সপ্তমীর কলেজ স্কোয়ার। — নিজস্ব চিত্র
সপ্তমীর সন্ধ্যা। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ এবং মহাত্মা গাঁধী রোডের সংযোগস্থলে এক জায়গায় গোল হয়ে গল্প করছেন কয়েক জন ট্রাফিক সার্জেন্ট। ব্যস্ততার লেশমাত্র নেই। রীতিমতো ‘রিল্যাক্সড’ মুডে সবাই।
কোভিড পরিস্থিতি গত কয়েক মাসে বদলে দিয়েছে অনেক কিছু। বদলে দিয়েছে পুজোর চেহারাও। সেই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলে গিয়েছে কলকাতা পুলিশের বহু বছরের পুরনো বিশেষ পুজো ‘বন্দোবস্ত’। গত প্রায় দশ বছর ধরে পুজোর ভিড় সামলাতে চতুর্থী থেকেই কলকাতা পুলিশের বিশেষ বন্দোবস্ত শুরু হয়ে যায়। সপ্তমী থেকে নবমী সবচেয়ে বেশি পুলিশকর্মী রাস্তায় নামেন। তিন শিফটে ২৪ ঘণ্টা কাজ করেন উৎসব নিরাপদ রাখতে।
এ বছরও অতীতের আদলেই তৈরি হয়েছিল পুলিশের ‘পুজো বন্দোবস্ত’। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোভিড পরিস্থিতিতে পুজো নিয়ে হাইকোর্টের নিদানে বদলে গিয়েছে সব ব্যবস্থা। প্রতিবছর রাস্তার ভিড় সামলাতে হিমশিম পুলিশের নয়া ‘ডিউটি’ এখন মণ্ডপের সামনে। ভিভিআইপি জোনের মতো করেই পাহারা দিতে হচ্ছে ছোট-বড় মণ্ডপ। যাতে ফাঁক গলে কেউ ঢুকে পড়তে না পারেন।
মহাত্মা গাঁধী রোডের ‘আড্ডা’য় দেখা পাওয়া গেল পরিচিত সার্জেন্টের। গত তিন বছর ধরে পুজোর দিনগুলোতে তিনি ওই মোড়েই ভিড় সামলাতেন। আয়েশ করে চা খেতে খেতে শুক্রবার সন্ধ্যায় বৃষ্টিভেজা রাস্তার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘‘মনে হচ্ছে দ্বাদশীর ভোররাতের কলকাতা।” কারণ, অন্যবছর সপ্তমীর সন্ধ্যা মানে মহম্মদ আলি পার্কের পুজো থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার লম্বা দর্শনার্থীদের লাইন। দড়ি আর বাঁশের ব্যারিকেডের ভিতরে ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষের ভিড় আটকে রেখে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ে যানচলাচল অব্যাহত রাখার চ্যালেঞ্জ।
মহম্মদ আলি পার্ক থেকে নিউ আলিপুরের সুরুচি সঙ্ঘ লাগোয়া দুর্গাপুর ব্রিজ, কলেজ স্ট্রিট বা শিয়ালদহ চত্বর— জনস্রোত বা যানের স্রোত কোনওটাই নেই। তাই অনেকটাই হালকা কলকাতা ট্রাফিক পুলিশের কর্তারা। তাঁদের হিসাবে, চতুর্থীর দিন ট্রাফিক সামলাতে পথে নেমেছিলেন প্রায় ২,৮০০ পুলিশকর্মী।ঠিক ছিল পরের দিনগুলোয় ভিড়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাহিনীর পরিমাণ বাড়িয়ে করা হবে ৪,০০০। তার সঙ্গে থাকবেন এনসিসি ক্যাডেট এবং ট্রাফিক ওয়ার্ডেনরা। কিন্তু এ বছর সপ্তমীর সন্ধ্যাতেও সেই বাহিনী নামানোর প্রয়োজন পড়েনি।
লালবাজারের এক কর্তা বললেন, ‘‘বরং বেশ কিছু জায়গা থেকে বাহিনী কমানো হয়েছে।” কিন্তু বাড়াতে হয়েছে মণ্ডপে পুলিশ কর্মীদের উপস্থিতি। কলকাতা পুলিশের এক পদস্থ অফিসারের কথায়, ‘‘প্রতিটি ডিভিশনের ডিসিদের বলা হয়েছে প্রতিটি পুজো মণ্ডপে বাড়তি বাহিনী দিতে।” প্রতিটি বড় পুজোয় গড়ে প্রতি শিফটে থাকছেন ৩০ থেকে ৩৫ জন পুলিশ কর্মী। কমিশনারের নির্দেশ, পুজো যতই ছোট হোক, মণ্ডপে পুলিশের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। সেই চাপ সামলাতে নাজেহাল বেহালা এবং যাদবপুর বিভাগের থানাগুলি। কারণ, কলকাতার ওই দুই বিভাগেই পুজোর সংখ্যা প্রায় ১,২০০। মোট ৩,০০০ পুজোর অর্ধেকের থেকে সামান্য কম। ওই ১,২০০ পুজোর মধ্যে বড় পুজোও যেমন আছে, তেমনই আছে ছোট পুজোও। কিন্তু সব জায়গায় পুলিশ মোতায়েন করতে ওই ডিভিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিসিদের বাড়তি বাহিনীর সাহায্য নিতে হচ্ছে।
আরও পড়ুন: ‘ভোলেনাথ শঙ্করা’ গানে নাচ মন্ত্রী সুজিতের, কেদারনাথ থিমে কি বিশেষ কোনও বার্তা
একই ছবি পূর্ব কলকাতাতেও। সেখানেও রাস্তা ফাঁকা। মণ্ডপের সামনেই পুলিশের ভিড়। রাস্তাতে ভিড় থাকুক না থাকুক, মণ্ডপে মোতায়েন বাহিনী। সপ্তমীর সন্ধ্যায় বাগবাজারের একটি পুজোর সামনে দাঁড়িয়ে কলকাতা পুলিশের এক সহকারী কমিশনার বললেন, ‘‘পুজোর আগে সত্যি খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম। গত কয়েক মাসে একের পর এক পুলিশকর্মী কোভিডে আক্রান্ত। থানার সাধারণ কাজকর্ম চালানোই কঠিন হয়ে উঠেছে। কারণ, আক্রান্তদের অনেকেই রিপোর্ট নেগেটিভ হওয়ার পরও তাঁরা কাজে যোগ দেওয়ার মতো অবস্থায় পৌঁছননি।” পুলিশ কমিশনার নিজেও পুজোর আগে বার বার বাহিনীর সদস্যদের সতর্ক করেছিলেন সুস্থ থাকতে। কলকাতা উত্তর ডিভিশনের এক পুলিশকর্তা বললেন, ‘‘ অন্য বছরের মতো পরিস্থিতি হলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ভিড় সামলানো সম্ভব হত না। আর তার পর আমাদের মধ্যে গণ সংক্রমণ হত।”
কিন্তু হাইকোর্টের নিদান, অকালবৃষ্টি কিছুটা স্বস্তি যুগিয়েছে পুলিশকর্তাদের। পরিস্থিতি বুঝে বদলেছে পুলিশি ব্যবস্থাপনাও। এখন অষ্টমী এবং নবমীর দিকে তাকিয়ে তাঁরা। আবহাওয়ার উন্নতির পর যদি ভিড় হয়! তবে এক পুলিশকর্তা বলেন,‘‘ বাকি দু’দিনেও খুব ভিড় হবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ শহরতলির ট্রেন বন্ধ। ফলে ওই ভিড়টা এড়ানো গিয়েছে।” সেই ভিড় নেই বলে তৃতীয়া থেকে সপ্তমী পর্যন্ত কলকাতার রাস্তায় ট্রাফিক সঞ্চালনের বড় কোনও পরিবর্তন করতে হয়নি। অনেক রাস্তা বন্ধ না করেও সচল রাখা গিয়েছে।
সপ্তমীর সন্ধ্যা যখন গড়াচ্ছে রাতের দিকে, এক পুলিশকর্তা বলছিলেন, ‘‘অন্যান্য বছর পুজোর দিন কলকাতা পুলিশের পারফরম্যান্স মাপা হয় শহর কতটা সচল রইল, তার উপর। এ বছর পরীক্ষার খাতা যাবে হাইকোর্টে। সেখানে পরীক্ষার ফলাফল নির্ভর করবে মণ্ডপ কতটা দর্শকশূন্য রইল, তার উপর।”
মণ্ডপ ‘শূন্য’ রাখতে স্ট্র্যাটেজি পাল্টে মণ্ডপের সামনে ‘জিরো টলারেন্স’ কলকাতা পুলিশের।