পুরাণ অনুযায়ী মানুষের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর উপর তিন প্রকার ঋণ বর্তায়। সেগুলি হল পিতৃঋণ, দেবঋণ এবং ঋষিঋণ। তাঁর মধ্যে সবার উপরে হল পিতৃঋণ। এই পিতৃঋণ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তর্পণ করা অত্যন্ত জরুরি। শাস্ত্রের আঙিনায় পুত্রসন্তানেরা বহুদিন ধরে তর্পণের দায়িত্ব পালন করে আসছে। কিন্তু আদতে শাস্ত্রে নারীদের তর্পণ করার বিরুদ্ধে সরাসরি কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই।
প্রাচীন গরুড় পুরাণেই বর্ণিত আছে, পবিত্র মন দিয়ে যদি কোনও নারী তর্পণ করে, তা হলে সে পিতৃঋণের পরিপূর্ণ ফল পায়। অর্থাৎ নারীরাও এই কাজ করতে পারে, পুত্রসন্তানের অভাব থাকলে। পুত্রসন্তানের অস্তিত্ব না থাকলে কন্যাসন্তান তো বটেই, এমনকি পুত্রবধূরাও এই ধর্মীয় দায়িত্ব নিতে পারেন। অবং অবিবাহিত ভাই-বোনের সম্পর্কেও তর্পণ করা যায়। তর্পণের মূল উদ্দেশ্য পূর্বপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো। তাই মৃত ব্যক্তির যে কোনও নিকটাত্মীয়এই পবিত্র কাজ করতে পারেন। শুধু শাস্ত্রের বিধি নয়, বরং ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতাও বলে, তর্পণের মূল লক্ষ্য হল আত্মার শান্তি ও আশীর্বাদ লাভ করা।
নারীরা কি তর্পণ করতে পারে? শাস্ত্র কী বলছে?
এই বিষয় আনন্দবাজার ডট কমের কাছে আরও স্পষ্ট করে কিছু মত প্রকাশ করেছেন শিক্ষিকা ও লেখক রোহিণী ধর্মপাল। তাঁর কথায়, “আমি শাস্ত্রবিদ নই। আমি মানুষ, আমি যাবতীয় যা কাজ করি, ভাবি, তা মানুষ হিসেবে। এ বার বিভিন্ন শাস্ত্রের বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যাও তো আলাদা আলাদা হয়। যদি কোথাও কখনও কয়েক হাজার বছর আগে বলাও থাকে যে তর্পণের অধিকার মেয়েদের নেই, আমরা এখন দাঁড়িয়ে সেটা মানব কেন আদৌ? আর তর্পণ হচ্ছে মা-বাবা এবং পূর্বপুরুষদের স্মরণ করা। সেই স্মরণ করার অর্থ আমাদের যে মাতৃঋণ বা পিতৃঋণ থাকে, সন্তান মাত্রেই তার উপরে বর্তায়। এটা অন্তত শাস্ত্রে বলা আছে। আমাদের কতগুলি ঋণ থাকে? ঋষি ঋণ, আচার্য্য ঋণ, মাতৃঋণ– এগুলো প্রত্যেকের জন্যেই। তার দায়িত্ব এসে পড়ে। এই কথা যদি বলা হয়ে থাকে, তা হলে তর্পণ করার অধিকার কেন নারীর থাকবে না? আর তর্পণ করা বলতে আমরা সবাই জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে নানারকম মন্ত্র পড়ি। যে কোনও পুজো, যে কোনও মনের ভাব প্রকাশ করতে তোমার মনের যে কথা, সেটাই মন্ত্র। আর তুমি যদি মা-বাবাকে মনে করে চোখের জল ফেল, তার থেকে বড় তর্পণ আর কিছুতে নেই। বেশ ধীরে ধীরে সব স্মৃতিশাস্ত্রগুলি এল, সঙ্গে এল নানা রকম নিয়ম কানুন। যত দিন যেতে লাগল, এই পিতৃতান্ত্রিক নিয়মগুলি আরও মজবুত হতে লাগল। যাতে মানুষকে কোনও ধর্মীয় কাজ করতে ব্রাহ্মণদের কাছে আসতেই হয়। এখানে বিবাহিত বা অবিবাহিতের কোনও ব্যাপার নেই।”
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।