সেই কোন এক প্রাচীন কাল যখন মূর্তি ভাবনাটুকুও আসেনি, তখন থেকেই মানুষ প্রকৃতি-কে জেনেছে। মানুষ বুঝেছে, প্রকৃতিই তাকে বাঁচিয়ে রাখে। ফসল মাতৃদুগ্ধের মতো তাকে পুষ্টি দেয়, জলবায়ু তাকে আড়াল দেয়, স্নেহ দেয়। প্রকৃতিই তার মা।
দেবী দুর্গার আরেক নাম তাই শাকম্ভরী। দেবী মার্কণ্ডেয় পুরাণে নিজেই এ কথা বলছেন, যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, ‘‘ভরা বৃষ্টিতে আমার দেহ হতে শাক উৎপন্ন হবে, সেই শাক দ্বারা সমস্ত জীবকূল প্রাণ রক্ষা করবে। তাই আমি শাকম্ভরী।
এই দশভুজা মূর্তি কল্পনার আগে, মা দুর্গার পূজা হত সর্বতোমঙ্গলময়ী এক দেবী রূপে। তিনি আদ্যাশক্তি তাই তিনি সর্বাগ্রে। তাই তাঁকে প্রজনন ক্রিয়ার আদিরূপ ধরা হয়। দুর্গাপূজাও কিন্তু একটি জলপূর্ণ ঘট এবং যন্ত্রে মূল পূজাটি হয়। ওই যন্ত্র এবং ঘটকেই পূর্ণ দেবী অস্তিত্ব ধরা হয়।
দুর্গা পূজার এই যন্ত্রটির নাম ‘সর্বতোভদ্রমণ্ডল’। এই যন্ত্র অর্থাৎ আঁকাটি — একটি চৌখুপিতে অষ্ট দল পদ্ম ও তাকে ঘিরে লতানো বীথিকা অঙ্কন। একে লতাও বলা হয়। তন্ত্রোক্ত নাম — কল্প লতিকা।
এই পদ্ম বা অষ্ট দল পদ্ম হল নারী জননাঙ্গের প্রতীক। কারণ পদ্মের ভেতর শুক্রের মিলনে ফল বা সন্ততি হয়। আর এই পদ্মকে ঘিরে রয়েছে বীথিকা। বীথিকা অর্থ এখানে উর্বরতা। অর্থাৎ নারী অঙ্গের জননশক্তির স্পর্শে প্রকৃতিকে ফল ধারণে সক্ষম করা। এক আদি-অনন্ত জৈবিক চক্র। তাই, "স্ত্রীভগং পূজনাধারঃ" অর্থাৎ জন্মদ্বার সকল উপাসনার উৎস বা আধার। তাই, মাও উপাসনার আধার।
অষ্টদল-পদ্মটি আঁকা হয় আতপ চালের গুড়ো এবং ফুলের আবির ও বিবিধ রঙ দিয়ে। কেন্দ্রটিতে ধান, যব, তিল, সর্ষে, কলাই দিয়ে বেদি বানিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয় পুজোর ঘট। ঘটের উপর বসে পঞ্চপল্লব বা আম, কাঁঠাল অশ্বত্থ, বট, বকুল শাখা। তার উপর সরায় করে ধান বা চাল রেখে, স-শীষ ডাব বা নারকেল স্থাপন করে, সব শেষে গামছা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়।
ঘটের গায়ে তেল- সিঁদুর দিয়ে আঁকা থাকে পুত্তলিকা বা পুতুল। ঠিক যেন গর্ভে ধারণ করা ভ্রুণ। এই গোটাটাকেই দেবী দুর্গা রূপে কল্পনা করে পুজা প্রার্থনা করা হয়। তাহলে, বুঝতে পারছেন কী ভীষণ গভীর দর্শন!
আমাদের বর্তমান রূপে মা মহিষাসুরমর্দিনী কিন্তু তারও আগে মা আদ্যাশক্তি, দুর্গতিনাশিনী। সন্তানের জন্ম দেওয়া থেকে তাকে পালনের জন্য ফসলের জন্ম দেওয়া — সকল সৃষ্টির কারণ মা। মা'য়ের পূজা তাই সেই সত্যকে স্মরণ করে।
ঋণ: লোকায়ত দর্শন (দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়), বিবর্তনের পথে দুর্গা: শস্যদেবী থেকে দুর্গতিনাশিনী (উত্তম মণ্ডল), বঙ্গদেশ : তন্ত্র, তান্ত্রিক এবং সহজবাদ (দীপক গুহ রচনাসমগ্র - সংকলক অতনু দাশগুপ্ত), সর্বতোভদ্রমণ্ডল (স্বামী ঞ্জানব্রতানন্দ, উদ্বোধন রচনাবলী - পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়)
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy