পাঠানো বড় ভুল গম্ভীরের। অক্ষর ভাল ব্যাটার। তবে ওকে তিন নম্বরে নামিয়ে দেওয়াটা নেকড়ের সামনে ফেলে দেওয়া। অভিষেক প্রথমে আউট হলে তবু একটা যুক্তি থাকে। অক্ষরকে প্রথম বল থেকে মারার নির্দেশ দেওয়া যেত। ডানহাতি-বাঁহাতি সুবিধাও ধরে রাখা যেত। কিন্তু শুভমন আউট হওয়ার পর সূর্যকে না নামিয়ে অক্ষরকে কেন পাঠাবে!’’ তাঁর মতে পরীক্ষাও ইতিবাচক হওয়া দরকার।

ভোগান্তিটা যে উদ্বেগের পর্যায় চলে যাচ্ছে, তার কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে রায়ান টেন দুশখতের কথায়। বৃহস্পতিবার ম্যাচের পর ভারতীয় দলের সহকারী কোচ বলেছেন, ‘‘সূর্য খুবই ভাল ব্যাটার। এই ধরনের খেলোয়াড়দের থেকে আমাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি থাকে। তিন নম্বরে নামলে রান করার চাপ থাকবেই। দীর্ঘ দিন ধরে সেরা ফর্মে নেই সূর্য। আমরা ওর থেকে যে রকম ইনিংস আশা করি, তেমন খেলতে পারছে না। তবে একটি কথা বলতে পারি, সূর্যকে নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন নই। আমরা চাইব তিন নম্বরে আগ্রাসী সূর্যকে দেখতে। অস্ট্রেলিয়ায় যেমন একটা ইনিংস খেলেছিল। তা ছাড়া অধিনায়ক হিসাবে সূর্য দুর্দান্ত। পরিকল্পনার দিক থেকে দলকে সঠিক দিশায় এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। যে কোনও দিন রান পাবে।’’

সূর্যের যে কোনো দিন রান পাওয়ার কথা গম্ভীর আগে একাধিক বার বলেছেন। সেই দিন এখন আসেনি। বিশ্বকাপের আগে আর আটটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ রয়েছে ভারতের। তার মধ্যে সূর্যকে চেনা ফর্মে দেখা না গেলে সমস্যা হতে পারে। শুভমনকে নিয়েও স্বস্তি নেই দল। ২০২৫ সালে ১৪টি ম্যাচে ২৬৩টি রান এসেছে শুভমনের ব্যাট থেকে। দুশখতে বলেছেন, ‘‘সূর্যর মতো শুভমনকে নিয়েও আমরা উদ্বিগ্ন নই। হ্যাঁ, শুভমনও ভাল ফর্মে নেই। আমরা জানি, ও কেমন ব্যাটার। অস্ট্রেলিয়ায় ভালই খেলেছে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ইনিংসের প্রথম থেকেই আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের নির্দেশ দেওয়া রয়েছে। কটকের পিচ একটু কঠিন ছিল। তাই ওই ইনিংসটা দিয়ে বিচার করলে হবে না। মুল্লানপুরে শুভমন আউট হয়েছে একটা ভাল বলে। সেরা ফর্মে না থাকলে এই সমস্যাগুলো হয়। কিন্তু আইপিএলের দিকে তাকান। শুভমন বছরে ৬০০, ৭০০ রান করে। কেমন ব্যাট করে, সকলে জানে। ওর উপর আমাদের ভরসা রয়েছে। সূর্যের মতো শুভমনও যে কোনও দিন বড় রান করবে। বুঝতে পারছি অনেকের মনে ওদের দু’জনকে নিয়ে একটা উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে। আমাদের বিশ্বাস, আসল সময় ওদের সেরা ফর্মেই পাওয়া যাবে।’’

একটা প্রবাদ রয়েছে, ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহু দূর’। গম্ভীরও বিশ্বাসে আস্থা রাখতে চাইছেন। তর্কে যেতে চাইছেন না। তাঁর আশা, বিশ্বকাপের সময় সব ঠিক হয়ে যাবে। ভারতীয় দলের সহকারী কোচেরা সংবাদমাধ্যমের সামনে ততটাই বলেন, যতটা তাঁদের বলতে বলা হয়। প্রথম একাদশ, ব্যাটিং অর্ডারের মতো বিষয় নিয়ে তাঁরা কথা বলেন না। দলের মধ্যেও বলেন না। যা এক দিনের সিরিজ়ের সময় বলেছিলেন বোলিং কোচ মর্নি মর্কেল। যেমন যশস্বী জয়সওয়ালকে দলেই রাখা হচ্ছে না। সঞ্জু স্যামসনকে প্রথম একাদশ থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুভমনকে দিয়ে ওপেন করানো হচ্ছে। ঘরোয়া ক্রিকেটে এবং ভারতীয় দলের হয়ে সঞ্জু সাধারণত প্রথম তিন ব্যাটারের মধ্যেই থাকেন। তাঁকে খেলতে হলে ফিনিশার হিসাবে খেলতে হবে। প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচের পরই বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়েছেন সূর্য।

এই যুক্তি নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন বাংলার কোচ লক্ষ্মীরতন শুক্ল। তিনি বলেছেন, ‘‘সঞ্জুর মতো ক্রিকেটার বাইরে বসে রয়েছে। অথচ সূর্যকে টানতে হচ্ছে ভারতকে। মনে রাখতে হবে, অধিনায়কত্ব করার জন্য সূর্যকে খেলানো হচ্ছে না। দল ওর কাছ থেকে বড় রান চায়। একটা দলের ওপেনার (শুভমন) এবং প্রথম দিকের ব্যাটারদের যখন এ রকম হাল হয় তখন দলের চাপে পড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।’’ যশস্বীর মতো ব্যাটারকে বাইরে রেখে শুভমনকে খেলিয়ে যাওয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। প্রাক্তন জাতীয় নির্বাচক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এখন পরিবর্তনের পক্ষে নন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বিশ্বকাপের আগে বেশি সময় নেই। এখন সূর্য এবং শুভমনকে বদলাতে গেলে আরও সমস্যা হবে। আরও আগে ভাবা উচিত ছিল। শুভমন চোট পেয়েছিল। ওকে কয়েকটা ম্যাচ সময় দিতে হবে। সূর্য এক বছরের বেশি রান পাচ্ছে না। আইপিএলে যে শটগুলো খেলে, সেগুলো খেলতে পারছে না। ওকে পরিকল্পনা করে বল করছে প্রতিপক্ষ দলগুলো। অফ স্টাম্পের বাইরে বল রাখছে। দু’জনেই ভাল ব্যাটার। তবে রান করতে হবে।’’

যুক্তি-পাল্টা যুক্তি রয়েছে। বিশ্বাস-ভরসা রয়েছে। নেই শুধু রান। দলের প্রথম তিন ব্যাটারের দু’জনই ধুঁকছেন ব্যাট হাতে। তাঁরাই আবার অধিনায়ক এবং সহ-অধিনায়ক। প্রথম একাদশে দু’জনেই নিশ্চিত। তাঁদের মাথায় গম্ভীরের আস্থার হাত রয়েছে। এই নিশ্চয়তাই দলকে অনিশ্চয়তার গোলকধাঁধায় ঠেলে দিচ্ছে। বিশ্বজয়ীদের খেতাব ধরে রাখার স্বপ্ন ঢুকে যাচ্ছে ভুলভুলাইয়ায়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement