প্রেজেন্টস্
Knowledge Partner
Fashion Partner
Wedding Partner
Banking Partner
Comfort Partner

বাবা তোরা ঘুগনিদানার মতো মিলেমিশে থাক, বোঁদের কণার মতো একসঙ্গে বাঁচ

এরা আসলে নানা মত, নানা চিন্তা, নানা শিক্ষা এবং নানা রুচির বাঙালি-আত্মার এক একটি জলজ্যান্ত প্রতিচ্ছবি।

রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৮ ১১:২৫
অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব।

অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব।

কানে কোনও শব্দ শুনলেই, চোখের সামনে তার একটা ছবি ভেসে ওঠে। না, এটা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়, বরং খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা। একই শব্দ আলাদা আলাদা মানুষের বেলায় কিন্তু আলাদা আলাদা ছবি তৈরি করে। যেমন ‘মহাভারত’ বললেই মানুষ চোখের সামনে অর্জুনের লক্ষ্যভেদ, কর্ণের রথচক্রগ্রাস, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ কিংবা রথের ওপর বসে থাকা কৃষ্ণ ও অর্জুনের ক্যালেন্ডার-মার্কা হিট ছবি দেখতে পায়। আর আমি দেখতে পাই, একটা বুড়ো হনুমান বনের মধ্যে পথ আটকে শুয়ে আছে আর তার লেজ ধরে টানাটানি করছেন বলশালী ভীমসেন, কিন্তু তাকে একচুলও নড়াতে পারছে না!

তেমনই ‘বিজয়া’ এই তিন অক্ষরের শব্দটি এক বার কানে শুনলে আমার চোখের সামনে কিছুতেই মানুষের কোলাকুলি, সারসার আলোর গেট, লাইন দেওয়া ঢাকির দল— এ সব ফুটে ওঠে না। শুধু ভেসে ওঠে একটা মাঝারি মাপের কাজকরা কাচের থালা, যার এক পাশে রাখা কাচের বাটিতে কিছুটা ঘুগনি। তার পাশে একদলা শুকনো বোঁদে। একমুঠো কুচো-নিমকি। আর খান দুই পুরুষ্টু নারকোলের নাড়ু।

আচ্ছা, আমার এটা কেন হয় বলুন দেখি? আমি খেতে খুব ভালোবাসি বলে? নাকি বিজয়া করতে গেলে, বরাবর এই চারটি পদ দিয়ে সাজানো থালা-ই আমার দিকে হেলেদুলে এগিয়ে আসে বলে! কোনও রহস্য কি লুকিয়ে আছে বাঙালি মা-বোনেদের নিজের হাতে বানানো ওই দু’টি নোনতা আর দু’টি মিষ্টির অস্তিত্বের মধ্যে? কেন তাঁরা যুগে যুগে, প্রধানত এদের দিয়েই বিজয়া দশমীর দিনটিকে উদ্‌যাপন করার কথা ভেবে এসেছেন! এ জন্যে আমাদের এই পদগুলির রন্ধন-কৌশলের ওপর আরও এক বার আলতো করে চোখ বুলিয়ে নিতে হবে।

আরও পড়ুন: মনমিষ্টি-পদ্মচক্র পাখার হাওয়ায় দেবতারাও শরীর জুড়োতেন

ঘুগনি-মটর হল মটরের ছোট্ট ছোট্ট দানা। সারা রাত তাদের জলে ভিজিয়ে, পরের দিন প্রেসার কুকারে সিটি বাজিয়ে তাদের সেদ্ধ করতে হয়। তার পর গোটাজিরে, তেজপাতা, আদাবাটা, হলুদ, নুন, মিষ্টি— এইসব অল্প তেলে ভেজে, তার সঙ্গে মটরটিকে ভাল করে মিশিয়ে, চড়া আঁচে ভাল করে ফুটিয়ে নামিয়ে নিতে হয়। শেষে সামান্য তেঁতুল-গোলা জল, ধনেপাতাকুচি, ভাজাজিরে-গুঁড়ো আর পাতিলেবুর রস ওপরে ছড়িয়ে, দুধসাদা কাচের বাটিতে চামচ-সহ পরিবেশন। আর তাতেই মারমার কাটকাট!

অলঙ্করণ: দেবাশীষ দেব।

শুকনো বোঁদে হল কড়ায়ের ডালের বিন্দু বিন্দু ভাজা দানা। বেসনকে একটুখানি খাবার-সোডা দিয়ে মেখে, ঝাঁঝরিওয়ালা ছানতার মধ্যে দিয়ে, কড়ায় ফুটতে থাকা গরম তেলের ওপর ফেললে, ডালের অমন ছোট্ট ছোট্ট ফাঁপা ‘গুলি’ তৈরি হয়। তাদের কড়া-আঁচে চিনির রসে খানিক্ষণ ফুটিয়ে, রস ঝরিয়ে নিলেই শুকনো বোঁদে তৈরি।

আরও পড়ুন: নাটক হয়ে গেলেও চরিত্রের নাম ধরে ডাকা চলত বহু দিন

কুচো-নিমকি বানানো তো আরওই সহজ। ভাল করে ময়ান দিয়ে মাখা ময়দার গোল চাকতি বানিয়ে, তার ওপর জোয়ান ছড়িয়ে দিতে হয়। কেউ কেউ আবার জোয়ানের বদলে কালোজিরেও দিয়ে থাকেন। তার পর তার বুকের ওপর খুন্তির ধারালো পিছন দিকটি দিয়ে আড়াআড়ি আর লম্বালম্বি দাগ টানলেই, অনেকগুলো ছোট্ট ছোট্ট চৌকো টুকরো উঠে আসে। সেগুলোকে ভালো ঘিয়ে ভেজে নিলেই খাস্তা আর মুচমুচে নিমকি রেডি।

আর দুরমো নারকেল ভাল করে কুরিয়ে, তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা দুধ-সাদা নরম মোলায়েম কণাগুলোকে আখের গুড় বা চিনির সঙ্গে ঢিমে আঁচে পাক দিয়ে, হাতে করে গোল্লা পাকিয়ে পাকিয়ে অতি উপাদেয় নাড়ু তৈরি করা হয়। উনুনের আঁচ এবং পাক করার সময়ের ওপর নাড়ুর স্বাদ নির্ভর করে। চিনি দিয়ে তৈরি সাদা-নাড়ু বানানোর সময় অনেকে আবার নারকেলটাকে বেটেও নেন। আর পাক দেওয়ার সময় সঙ্গে একটু খোয়া ক্ষীর আর এক চিমটে ছোট এলাচের গুঁড়ো মিশিয়ে দেন। এতে নাড়ুটির স্বাদ এক অপার্থিব মাত্রা পায়।

আরও পড়ুন: পকেটমারি তো ‘হস্তশিল্প’-র বাইরে নয় রে বাবা!

এত ক্ষণ ধরে, বাঙালির অতি প্রিয় যে চারটি খাবার তৈরি করার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করলাম, সেটা পড়ে আপনারা নিশ্চয়ই আমার ওপর যারপরনাই বিরক্ত হয়েছেন। মনে মনে ভাবছেন— এ-ব্যাটা আর কিছু না পেয়ে, শেষে গুচ্ছের চেনা রেসিপি লিখে কাগজের পাতা ভরানোর ফন্দি বাগিয়েছে! কিন্তু সুধী পাঠক-পাঠিকা, এতটা সময় যখন আপনারা আমায় দিলেন, তখন অনুগ্রহ করে আর একটুখানি দিন। আসলে আমার বলার কথাটি অত্যন্ত সরল এবং সোজা। ঘুগনি, শুকনো বোঁদে, কুচো-নিমকি এবং নারকেল নাড়ু— এই চারটি পদ বানানোর সময়, প্রতি ক্ষেত্রেই এদের উপাদানগুলিকে খুব ছোট্ট ছোট্ট কণা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আর সেগুলোকে একসঙ্গে জড়ো করে, একটি দল বা সমষ্টির মর্যাদা দেওয়া হয়েছে ।

সেদ্ধ মটরের একটি দানা, বোঁদের এক একটি ছোট্ট বিন্দু, নিমকির ছোট্ট একটা চারকোনা টুকরো কিংবা কুরোনো নারকেলের সূক্ষ্ম একরত্তি কণা— এরা আসলে নানা মত, নানা চিন্তা, নানা শিক্ষা এবং নানা রুচির বাঙালি-আত্মার এক একটি জলজ্যান্ত প্রতিচ্ছবি। আমরা বাংলার দাপুটে পুরুষরা চিরটাকাল পুকুর থেকে ইয়াবড়ো কাতলা টেনে তুলে, কেটে টুকরো টুকরো করি। পুকুরপাড় থেকে গোটা কচুগাছ উপড়ে তুলে, তাকে কুচিয়ে, কেটে ছোট্ট ছোট্ট ফালি করি। মস্ত রসা-কাঁঠালকে গাছ থেকে টেনে নামিয়ে ছিন্ন-ভিন্ন করে ছড়িয়ে দিই তার গর্ভের যত কোয়া। নিজের হাতে যত্ন করে ভেঙে-কেটে টুকরো টুকরো করি নিজের সোনার বাংলাকে। তার পর গর্বে-অহংকারে বুক ফুলিয়ে তারা ভরা আকাশের নীচে রক্তমাখা নিঃসঙ্গ অসুরের মতো খড়গ হাতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। নিঃসঙ্গ, কেননা, যে মহিষটি শেষ পর্যন্ত আমাদের যাত্রাপথের সঙ্গী ছিল, দু’টি দেশের কাঁটাতারের বেড়ায় তারও মাথা এবং ধড় আজ ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে।

আরও পড়ুন: আঁচলে অ্যাত্তোখানি আর খোল এত ফাঁকা!

আর মা দুর্গার বিসর্জনের পরেও যাঁরা আমাদের ঘরের কোণে স্নিগ্ধ প্রদীপ হয়ে রয়ে গেলেন, চোখের জলে যাঁরা নিজের মুখের কথা হারালেন, তাঁদের পাশটিতে গিয়ে বসলে, ওঁদের হাতে তৈরি ওই চার ধরনের খাবার আমাদের দিকে থালায় করে বাড়িয়ে ধরে, কোন সুদূর অতীত থেকে তাঁরা শুধু নিঃশব্দে বোঝানোর চেষ্টা করে আসছেন— বাবা তোরা ঘুগনিদানার মতো মিলেমিশে থাক, বোঁদের কণার মতো একসঙ্গে বাঁচ, কুচো-নিমকির টুকরোর মতো একে অপরের সুখ-দুঃখের সাথী হ’। নারকেলের ওই খুদিখুদি কণাগুলোকে দেখে শিখে নে— কী ভাবে মিলেমিশে বাঁচতে হয়! আনন্দে থাকতে হয়! তবেই তো তোদের কোলাকুলি করা সার্থক, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করা সার্থক আর বিজয়ার এই দিনটিকে অন্তর থেকে ‘শুভ বিজয়া’ বলতে পারা সার্থক!

Durga Puja Food Durgotsav Recipes দুর্গাপুজো খাবার Puja special sweets
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy