বিয়াল্লিশই চাই, ফের বার্তা দলকে, ভয় পাচ্ছেন, নাকি দুর্বল হচ্ছেন? প্রশ্ন মমতার

মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়করা তো বটেই, পুরসভা এবং পঞ্চায়েত স্তরের জনপ্রতিনিধিরা আমন্ত্রিত ছিলেন এ দিনের বৈঠকে। সর্বভারতীয় স্তর থেকে জেলা স্তর বা কোনও কোনও ক্ষেত্রে তারও নীচের স্তরের দলীয় পদাধিকারীরাও সোমবার হাজির ছিলেন নজরুল মঞ্চে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ২১:৫১
Share:

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।—ফাইল চিত্র।

কথার কথা নয়, বাংলার ৪২টা আসনেই জিততে হবে। দলকে বার্তা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সাধারণ নির্বাচন ঘোষিত হওয়ার আগে দলের শেষ কোর কমিটি বৈঠকটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সারলেন সোমবার। দলকে আরও চাগিয়ে দেওয়া আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। ‘‘ভয় পাচ্ছেন? নাকি দুর্বল হয়ে পড়ছেন?’’—নজরুল মঞ্চে হাজির হওয়া কয়েক হাজার নেতা-কর্মীকে ঝাঁঝালো প্রশ্ন মমতার। তবে গত বার জেতা ৩৪ সাংসদের সবাই যে এবার টিকিট পাচ্ছেন না, সে ইঙ্গিতও এ দিন তৃণমূলনেত্রী দিয়ে দিয়েছেন।

Advertisement

মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়করা তো বটেই, পুরসভা এবং পঞ্চায়েত স্তরের জনপ্রতিনিধিরা আমন্ত্রিত ছিলেন এ দিনের বৈঠকে। সর্বভারতীয় স্তর থেকে জেলা স্তর বা কোনও কোনও ক্ষেত্রে তারও নীচের স্তরের দলীয় পদাধিকারীরাও সোমবার হাজির ছিলেন নজরুল মঞ্চে। নেত্রীর বার্তা নিয়ে এলাকায় এলাকায় ফিরে যাওয়া এবং নেত্রীর নির্দেশ মতো লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করা— কোর কমিটি ডাকা হয়েছিল মূলত সেই লক্ষ্যেই। প্রত্যাশিত ভাবেই সে বৈঠকে নিজের ভাষণে বিজেপি বিরোধী সুর আরও চড়ানোর চেষ্টা করলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এখন থেকে লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত নিজের নিজের এলাকা ছাড়তে বারণ করলেন নেতা-কর্মীদের। রাজ্যের সবক’টি লোকসভা কেন্দ্রেই জিততে হবে— দলকে বার্তা নেত্রীর।

‘‘আমি যে বলছি বিয়াল্লিশটায় বিয়াল্লিশটা জিততে হবে, এটা কথার কথা নয়। অ্যাকশন চাই, প্ল্যানিং করতে হবে,’’—সোমবার এমনই বলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যে কোনও জোটের কথা যে তিনি ভাবছেন না, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন তা আরও একবার স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘সিপিএম কী করল আমাদের দেখার দরকার নেই। চিরকালই ওরা এ রকম করে গিয়েছে।’’ কংগ্রেস প্রসঙ্গে অবশ্য মমতার মন্তব্য সামান্য সাবধানী। প্রদেশ কংগ্রেস এবং জাতীয় কংগ্রেসকে যে তিনি একই চোখে দেখছেন না, তা-ও কৌশলে বুঝিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘‘কংগ্রেস রাজ্য স্তরে কী করবে আমাদের দেখার দরকার নেই। সিপিএম-কংগ্রেস ভাই ভাই এ তো আপনারা আগেও দেখেছেন।’’

Advertisement

আরও পড়ুন: খবর থাকা সত্ত্বেও জওয়ানদের মৃত্যুর মুখে ঠেললেন, রাজনীতি করবেন বলে? আক্রমণাত্মক মমতা

তবে চিন্তাটা যে শুধু কংগ্রেস আর বামেদের সমঝোতার সম্ভাবনা নিয়ে নয়, বিজেপির সঙ্গেও স্থানীয় স্তরে কারও সমঝোতা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়েও যে চিন্তা ঈষৎ রয়েছে, তা এ দিন বোঝা গিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষণে। সে প্রসঙ্গে তিনি বিজেপির নাম উচ্চারণ করেননি। কিন্তু বলেছেন, ‘‘পঞ্চায়েত নির্বাচনেও আমি বলেছিলাম জগাই-মাধাই-বিদাই। কেন বলেছিলাম? তিন জন একসঙ্গে কাজ করেছে বলে। এ বারেও দেখবেন কোথাও কোথাও তিন জনে একসঙ্গে কাজ করবে। তার আগেই আপনাকে জোট বাঁধতে হবে।’’ দলকে চেয়ারপার্সনের বার্তা, ‘‘আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা যখন বলেছি বিয়াল্লিশটায় বিয়াল্লিশটা-ই চাই, এটা আমার অ্যাকশন চাই।’’

আরও পড়ুন: ফের গুলি করে খুন তৃণমূল নেতা, এ বার মুর্শিদাবাদে

নেতা-কর্মীরা কি ভীত? তাঁরা কি দুর্বল হয়ে পড়ছেন? কোর কমিটির বৈঠকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন সে কথা জানতে চান? বেহালা এলাকায় ছেলেধরা গুজবে গণপ্রহারের ঘটনার বিরুদ্ধে আগেই মুখ খুলেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ দিন বেহালা প্রসঙ্গ টেনে এনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেন যে, রাত ১২টায় বেহালায় একটি মিছিল বার করা হয়েছিল। বাইক নিয়ে মিছিল হচ্ছিল বলেও তিনি অভিযোগ করেন। তার পরেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করার স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের? তাঁরা কি এলাকায় নজর রাখছেন না? যদি রাখেন, তা হলে রাত ১২টায় ওই মিছিল বেরলো কী ভাবে? এমন প্রশ্নই এ দিন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তোলেন। বেহালারই একটি অংশের বিধায়ক পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের সভাপতি শুভাশিস চক্রবর্তীকে সরাসরি প্রশ্নের মুখে দাঁড় করান মমতা। ‘‘আপনারা কী করছিলেন? এলাকায় নজর রাখেননি কেন? শুভশিসরা কী করছিল? পার্থদা কী করছিলেন? এলাকায় নজর রাখছেন না? নাকি ভয় পেয়ে যাচ্ছেন? নাকি দুর্বল হয়ে পড়ছেন? আসুন আলোচনা হয়ে যাক।’’ বলেন মমতা।

আরও পড়ুন: চিটফান্ড রুখতে নয়া অর্ডিন্যান্স কেন্দ্রের, বাড়তি ক্ষমতা তদন্তকারীদের

এ দিনের ভাষণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার সব রকম ভাবে ব্যর্থ। তাঁর কথায়, ‘‘গত পাঁচ বছরে একটা বিপর্যস্ত ভারতকে আমরা দেখলাম। আরও কয়েকটা দিন হয়তো দেখতে হবে, যতক্ষণ না নতুন সরকার না আসে।’’ বিজেপি-কে তীব্র আক্রমণ করে মমতার মন্তব্য, ‘‘এরা উগ্র, দানবীয়, বিদ্বেষী শক্তি।’’

বিজেপির বিরুদ্ধে সর্বাগ্রে জোরালো প্রতিবাদ করার সাহস যে তৃণমূলই দেখিয়েছে, দলকে সে কথা এ দিন মনে করিয়ে দিয়েছেন মমতা। তাঁর কথায়, ‘‘একটা লোক ভয়ে প্রতিবাদ করতে পারল না, একটা লোক ভয়ে প্রতিরোধ করতে পারল না! একমাত্র আমরা প্রতিবাদ করলাম, প্রতিরোধ করলাম। তাই আমাদের প্রতি ওদের এত জ্বালা।’’ তবে যে পথ তিনি ধরেছেন, সে পথ থেকে পিছু হঠার কথা যে তিনি একেবারেই ভাবছেন না, লোকসভা নির্বাচনের আগে দলকে তিনি সে কথাও বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। মমতা বলেন, ‘‘আমরা প্রতিবাদ করে যদি কিছু করে থাকি, ঠিক করেছি এবং আমাদের প্রতি তাদের জ্বালা মেটানোর জন্য তারা যা কিছু করুক, আমরা কিন্তু ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে তার জবাব দেব।’’

নির্বাচনের আগে বিজেপি নানা কৌশল অবলম্বন করবে, সে সব রুখতে সতর্ক থাকতে হবে— মমতার ভাষণের অনেকটা জুড়েই এ দিন ছিল এই রকম বার্তা। অশান্তি ছড়ানোর চেষ্টা হলেই পুলিশে খবর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। ‘‘পুলিশ যদি চিঠিটা না নেয়, তা হলে আমার বাড়ির দরজা খোলা আছে, আমার বাড়িতে এসে চিঠিটা দিয়ে যান।’’ এই মন্তব্যও করেছেন।

বৈদ্যুতিন ভোটযন্ত্রে (ইভিএম) বিজেপি কারচুপি করার চেষ্টা করবে বলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘আমার কাছে খবর আছে, বাংলায় ইভিএম কারচুপি করবে। একটা সংস্থাকে দায়িত্ব দিয়েছে। ওই যে বলছে ২৩-২৪টা পাব, ভাবছে কারচুপি করে করবে।’’ ‘আসুন ভাল করে করাব’— চ্যালেঞ্জ মমতার। ‘‘আমরা ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে লক্ষ্য রাখব,’’ হুঁশিয়ারি তাঁর।

দলের তরফে যাঁরা ভোট গণনা কেন্দ্রে থাকবেন, তাঁরা যেন ভিভিপ্যাট সম্পর্কে ভাল ভাবে ওয়াকিবহাল হন— দলকে নির্দেশ দিয়েছেন চেয়ারপার্সন। এখন থেকেই তৃণমূল ভবনে ভিভিপ্যাট নিয়ে কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য পার্থ চট্টোপাধ্যায়, দীনেশ ত্রিবেদী ও সৌগত রায়কে তিনি দায়িত্ব দিয়েছেন।

আর সবশেষে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, এ বারের নির্বাচনে বিপুল টাকা ছড়ানো হতে পারে। ওরা যদি অনেক হেলিকপ্টার নামায় কী করবেন? ওরা যদি অনেক গাড়ি নামায় কী করবেন? ওরা যদি অনেক বাইক দেয় কী করবেন? এ ভাবেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন প্রশ্ন ছুড়ে দিতে থাকেন কয়েক হাজার নেতা-কর্মীর দিকে। দলকে তাঁর আহ্বান— ‘‘আগের মতো একটু জাগুন তো।’’

২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে বাংলার ৩৪টি আসনে জয়ী হয়েছিলেন তৃণমূল প্রার্থীরা। সেই বিদায়ী সাংসদদের সবাই যে এ বার টিকিট পাচ্ছেন না, সে কথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট করে দিয়েছেন এ দিনের বৈঠকে। তিনি বলেছেন, ‘‘যারা ভাল কাজ করেছেন, তাঁরা সবাই থাকবেন, আমি কাউকে অসম্মান করব না, তৃণমূল কাউকে অসম্মান করে না।’’ তার পরে আরও ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য— কয়েকজনের একটি অসুবিধা আছে, তাঁদের দেখে দেব। এ প্রসঙ্গে কোনও বিশদ ব্যাখ্যায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাননি। তবে তৃণমূলের অন্দরে জল্পনা— যে সাংসদরা এ বার টিকিট পাবেন না, তাঁদের সম্মানজনক পুনর্বাসনের কথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভাববেন।

ভাষণের শেষে দলকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশ্ন, ‘‘লড়াইটা হবে তো? সামলে নেবেন তো? সব ধরনের হামলা সামলে নেবেন তো? ভয় পাবেন না তো?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন