Waqf Amendment Act 2025

বঙ্গের ওয়াকফ সম্পত্তির বিবরণ দেওয়া শুরু কেন্দ্রীয় পোর্টালে, সিদ্দিকুল্লা চান মমতার হস্তক্ষেপ, কেন নির্দেশিকা দিল নবান্ন

সংশোধিত ওয়াকফ আইন ঘিরেই চলতি বছরের গোড়ার দিকে মুর্শিদাবাদ, মালদহের বিভিন্ন জায়গায় হিংসার আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল। যা সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়েছিল প্রশাসনকে। তবে এই পর্বে তৃণমূল এবং প্রশাসন সতর্ক থেকেই পা ফেলতে চাইছে।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০২৫ ১০:৩১
Share:

সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী (বাঁ দিকে), মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (ডান দিকে)। —ফাইল চিত্র।

সংশোধিত ওয়াকফ আইননের সর্বাত্মক বিরোধিতা করেছিল তৃণমূল। সেই বিরোধিতার তীব্রতা এতটাই ছিল যে, ওয়াকফ সংক্রান্ত যৌথ সংসদীয় কমিটির (জেপিসি) বৈঠকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে কাচের বোতল আছড়ে ভেঙেছিলেন, নিজের ডান হাত কেটে রক্তারক্তি করেছিলেন তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গে যে ওয়াকফ আইন বলবৎ হবে না, তা একাধিক বার বক্তৃতায় জানিয়ে সংখ্যালঘুদের আশ্বস্ত করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাজ্য সরকারের সংখ্যালঘু বিষয়ক ও মাদ্রাসা শিক্ষা দফতর সব জেলাশাসককে নির্দেশিকা পাঠিয়ে বলেছে, ওয়াকফ সম্পত্তির বিবরণ কেন্দ্রীয় সরকারের ‘উমিদ’ পোর্টালে নথিভুক্ত করতে হবে। তার পর থেকেই নানা মহলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, তা হলে কি মমতার সরকারও সংশোধিত ওয়াকফ আইন মেনে নিয়ে তা বলবৎ করা শুরু করে দিল?

Advertisement

ওয়াকফ বোর্ডের একাধিক কর্তার বক্তব্য, এই নির্দেশিকা জারি না-করে কোনও উপায় ছিল না। কেন্দ্রীয় সরকারের নির্ধারিত সময়সীমা ৫ ডিসেম্বর। তার মধ্যে ওয়াকফ সম্পত্তির বিবরণ পোর্টালে নথিভুক্ত না-করলে আইনগত ভাবে ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। তা এড়াতেই এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জেলাশাসকদের। ওয়াকফ বিষয়ে সম্যক ধারণা রয়েছে সরকারের এক প্রথম সারির কর্তার ব্যাখ্যা, ‘উমিদ’-এর আগে ‘ওয়ামসি’ নামের একটি পোর্টাল ছিল। বাংলার ওয়াকফ সম্পত্তির ৮০ শতাংশ বিবরণ নথিভুক্ত হয়েই রয়েছে। ফলে কাজটা কঠিন নয়।

পশ্চিমবঙ্গে ৮,০৬৩টি ওয়াকফ এস্টেটের অধীনে ৮২,৬০০টি ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে। আনুষ্ঠানিক ভাবে না বললেও একান্ত আলোচনায় ওয়াকফ বোর্ডের এক শীর্ষকর্তার দাবি, সুপ্রিম কোর্টে ওয়াকফ সংক্রান্ত মামলা ঝুলে থাকলেও বিবরণ নথিভুক্তিকরণের বিষয়ে শীর্ষ আদালত কোনও স্থগিতাদেশ দেয়নি। অন্য একাধিক ধারায় অন্তর্বর্তী স্থগিতাদেশ দিলেও আদালত আইনত এই বিষয়টিকে এখনও পর্যন্ত ছাড় দিয়ে রেখেছে। ফলে বিচারাধীন আইনের কোনও একটি নির্দিষ্ট ধারা না-মানলে তার অভিঘাত হতে পারে সুদূরপ্রসারী। এবং তা হবে নেতিবাচক। সেই ঝুঁকি সরকার নেয়নি।

Advertisement

যদিও প্রশাসনের অনেকেই বলছেন, গোটা পরিকাঠামো যখন এসআইআর নিয়ে মনোনিবেশ করেছে, তখন এ হেন নির্দেশিকা গোদের উপর বিষফোড়া হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। এত কম সময়ে ওয়াকফ সম্পত্তির নথিভুক্তিকরণ কী ভাবে সম্ভব, সেই প্রশ্ন তুলছেন মমতার সরকারের অন্যতম মন্ত্রী তথা জমিয়তে-উলেমা-ই-হিন্দের পশ্চিমবঙ্গের সভাপতি সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘‘আমি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দাবি জানাব, তিনি যাতে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে এই বিবরণ জানানোর সময়সীমা বৃদ্ধি করার অনুরোধ করেন।’’ সিদ্দিকুল্লার বক্তব্য, যতটা সহজ ভাবা হচ্ছে, ততটা সহজ কাজ নয়। তাঁর কথায়, ‘‘পোর্টালে বিবরণ নথিভুক্ত করতে গেলে ৪৬টি জায়গায় খতিয়ান দিতে হবে। কোন বছর সংশ্লিশষ্ট সম্পত্তি ওয়াকফ হয়েছিল, চৌহদ্দি কতটা, মোতোয়াল্লি (রক্ষণাবেক্ষণ যিনি করেন) কে, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে কি না, সম্পত্তির বাজারমূল্য কত ইত্যাদি নানাবিধ ফিরিস্তি দিতে হবে। তা এত দ্রুত সম্ভব নয়।’’ তবে একেবারে শেষ সময়ে এ হেন নির্দেশিকা দেওয়া নিয়ে সিদ্দিকুল্লা সরকারের কোনও অন্যায় দেখছেন না। তাঁর অভিযোগ, ওয়াকফ বোর্ডই যথাযথ ভাবে কাজটা করতে পারেনি। কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের মন্ত্রী ফিরদাহ হাকিমের যেমন বক্তব্য, ‘‘আমরা ওয়াকফ আইনের বিরুদ্ধে। আজও তা-ই আছি। কিন্তু সম্পত্তি ওয়েবসাইটে নথিবদ্ধ করতে অসুবিধা কী আছে? এটা ভাল যে, জমিটা যে সরকারের আওতাভুক্ত, সেটা চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ‌স্বচ্ছতা তো সবসময় ভাল।’’ পাল্টা আইএসএফ বিধায়ক তথা ফুরফুরা শরিফের পিরজাদা নওশাদ সিদ্দিকি বলছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীই বলেছিলেন, এ রাজ্যে ওয়াকফ আইন বলবৎ হতে দেবেন না। তাঁর সরকারই সেই আইন মানতে নির্দেশিকা দিচ্ছে। সংখ্যালঘুদের এ বার বোঝার সময় এসেছে।’’

ওয়াকফ সম্পত্তি বেদখলের অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে। রাজ্যের প্রধান বিরোধীদল বিজেপির-ও বক্তব্য, ওয়াকফের জমি তৃণমূল জমি হাঙরদের হাতে তুলে দিচ্ছে। যদিও ওয়াকফ বোর্ডের কর্তারা সংশোধিত আইনের মৌলিক একটি বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তাঁদের বক্তব্য, আইনশৃঙ্খলার মতো জমির বিষয়টি রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার ছলে বলে কৌশলে আইন পাশ করিয়ে সেই মৌলিক জায়গাটিতেই আঘাত করেছে। এই যুক্তি সুপ্রিম কোর্টেও পেশ করা হয়েছিল। কিন্তু আদালত এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেনি।

সন্দেহ নেই সংখ্যালঘুদের কাছে ওয়াকফ সম্পত্তির বিষয়টি ‘স্পর্শকাতর’। যেমন হিন্দুদের কাছে দেবোত্তর সম্পত্তি। সংশোধিত ওয়াকফ আইন ঘিরেই চলতি বছরের গোড়ার দিকে মুর্শিদাবাদ, মালদহের বিভিন্ন জায়গায় হিংসার আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল। যা সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয়েছিল প্রশাসনকে। তবে এই পর্বে তৃণমূল এবং প্রশাসন শুরু থেকেই সতর্ক পদক্ষেপ করতে চাইছে। কারণ, শাসকদলকে একাধিক বিষয় মাথায় রাখতে হচ্ছে। প্রথমত, সামনেই ভোট। তার আগে যাতে কোনও ভাবেই কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, যার ফলে মেরুকরণের আবহ আরও তীব্র হয়ে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, আইনের বিষয়টিও সরকারকে মাথায় রাখতে হচ্ছে। তৃতীয়ত, সংখ্যালঘু ভোট তৃণমূলের কাছে ‘পুঁজি’। সেখানে যাতে কোনও অযাচিত অসন্তোষ না তৈরি হয়, তা-ও জরিপের মধ্যে রাখছে দল এবং প্রশাসন। তৃণমূলের সংখ্যালঘু সেলের চেয়ারম্যান তথা ইটাহারের বিধায়ক মোশারফ হোসেনের কথায়, ‘‘দলের তরফে আমরা গোটা বিষয়টির উপর নজর রাখছি। কোনও ভাবেই ঘুরপথে বিজেপি-কে ওয়াকফ সম্পত্তি দখল করতে দেব না।’’

রাজ্য সরকারের আধিকারিক থেকে সিদ্দিকুল্লা— প্রায় সকলের কথাতেই স্পষ্ট, এই নির্দেশিকা জারি না-করে কোনও উপায় ছিল না নবান্নের। তার সময় নিয়ে তর্ক থাকতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা নিয়ে কেউই প্রায় দ্বিমত পোষণ করছেন না। এখন দেখার, কতটা তৎপরতার সঙ্গে জেলাগুলি ওয়াকফ সম্পত্তির বিবরণ ‘উমিদ’ পোর্টালে নথিভুক্ত করে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement