মতামত: তিন তালাক প্রথা বাতিল করেছে সুপ্রিম কোর্ট। তা নিয়ে আলোচনায় কলেজপড়ুয়ারা। বুধবার, রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডের একটি কলেজে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
তিন তালাক অসাংবিধানিক ঘোষিত হওয়ার পরে কেটে গিয়েছে একটা গোটা দিন। কেটেছে তাৎক্ষণিক উচ্ছ্বাসও। আর তার পরেই শুরু হয়েছে এই বদলে কার কী এল-গেল, সেই বিশ্লেষণ। শরিয়তি কানুনে হস্তক্ষেপ নিয়ে বহু মহলই উগরে গিয়েছে ক্ষোভ। আর কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাতে যোগ দিয়েছে এ শহরের শিক্ষিত তরুণ সমাজও।
বুধবার খাস কলকাতার একাধিক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে মিলল তেমন ছবিই। বহু পড়ুয়াই বললেন, ধর্মীয় বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ তাঁরা মানতে পারছেন না। শহুরে এই তরুণদের একাংশ স্পষ্ট জানালেন, তাঁরা এখনও মেনে চলতে চান ধর্মীয় কানুন। তাঁরা বিশ্বাস করেন, শরিয়তের নিয়মই তাঁদের সমাজকে দিশা দেখায়।
কিন্তু শরিয়তে তিন তালাক সম্পর্কে ঠিক কী বলা আছে? প্রশ্ন এড়িয়েছেন অনেকেই।
মধ্য কলকাতার একটি কলেজের মাইক্রোবায়োলজির দ্বিতীয় বর্ষের মাহবিশ ফতিমা যেমন মনে করেন, শরিয়তের নিয়ম মুসলিম সম্প্রদায়ের ভালর জন্যই। তাঁর কথায়, ‘‘আদালতের রায়কে অবমাননা করতে চাই না। কিন্তু শরিয়তকে অগ্রাহ্য করতে পারব না। তালাক নিয়ে কারও সমস্যা হলে মুসলিম পার্সোনাল ল’ কিংবা মৌলবির কাছে যেতে পারেন।’’
আরও পড়ুন: লড়াই শেষ হয়নি, বলছেন জাকিয়া-নুরজাহান
সমাজতত্ত্বের আর এক ছাত্রী সমাইরা খাতুন আবার মনে করছেন, এই রায় এক অর্থে গণতন্ত্রের উপরে হস্তক্ষেপ। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা থেকে নাগরিকদের নজর সরাতে কেন্দ্রীয় সরকার এই বিষয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু করে। যার ফল এই রায়। অর্থনীতির ছাত্র মহম্মদ জিশানের মন্তব্য, ‘‘হোয়াট্সঅ্যাপে কিংবা এসএমএসে তালাক দেওয়ার ঘটনা বিচ্ছিন্ন। গোটা সমাজে তালাকের পদ্ধতি এমনটা নয়। তাই শরিয়তের নিয়ম মেনে তিন তালাক হওয়া উচিত।’’ তবে দু’-একটা ঘটনার জন্য একটা সম্প্রদায়ের মানুষের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা যায় না বলেই মত তাঁর।
তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশের আবার মত, এ দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শরিয়ত মেনে তিন তালাক ব্যবহৃত হচ্ছে না। শরিয়ত মেনে চললে এমন সমস্যা তৈরিই হয় না বলে মত তাঁদের। কিন্তু কী বলা আছে শরিয়তে, যা মানা হচ্ছে না? তার উত্তর অবশ্য স্পষ্ট নয় সকলের কাছে।
তবে কি এটাই তরুণ প্রজন্মের একমাত্র বক্তব্য? তা নয়। সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে কেউ কেউ বলেছেন, খলিফার সময়ে তৈরি হওয়া নিয়ম আধুনিক সমাজে চালানো ঠিক নয়। যেমন সমাজতত্ত্বের প্রথম বর্ষের পড়ুয়া জেবা হুসেন মনে করেন, গণতান্ত্রিক সভ্য দেশে প্রতিটি মানুষের সমানাধিকার দরকার। ‘‘ছেলেদের মতো মেয়েদেরও তালাক দেওয়ার অধিকার থাকবে না কেন?’’ প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। জেবার মতে, বৈবাহিক সম্পর্ক তৈরি কিংবা বিচ্ছেদ হওয়া উচিত আইন মেনে। তবে মহিলাদের তা নিয়ে সচেতন না করলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না। তিনি বলেন, ‘‘যাঁদের জন্য এই রায়, সেই মেয়েদের অনেকেই তো খোলা মনে এই রায় মানতে পারছেন না। ছোট থেকেই যদি নিজেদের অধিকার নিয়ে সচেতন হওয়ার শিক্ষা না দেওয়া হয়, তবে তাঁরা বুঝবেন কী করে যে তিন তালাকের অপব্যবহারের জন্য এগোতে বাধা পাচ্ছে মেয়েরা?’’
একই সুর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সদ্য প্রাক্তনী তাসলিম আলিরও। তিনি মনে করেন, তিন তালাকের ধারণাটি খুবই বৈষম্যমূলক। তাৎক্ষণিক তিন তালাকের আতঙ্কে অধিকাংশ মহিলা সংসারের সামান্য বিষয়ে মতামত দিতে ভয় পান। এ ভাবে কি সুস্থ পরিবার তৈরি হতে পারে? সুপ্রিম কোর্টের এই রায় মহিলাদের ক্ষমতায়নের পাশাপাশি সমগ্র মুসলমান সমাজের প্রগতিতে সাহায্য করবে। একই মত পদার্থবিদ্যায় স্নাতোকত্তর সঙ্কেত হকের। তিনি মনে করেন, নারীর সমানাধিকার না থাকলে কোনও সমাজেরই বিকাশ ঘটে না। মুসলিম সমাজের এগিয়ে যাওয়ার জন্য এই রায় খুবই জরুরি। তবে এই আইনই যথেষ্ট নয়, পর্দাপ্রথা বিলোপ, মহিলাদের শিক্ষার প্রসার-সহ একাধিক বিষয় নিয়েও ভাবা প্রয়োজন বলে মত তাঁর।