ভরদুপুরে হনহন করে উঠোন দিয়ে হেঁটে আসছেন এক রমণী। ব্যাপার কী? দাওয়ার নীচে দাঁড়িয়ে সেই রমণী তাঁর ঘর্মাক্ত, ক্লান্ত মুখটি কাপড় দিয়ে মুছে একটু জল চান। বাড়ির গিন্নিমা এক ঘটি জল গড়িয়ে দেন। কিন্তু তিনি সেই জল পান করেন না। বলেন, দেবতার সামনে পুজোর জন্য ওই যে কলসিতে গঙ্গাজল রাখা আছে, ওই জল দাও। অগত্যা তাই দেন বাড়ির লোক।
জল পান করে তৃপ্ত হয়ে সেই রমণী বলেন, “আমি আসি মা। তোমাদের উঠোনের বাইরে আমার ছেলে-মেয়েরা অপেক্ষা করছে। অনেক দূরের পথ যেতে হবে।” এই বলে যেমন এসেছিলেন, তেমন হনহন করে বেরিয়ে যান।
সম্বিত ফেরে বাড়ির গিন্নিমার। হাঁউমাউ করে ওঠেন বউ-ঝিদের ওপর। এই ভীষণ ভাদ্রের গরমে ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলো বাইরে দাঁড়িয়ে আছে? শিগগির যা, একটু জল-বাতাসা দিয়ে আয়।
জল আর বাতাসা নিয়ে বাইরে যাওয়া হয় তক্ষুনি। কিন্তু কোথায় কী? ডাইনে-বাঁয়ে গ্রামের পথ ধু ধু ফাঁকা। আশ্চর্য হয়ে গিন্নিমা ভাবেন, এত তাড়াতাড়ি তারা চলে গেল! কী ভাবে সম্ভব?
সেই দুপুরেই ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলেন তিনি; দেবী এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁর উঠোনে। বলছেন, তোর ঘরে আমি এলুম, আর তুই আমায় চিনতে পারলি না।
স্বপ্ন ভেঙে যায় গিন্নিমার। ধড়মড়িয়ে উঠে গলায় কাপড় দিয়ে দেবীর কাছে আকুল হয়ে কেঁদে বলেন, “মা, তুমি এসেছিলে আমি বুঝতে পারিনি। এ আমারই ভুল। কী করে প্রায়শ্চিত্ত করব বল? দেবী বলেন, আমার পুজো কর। আবার তোরা আগের অবস্থা ফিরে পাবি।”
আবার আকুল হয়ে বলেন গিন্নিমা, “তুমি তো সবই জানো দেবী। এই ভাদ্রের শেষ, পুজোর আর ক’দিন মাত্র বাকি। এর মধ্যে কী ভাবে আমরা তোমার মূর্তি গড়ব আর পুজো করব? আমাদের সে সামর্থ্য যে নেই।
আশ্বস্ত করলেন দেবী, “নিজের সামর্থেই পুজো কর। কিন্তু সবটুকু দিয়ে পুজো কর। কুলোর উপরে আমার রূপ এঁকে তাকেই পুজো কর। আমি তাতেই আমি তুষ্ট হব।”
সেই বছর কুলোর উপর দেবী দুর্গার রূপ এঁকে দুর্গাপুজো করা হলো। নাম দেওয়া হলো কুলোপতিদুর্গা। এ ভাবেই আনুমানিক ৫০০ বছর আগে বাদশাহ শাহজাহানের আমলে পরম বৈষ্ণব রায় বাড়িতে শুরু হল দুর্গাপুজো।
শান্তিপুরের বাগআঁচড়া গ্রামের এই রায় পরিবারের আগে বাস ছিল গৌড়বঙ্গে। সেখান থেকে নানা বাধা-বিপত্তিতে বিবিধ স্থান পরিবর্তন করতে করতে তাঁরা এসে পৌঁছেছিলেন শান্তিপুরের বাগআঁচড়া গ্রাম। এ এমন একটি গ্রাম, যেখানে পরম বৈষ্ণব অংশে শক্তিপুজো হতো নিয়মিত। বাগআঁচড়া নামটিই বাগদেবীর প্রাচীন পাট থেকে আসে। তন্ত্রোক্ত মতে এই বাগদেবীর পুজো করতেন বারো ভুঁইঞার অন্যতম চাঁদ রায়ের কুলোপুরোহিত।
এ দিকে, দেবীর পুজো শুরু হতে আস্তে আস্তে রায় বাড়ির অবস্থা ফিরতে থাকে। এবং কয়েক বছরের মধ্যে তাঁদের অবস্থার বেশ উন্নতি হয়। মুর্তি গড়ে দেবীর পুজো শুরু করেন তাঁরা। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে মন্দির ও আটচালা।
তবে এ বাড়িতে দেবী মহিষাসুরমর্দিনী একাই পুজো পান। যেহেতু ছেলে-মেয়ে, অর্থাৎ লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক ও গণেশের দেখা পাওয়া যায়নি, তাই মায়ের সঙ্গে তাঁদের পুজো হয় না। দেবী এখানে পূজিতা কুলোমাতা নামে। আজও দুর্গাপুজোয় মানুষের ঢল নামে। দেবীর কাছে মানসিক করলে তিনি নাকি খালি হাতে ফেরান না কাউকে।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।