শারদোৎসবের নায়িকা চরিত্র যদি হন দেবী দুর্গা, তা হলে অশুভ শক্তি যাঁকে দেবী বধ করেছেন তিনি হলেন মহিষাসুর। বাঙালিদের মধ্যে এই উৎসব পালিত হয় অশুভের প্রতীক মহিষাসুরের বিনাশকে উদ্যাপন করতে। পুরাণ অনুসার, এক প্রবল যুদ্ধের পর তিনি পরাজিত হয়েছিলেন দশভুজা দেবী দুর্গার হাতে। এই উৎসব পালনের সময় সারা বাংলা, এবং বিশ্বের যেখানে যেখানে বাঙালিরা রয়েছেন, সেই সমস্ত স্থানের মানুষজন আনন্দে মেতে ওঠেন। এ ক্ষেত্রে এক অনন্য ব্যতিক্রম হল পুরুলিয়ার ফলাওরা গ্রাম। সেখানে শারদীয়ার সময় কোনও আনন্দোৎসব নয়, পালিত হয় শোক! এই গ্রামের খেরওয়াল সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ শারদোৎসবের সময় দুর্গাপুজো করেন না। বদলে তাঁরা হুদুর দুর্গা পালন করেন।
কে বা কারা এই হুদুর দুর্গা?
এই সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষরা বিশ্বাস করে, হুদুর ছিলেন তাঁদের পূর্বপুরুষ এবং এক পরাক্রমী রাজা। হিন্দু পুরাণে যাঁকে মহিষাসুর বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনিই আসলে হুদুর বলে মানেন খেরওয়ালরা। যাঁকে 'উচ্চ বর্ণের নারী' দুর্গা ছলনা করে হত্যা করেছিলেন! সেই 'ঘটনা' উপলক্ষেই পালিত হয় হুদুর দুর্গা প্রথা।
প্রেক্ষাপট ও প্রচলিত কাহিনি:
খেরওয়ালদের বিশ্বাস, তাঁদের পূর্বপুরুষরাই হলেন সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর প্রকৃত পূর্বসূরি। তাঁরা বসবাস করতেন চাইচম্পা নামে একটি সমৃদ্ধ জনপদে। সেই জনপদে সকলেই আনন্দে দিনযাপন করতেন। কিন্তু, আর্যদের নজর ছিল সেই ভূখণ্ডে। আর্যরা সেই জনপদ দখল করতে চাইলেও খেরওয়ালদের রাজা হুদুর প্রবল পরাক্রমে বারাবার আর্যদের ব্যর্থ করছিলেন।
কথিত আছে, এমতাবস্থায় হুদুরের বিরুদ্ধে আর্যরা ষড়যন্ত্র করেন। তাঁরা জানতেন, খেরওয়াল সম্প্রদায় কখনও নারীর উপর আক্রমণ করে না। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েই হুদুরের সঙ্গে এক আর্যকন্যার বিবাহ দেওয়া হয়। এবং পরবর্তীতে নববিবাহিতা সেই কন্যাই তাঁর স্বামী হুদুর বা মহিষাসুরকে ছলনা করে বধ করেন। এই কারণেই শারদোৎসব খেরওয়াল সাঁওতালদের কাছে আনন্দের নয়, দুঃখের সময়। কারণ, রাজা হুদুর নিহত হওয়ার পরই আর্যরা তাঁদের ভূমি ও সম্পত্তি অন্যায় ভাবে দখল করেন এবং খেরওয়ালরা তাঁদের ভিটেমাটি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন।
বহু প্রাচীন এই প্রচলিত কাহিনি অনুসারেই হুদুর দুর্গা পালন করেন খেরওয়াল সাঁওতালরা। যা কোনও উৎসব নয়, বরং একে 'শহিদের স্মৃতিচারণ' বলা যায়।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।