প্রেজেন্টস্
Knowledge Partner
Fashion Partner
Wedding Partner
Banking Partner
Comfort Partner

ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান অস্ত্র কীর্তন শাক্ত রামপ্রসাদের কালীকীর্তন হল কী করে ?

বাংলার কীর্তনের ইতিহাসে শ্রদ্ধেয় হিতেশরঞ্জন সান্যাল মহাশয় বলছেন, ‘কৃৎ ধাতুর অর্থ প্রসংসা।

রাজা পোদ্দার

শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২৫ ২০:২৯
প্রতীকী চিত্র।

প্রতীকী চিত্র।

বর্হাপীড়ং নটবরবপুঃ কর্ণয়োঃ কণিকারং

বিভ্রদ&বাসঃ কনককপিশং বৈজয়ন্তীঞ্চ মালাম&।

রন্ধান্‌ বেণোরধরসুধয়া পূরয়ন্‌ গোপবৃন্দৈঃ

বৃন্দারণ্যংশ্বপদরমণং প্রাবিশদ্ গীতকীত্তিঃ ॥

-শ্রীমদ্ভাগবতম্

‘সুন্দর দেহ, মাথায় মযূরপুচ্ছের ভূষণ, কানে কাণিকার ফুল, সোনার মতে উজ্জ্বল পীতবাস পরণে, গলায় বৈজয়ন্তীমালা (পরিয়া) অধরে নাস্ত বেণু বাজাইতে বাজাইতে (শ্রীকৃষ্ণ) নিজ লীলাভূমি বৃন্দাবনে প্রবেশ করিলেন। তখন গোপগণ চারিদিকে তাঁহার কীর্তি গান কারিতেছিল।Õ

বাংলার কীর্তনের ইতিহাসে শ্রদ্ধেয় হিতেশরঞ্জন সান্যাল মহাশয় বলছেন, ‘কৃৎ ধাতুর অর্থ প্রসংসা। কীর্তি ও কীর্তন এই দুইটি শব্দই কৃৎ ধাতু হইতে আসিয়াছে। রূপে. শৌর্যে, জ্ঞানে, কর্মে যিনি শ্রেষ্ঠ তাঁহার নাম স্মরণ, গুণ, বর্ণনা, যশোসূচক গানের নাম কীর্তন।

জীব গোস্বামী ক্রমসন্দর্ভঃ গ্রন্থে বলেছেন, বহু জনেক সম্মীলিত কৃষ্ণ বিষয়ক গানই হল সংকীর্তন।

কীর্তন হল ভাবআন্দলোনের অন্যতম হাতিয়ার। শ্রী চৈতন্যদেবের ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম অস্ত্রই ছিল এই সংকীর্তন।

যা কৃষ্ণকীর্তি বর্ণিত করে, যা কিনা ভক্তি আন্দোলনে চৈতন্যদেবের অস্ত্র তা কী করে শক্তি আরাধানয় রামপ্রসাদের অস্ত্র হয়ে উঠল? কেন রামপ্রসাদ রচনা করলেন কালীকীর্তন?

১৫৩৩। অন্তর্হিত হয়েছেন চৈতন্য মহাপ্রভু। মুসলিম শাসিত বাংলায় অনেক চেষ্টা করেও বৈষ্ণবধর্মকে বেশিদিন টিঁকিয়ে রাখতে পারলেন না চৈতন্য অনুগামীরা। চৈতন্য অনুগামীদের গোষ্ঠীদ্বন্দে দিশাহীন বৈষ্ণব আন্দোলন।

১৬০০ খ্রীষ্টাব্দের আশাপাশ। জন্ম নিলেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। ইতিমধ্যেই বঙ্গীয় সমাজে জাঁকিয়ে বসেছে শক্তিসাধনা ও তান্ত্রিক আচারবিধি। কিন্তু তান্ত্রিকদের আচার আচারণে সাধারণ মানুষ ভয় পায়। অদ্ভুৎ তাঁদের কার্যকলাপ। কাছে ঘেঁষতে সাহস পান না সাধারণ মানুষ। এক দল সমাজপতি আবার এঁদের ওপর বিরক্ত। তন্ত্রের নামে বেড়ে উঠেছে ব্যাভিচার-অজারকতা।

এমত অবস্থায় শাক্তধর্মকে কার্যত উদ্ধার করে তা সাধারণের মাঝে নিয়ে এলেন কৃষ্ণানন্দ। কিন্তু তাঁর লিখিত শক্তিপুজোর জটিল ক্রিয়াবিধি গৃহী বোঝে না। তাহলে শক্তিপুজোর বিকাশ ঘটবে কী করে?

কাটল প্রায় আরও একশ বছর। ১৭২০ সালে জন্ম নিলেন রামপ্রসাদ। শাক্তধর্মালম্বী পিতার ছিল আয়ুর্বেদ ব্যবসা। ১৬ বছর বয়সে প্রগাঢ় পণ্ডিত রামপ্রসাদ সংস্কৃত, ফারসি সহ একাধিক ভাষায় বুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন।

পিতার মৃত্যুর পর তিনি চাকরি নিলেন গরানহাটার জমিদার দুর্গাচরণের কাছাড়িতে। হিসাবের খাতায় গান লেখা দেখে দুর্গাচরণ বুঝেছিলেন এঁকে দিয়ে আর যাই হোক হিসেব হবে না। জন্মস্থান কুমারহট্টতে ফিরলেন তিনি। মনোনিবেশ করলেন মাতৃ আরাধনায়।

ঈশ্বরপুরীর জন্মস্থান কুমারহট্ট ( অধুনা হালিশহর) বৈষ্ণবদের তীর্থক্ষেত্র। চৈতন্য সহযোগী শ্রীবাস ও চৈতন্য জীবনীকার বৃন্দাবন দাস কিছুদিন এই স্থানে ছিলেন। ফলতঃ কুমারহট্টতে বৈষ্ণব আবহ ছিলই, যা ছিল রামপ্রসাদের পরিচিত। সেখানেই শুরু হল মায়ের আরাধনা।

রামপ্রসাদ বুঝেছিলেন কালী সাধনার জন্য সহজ পথ দরকার। না হলে এ আরাধনা সহজে তৃণমূল স্তরে পৌঁছবে না। যে পথে কৃষ্ণভজন সে পথে কালীসাধন। বৈষ্ণব ধর্মের সহজিয়া সাধনা কী তবে আকৃষ্ট করেছিল তাঁকে?

সম্ভবত হ্যাঁ। কারণ রামপ্রসাদ বুঝিছিলেন জাতি নির্বিশেষে চৈতন্য যেমন সহজভাবে, সহজকথা বলে, সহজ আচারে মানুষকে টেনে আনতে পেরেছিলেন সেই সহজিয়া পথেই হতে পারে সিদ্ধিলাভ। তাই কীর্তনের আদলে রচিত হল কালীকীর্তন। কোনও তন্ত্র মন্ত্রের জটিল বিষয় নয়। সহজ ভাষা, সহজ কথা, সহজ যাপন। এ যেন সত্যই মা-ছেলের নিত্য দিনযাপন, নিত্য রাগ-অভিমান, নিত্য খুনসুঁটি। আর কেবল কালীকীর্তন তো নয় রচনা করলেন কৃষ্ণকীর্তনও। লিখলেন বিদ্যাসুন্দর। বৈষ্ণব প্রভাব না থাকলে এ কী সম্ভব?

ক্রমে ক্রমে জনপ্রিয় হতে লাগল সহজিয়া কালীকীর্তন। ভিক্ষুক থেকে জমিদার সকলেই মজলেন রামপ্রসাদীতে। স্বয়ং রাজা কৃষ্ণচন্দ্র পর্যন্ত মজলেন রামপ্রসাদে। কৃষ্ণচন্দ্র স্বয়ং ছিলেন ঘোর শাক্ত। তাঁর বদান্যতায় আরও বেশি ছড়াতে লাগল রামপ্রসাদের মাহাত্ম্য। কৃষ্ণচন্দ্র নাকি তাঁকে সভাকবি হিসাবে নিয়োগ করারও প্রস্তাব দিয়েছিলেন তাঁকে।

যে চাইছে মাকে বেড়া দিয়ে বাঁধতে দিতে তাঁকে রাজা বেড়া দিয়ে বাঁধবেন? তাও কী হয়?

রামপ্রসাদের মুগ্ধ কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে ১০০ একর নিস্কর জমি প্রদান করেছিলেন। ‘কবিরঞ্জন’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন তাঁকে। নিজের রচিত ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাব্য কৃষ্ণচন্দ্রকে উৎসর্গীকৃত করেন রামপ্রসাদ।

তবে কেবল কালীকীর্তনই নয় শাক্ত পদাবলী থেকে কৃষ্ণকীর্তন বা শিবকীর্তন তাঁর সমস্ত রচনাই ছিল সাধারণের সহজবোধ্য। জাহ্নবী কুমার চক্রবর্তী তাঁর ‘ভারতকোষ’ গ্রন্থে তাঁকেই প্রথম শাক্ত সংগীতের প্রথম পথিকৃত বলেছেন। এর আগে চন্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গল, দুর্গামঙ্গল সহ কিছু কাব্যে মাতৃআরাধনার উল্লেখ থাকলেও তা আলাদা করে কেবল গান হয়ে ওঠেনি। এত সর্বসাধরণের স্বকৃতীও পায়নি। রামপ্রসাদ পেয়েছিলেন কারণ তার ভাষার সহজতা।

প্রচলিত আছে বাগহাটির জঙ্গল দিয়ে ত্রিবেণীঘাটে ফেরার সময় তাঁকে বন্দী করেছিলো রঘু ডাকাত। মায়ের সামনে বলি দেওয়ার আগে যুপকাষ্ঠে বাঁধা রামপ্রসাদ রঘুর কাছে আর্জি জানান তিনি মরার আগে একটি গান শোনাতে চান। রঘু ডাকাত অনুমতি দিলে রামপ্রসাদ গান শুরু করেন। গান শুনে হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে মাতৃভক্ত রঘু আর এক মায়ের ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসেন।

সুলতানি আমল থেকে বর্গীদের অত্যাচার, সিরাজের পতন কোম্পানীর শাসন- দীর্ন-ক্লিষ্ট বিপন্ন বাংলা। রামপ্রসাদ দেখছেন একশ্রেণীর লোভী ক্ষমতালিপ্সু জমিদার-সুবেদারদেরকে। চোখের সামনে দরিদ্র অনাহার ক্লিষ্ট মানুষদের। আর ভক্তদের জন্য আকূল হয়ে গাইছেন-

"অন্ন দে গো অন্ন দে গো অন্ন দে গো অন্নদা"

"অন্ন দে গো অন্ন দে গো অন্ন দে গো অন্নদা।

জানি মায়ে দেয় ক্ষুধায় অন্ন অপরাধ করিলে পদে পদে।

মোক্ষ প্রসাদ দেও অম্বে এ সূতে অবিলম্বে। মা, জঠরের জ্বালা আর সহে না তারা।"

মানুষের জন্য এ যদি সাধন না হয় তবে সাধন কী?

এই সাধককে মানুষ বুকে রাখবে না তো আর কাকে রাখবে?

রামপ্রসাদেরকাব্য প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাঁরগান ইংরাজীতে অনুবাদ করেছিলেন ভগিনী নিবেদিতা। এ লেখা শেষ করি তাঁর এক উক্তি দিয়ে-

“No flattery could touch a nature so unapproachable in its simplicity. For in these writings we have perhaps alone in literature, the spectacle of a great poet, whose genius is spent in realizing the emotions of a child.Willam Blake, in our own poetry, strikes the note that is nearest his, and Blake is by no means his peer.

Robert Burns in his splendid indifference to rank, and Whitman in his glorification of common things, have points of kinship with him. But to such radiant white heart of child-likeness, it would be impossible to find a perfect counterpart.”

এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy