ভরা শ্রাবণে মধ্যবিত্ত বাঙালির পাতে ইলিশ নেই।
বাজারে ইলিশ রয়েছে। কিন্তু আগুন দামে পকেট পোড়ানোর ক্ষমতা ক’জনেরই বা আছে! ইলিশ কেনার স্বপ্ন ভুলে যাঁরা থলে হাতে রকমারি চারা মাছের খোঁজে বাজারে যাচ্ছেন, তাঁদের দরের ধাক্কায় কম্পমান অবস্থা। অগত্যা আতিপাতি খুঁজে কেউ কয়েক টুকরো কাটা পোনায় থলি ভরছেন। কেউ হিসেব কষে ওজন দেখে ট্যাঙরা, মাগুর কিনছেন। কেউ কেউ ইলিশের স্বাদ মেটাচ্ছেন খোকা ইলিশে।
সাত সকালে বনগাঁ থেকে বসিরহাট, হলদিয়া থেকে দুর্গাপুর-কান পাতলে মাছের বাজারে দর আর দরাদরির চিত্রটা একসূত্রে বেঁধে ফেলেছে বাংলাকে। গাইঘাটার রমেন বিশ্বাস, দুর্গাপুরের বুদবুদ বাজারের মহম্মদ আকবরের মতো সিংহভাগ মাছের ব্যবসায়ীর দাবি, দক্ষিণবঙ্গের সাম্প্রতিক বন্যাই ভিলেন। পুকুর, খাল-বিলের মাছ ভেসে গিয়েছে। বাজারে মাছের জোগান কম। চারা পোনা ও রকমারি ছোট মাছের পাইকারি দর তাই চড়ছে। যার ফলে, বাজারেও মাছের দাম ঊর্ধ্বমুখী। আর জোগানের অভাবে বড় ইলিশ তো সাধারণের নাগালের বাইরে।
মেদিনীপুরের বাজারে এখন খোকা ইলিশেরই ছড়াছড়ি। ওজন একশো-দেড়শো গ্রাম। দাম কেজি প্রতি ৩৫০-৪০০ টাকা। ওজন একটু বেশি হয়ে চারশো-পাঁচশো গ্রাম হলে দাম কেজি প্রতি ৬৫০-৭০০ টাকা। এক কেজির বেশি ওজনের বড় ইলিশের দাম ২৩০০-২৫০০ টাকা। বড় ইলিশের যে স্বাদ-সুঘ্রাণ থাকে, তা মাঝারি কিংবা ছোট ইলিশে সাধারণত মেলে না। মেদিনীপুরের বাসিন্দা পারমিতা রায়ের কথায়, “আড়াই হাজার টাকা দিয়ে ইলিশ কেনা সম্ভব নয়। তাই বাধ্য হয়েই ছোট ইলিশ নিতে হচ্ছে।” আবার ইলিশের আগুন দামের জন্য ক্রেতাদের একাংশের কাছে ট্যাংরা, মাগুর, পার্শের কদর বেড়েছে বলে মাছ ব্যবসায়ীদের দাবি। মেদিনীপুরের মাছ ব্যবসায়ী সুমিত কারকের কথায়, “বড় ইলিশের দাম বেশি বলে অনেকে নিতে পারছেন না। বরং ৬০০ টাকা কেজি ট্যাংরা ও ৮০০- ৯০০ টাকা কেজির মাগুরের চাহিদা বেড়েছে।”
উত্তর ২৪ পরগনার বাজারগুলিতে ইলিশের দেখা মিলছে না। ডায়মন্ড হারবারে ইলিশের জোগান এ বার অনেকটাই কম। বাজারে যা-ও রয়েছে তা ৮০০ থেকে হাজার টাকার মধ্যে। চোরা পথে বাংলাদেশের দু’একখানা ইলিশ যদিও-বা ঢুকছে, সেগুলির দাম দেড় থেকে দু’হাজার টাকা। বনগাঁ ও বসিরহাটের বাজারে দেশি পুঁটি কিংবা ট্যাংরার দর চারশো থেকে পাঁচশো টাকার আশে পাশে। শিঙি মাছের দর ৬০০ টাকা কেজি শুনে পটলডাঙার প্যালারামের মতো পিলে চমকাচ্ছে ক্রেতাদের। চারাপোনার দামও এবার বেশ চড়া। আগে ছিল ১০০-১২০ টাকা প্রতি কেজি। এবার সেটাই ১৬০ থেকে ২০০ টাকা কিলো।
বনগার নির্মল বিশ্বাসের আক্ষেপ, “অন্যান্য বার দাম নাগালে থাকায় ভরা শ্রাবণে বেশ কয়েক বার ইলিশ খেয়েছি। এবার ইলিশের ধারে কাছে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। চারা পোনার দামও বেশ চড়া। অন্য মাছ যে খাব, সে সবের দামও তো দিনে দিনে নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।” দুর্গাপুরের বুদবুদ বাজারে মৌরলার দর ২০০-৩০০ টাকা। কুঁচো চিংড়িও ১৫০-২৫০ টাকার মধ্যে। দামের দিক থেকে মেছো বাঙালিকে অক্কা পাইয়ে দেবে শিল্পনগরী দুর্গাপুরের মামরা বাজার। এখানে পুঁটি ও মৌরলার দর কেজি প্রতি ৪০০-৬০০ টাকা। মামরা বাজারে নিয়মিত মাছের খদ্দের কাঁকসার তাপস দত্ত বললেন, “ইলিশের বদলে ছোট মাছ কিনতে গিয়েও তো পকেট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে।” একই রকম অবস্থা দুর্গাপুরের অন্য বাজারগুলিতেও। আর এক শিল্পাঞ্চল হলদিয়ার মাখনবাবুর বাজারে এখন রূপনারায়ণের ইলিশ মিলছে। এক কেজি ওজনের ইলিশ ১৮০০ টাকা থেকে শুরু। দু’কেজি ওজনের ইলিশ কেজি প্রতি ২৪০০-২৫০০ টাকা। হলদিয়ার একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী সুব্রত প্রধান বলেন, “মাছের বাজারে ভিরমি খেতে হচ্ছে। বেশির ভাগ দিন ডিম খাচ্ছি।” হলদিয়ার একটি হাইস্কুলের শিক্ষক অসিত শতপথীর কথায়, “এখন যা অবস্থা, মাছের চড়া দামের তুলনায় ব্রয়লার মুরগির দাম কম। কিন্তু পাতে মাছ না থাকলে দিনটাই তো বিস্বাদ!”
মত্স্যপ্রিয় বাঙালিকে মাছে-ভাতে রাখবে কে? জবাব চান বঙ্গবাসী।
(তথ্য সহায়তা: সীমান্ত মৈত্র, বিপ্লব ভট্টাচার্য, বরুণ দে, সামসুদ্দিন বিশ্বাস)