প্রেজেন্টস্
Knowledge Partner
Fashion Partner
Wedding Partner
Banking Partner
Comfort Partner

আমি ‘বিধবা’! তবু দশমীর দিন আমি সিঁদুর খেলব আমার মেয়ের সঙ্গে

আমার স্বামীর মৃত্যুর পর, আমার সঙ্গে এক নতুন নাম যোগ হয়েছে। এক ধরনের চিহ্নিতকরণ। এখন আমি ‘বিধবা’। তবু আমি সিঁদুর খেলব!

 স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০২৩ ১৭:১২

পাড়াটা কেমন অর্ধেক আলোয় ভরে গিয়েছে। প্যান্ডেলের সামনে আলো। বাকি অন্ধকার। অফিস ফেরত এই ছাতিম ছড়ানো রাত আর মনে ধরছে না আমার। বাড়ির দোরগোড়ায় যদি দুর্গা পুজো হয়, তা হলে তা ‘বাড়ির পুজো’ হয়ে যায়। এমনটাই তো...

মণ্ডপে আলপনা দেওয়া, অনুষ্ঠানের তালিকা তৈরি করা। দুর্গা আর তার ছেলেমেয়েদের শাড়ি পরানো। অবশ্য শুধুই শাড়ি। অস্ত্র ছেলেরা পরায়। অস্ত্র যেন মেয়েদের বিষয় নয়। আর গয়নাই যেন মেয়েরা পরাবে। পিতৃতন্ত্র তো এ ভাবেই মেয়েদের অবস্থান নির্মাণ করে আসছে। মেয়েরাও গদগদ।

এ আর নতুন কী!

সে যাই হোক। মোদ্দা কথা, আর পাঁচ জনের মতোই এমন ভাবেই দুর্গা পুজোকে জীবনে সাজিয়ে নিয়েছিলাম আমি। পুজোর শুরুর দিনগুলোয় রোজ স্নান সেরে পুজোর জোগাড়। ফল কাটা থেকে আরতির সলতে পাকানো। তেলের পরিমাণ...ধুনুচিতে আগুন প্রস্তুত করা। সন্ধি পুজোর পদ্ম ফোটানো। গত দশ বছর ধরে তো এ ভাবেই...

এ বার আগুন আর সন্ধিপুজোর পদ্মফুলের মাঝে আটকা পড়ল জীবন। আগুন শোকের। আর পদ্মফুল জীবনের।

কোনটা বেছে নেব?

অফিস ফেরত দেখি রোজ পাড়ায় জটলা। চাঁদার হিসেব। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে হইচই। এই তো শুরু হল।

আমি? এ বছর আমি?

আমার তো মৃত্যু হয়নি। কিন্তু এই জীবন্ত ‘আমি’র অনেক কিছুই শেষ হয়ে গিয়েছে!

এই দুর্গা পুজোয় অনেক ‘না’ এক সঙ্গে আমার সামনে জড়ো হয়েছে। আমাকে নিষেধ করছে। আমার আচরণ নির্দিষ্ট করতে চাইছে। আমার জীবনের অভিমুখ ক্রমশ বদলাচ্ছে। আমার স্বামীর মৃত্যুর পর, আমার সঙ্গে এক নতুন নাম যোগ হয়েছে। এক ধরনের চিহ্নিতকরণ। এখন আমি ‘বিধবা’। মন থেকে যদিও আলাদা কিছু মনে হয় না আমার। কিন্তু ‘বিধবা’। শব্দটার যে এত ভার দুর্গা পুজো না এলে ঠিক বুঝতাম না। দুর্গা পুজোই আমায় আঙুল তুলে জানান দিল আমি ‘বিধবা’। ফলে জারি হল নীরব নিষেধাজ্ঞা।

খানিক ভেবে যা বুঝলাম, সংস্কৃতে ‘ধব’ শব্দের অর্থ তো পুরুষ, স্বামী, পতি, নাথ। অর্থাৎ যিনি 'ধব' হীন তিনি ‘বিধবা’। অনাথবৎ, পতিহীন। তা হলে পুরুষ, বন্ধু, নাথহীন যে কোনও মানুষই তো ‘বিধবা’? তবে শুধু নারীই নয়, পুরুষের জন্যও নাথহীনতার পরিসর তৈরি হবে। সে’ও তা হলে ‘বিধবা’। না, তা হয়নি। বিষয়টা এতও সহজ নয়।

প্রাক বৈদিক যুগে ‘বিয়ে’ বিষয়কে ‘পবিত্র’ হিসেবে দেখা হত। ফলে তখন বিধবা নারীদের পুনর্বিবাহের প্রচলন ছিল। কিন্তু মনু যখন সামাজিক নিয়মের খোলনোলচা বদলে দিলেন তখন এবং তার পরবর্তী লোকাচারে বলা হল, স্বামী পরিত্যক্তার ক্ষেত্রে এই ‘বিধবা’ শব্দ প্রযোজ্য নয়। স্বামী মৃত হলেই নারীকে ‘বিধবা’ বলা হবে। এই শব্দের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল অহেতুক কঠোর আচার-বিধি। যা বারে বারেই সেই নারীর শরীরে সাদা থান হয়ে জড়িয়ে, জাপটে তার পথ রুদ্ধ করবে। এটাই তো নিয়ম। এক বেলা খাওয়া। নিরামিষ খাওয়া। পোশাক, একটাই সাদা থান... ইত্যাদি।

এ তো গেল শব্দ বিন্যাসের নিরিখে অবস্থানগত বিভাজন।

লিখতে গিয়ে দেখছি, যে সময়ের কথা আগেই উল্লেখ করেছি, সেই সময়ে বিধবাদের বেঁচে থাকারই অধিকার ছিল না। সহমরণের মহান সব গল্প ছড়িয়ে আছে সেই সময় জুড়ে। স্বামীর চিতার আগুনে পুড়িয়ে মেয়ের স্ত্রী ধন কেড়ে নেওয়ার এমন সহজ উপায় এর চেয়ে ভাল কী বা হতে পারত? নগ্নতার পথও ছিল প্রশস্ত। এক সময়ে বিধবাকে মৃত স্বামীকে স্নান করিয়ে সেই জল খেয়ে পুণ্য অর্জন করতেও হয়েছে। এমন ভয়াবহতা এ সমাজের পরিণাম।

দিন বদলায়। সঙ্গে নিয়ম। সেখানেও রামমোহনের পক্ষপাত, বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহ প্রথার প্রবর্তন হল।

কিন্তু এখন? শরতের মিঠে রোদ চোখে মাখতেই ‘বিধবা’ শব্দটা প্রথম মাথায় এল আমার। এত কাল ধরে দুর্গাপুজোয় যা যা করেছি সব তা হলে বারণ!

এই বারণ দিয়ে তো আর দিন চলে না। মানুষ বলতে পারে না। বলতে চায় না। গুমরে মরে।

রোজ বাড়ি ফিরে নিজে মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকা আমার বর্ষীয়ান দিদিশাশুড়িকে বলি তাঁর নাতি বেঁচে আছে। দীর্ঘ দিন তিনি হাসপাতালে। উনিও ভাবেন আমি আমার মৃত স্বামীকে রোজ দেখতে যাই। তাই ফিরতে রাত হয়। মিথ্যে বলে স্বামীকে বাঁচিয়ে রাখছি ওঁকে বাচিয়ে রাখব বলে। আর অন্য দিকে নিজের স্ত্রী সত্তাকে মরতে দেখছি। দম বন্ধ হয়ে আসে...

দুর্গাপুজোয় আগে কখনও কলকাতা ছাড়িনি। অঞ্জলি দেওয়ার জেদ না থাকলেও পুজোর আনন্দ মন প্রাণ দিয়ে উপভোগ করেছি। আমার কাছে দুর্গা পুজো ধর্মাচরণ নয়, বরং সংস্কৃতি। সেই সংস্কৃতিতে নতুন শারদ সংখ্যার গন্ধের অপেক্ষা আছে। পোশাকের, শাড়ির বড় জায়গা আছে। সাদা আর লালের ছোঁয়ার হাতে বোনা সুতির শাড়ি আমার চাই-ই চাই। কম দামে আজও পাওয়া যায় সেই সব শাড়ি। কিন্তু এ বার? বা পরবর্তীকালে? কেউ বারণ করেনি আমায়। তবু শাড়ি কিনতে গিয়ে, লাল রং দেখে আটকে যাচ্ছি। এ যে শুধু রঙের খেলা নয়। শরীর আর মুখ দর্শনেরও খেলা যে।

নিজে কাজ করি। বাঁচতে চাই। এর মধ্যে ঢুকে পড়ল ‘বিধবা’ শব্দ। জীবনে আর ঠাকুর বরণ করতে পারব না। পুরোহিতের বিধান, নিত্য পুজো যদি ইচ্ছা থাকে চলবে। বাড়িতে। বাইরে পা নয়।

সেই কোন ভোরে ঘুম ভাঙতেই গঙ্গায় কলা বউ স্নান? এখন যেহেতু আমার গায়ে বউয়ের তকমা নেই তাই ‘কলা বউ’ থেকে অন্য যে কোনও বউ বরণে আর জায়গা থাকল না আমার। আমি ‘অশুভ’ নাকি। চন্দ্রযানের মতো আজ এই সাদা-রংহীন-অশুভ সব কোথাও মিশে যাচ্ছে। মিশে আছে। ‘শুভ’ কাজে ‘অশুভ’কে দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়। খুব জোর সে উলু দিতে পারে বা শাঁখ বাজানোর কাজ করতে পারে। ওই অবধি।

এ কালের দুর্গাপুজো নামক ‘কার্নিভাল’য়ে আমার পাশের বাড়ির মেয়ে থেকে খ্যাতনামী, সকলেই দুর্গা। ঘরের দুর্গা। মঞ্চে দুর্গা। ছবিতে দুর্গা। দুগ্গা দুগ্গা। ভালই তো। পুজোর মধ্যে মিশে যাওয়া। ভাল ভেবে যদি এখন দুর্গা সাজার ইচ্ছে আমার ওপর ভর করে তো সেটাও বাতিল। দুর্গার বর আছে। সে বিবাহিত। তবেই না তার এত শক্তি। মাথা ভর্তি সিঁদুর পরিয়ে 'শুভ' সিঁদুর ঢেলে আমরা তার পুজো করি। বিধবার তো সিঁদুরই নেই! তার কাছে শক্তিও নেই। সে দুর্গাও নয়।

তা হলে পুরুলিয়ার সাবিত্রী শবর স্বামী ছাড়াই নিজের সম্প্রদায়ের নিয়ম অমান্য করে স্বামী মৃত্যুর পরের দিন কেমন করে হায়দরাবাদে নিজের হাতে তৈরি ঘর সাজানোর জিনিস নিয়ে প্রদর্শনীতে পৌঁছে গিয়েছিল? বলেছিল আমায়, ‘‘হাঁড়িতে তখন ভাত অবধি নেই। বর মরেছে বলে নিয়ম মেনে ঘরে বসে থাকব? নাকি ছেলে-মেয়ের খাওয়ার কথা ভাবব?’’ লেখাপড়া না করা সাবিত্রীর শক্তি তো কোথাও কম পড়েনি!

কিছুই কম পড়ে না। মন যদি তৈরি থাকে। মেদিনীপুরের লতা যেমন স্বামীর মৃত্যুর পরে ছ' বছরের মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসে। বিধবার কোনও নিয়ম সে মানেনি। বলেছিল, ‘‘ও সব তো পুরনো লোকেদের কথা। আমি কাজ করব। পয়সা করব। বাড়ি করে নিজের মর্জিতে থাকব। যিনি চালাচ্ছেন তিনি চালিয়ে নেবেন।’’ লতা মেয়েকে নিয়ে একা থাকে। প্রাইমারি স্কুলে পড়ায়। সন্ধে হলে মেয়েদের সমস্যা, অল্প বয়সে বিয়ে না করার পরামর্শ দেন।

স্বামীর পরিচয়ে মেয়েদের অস্তিত্ব তৈরি হয় না। আকস্মিক সে চলে গিয়েছিল। পরের দিন যে সকালে তার বাড়ি ফেরার কথা। সে সকালে আমি ‘বিধবা’ হয়েছিলাম। ওই মৃত্যু দিনে আমার শাড়ি পরে থাকা নিয়ে সমালোচনা। আড় চোখে আমার চোখ থেকে জল না পড়ার কারণকে ‘আনন্দ’ হিসেবে কুৎসা ছড়ানো সমাজ আমায় আরও শক্তি দিয়ে যাচ্ছে। আমি বারো বছরের মেয়েকে নিয়ে দিন কাটাচ্ছি। ওর পুজোর জামা হয়েছে। ও ‘পূজারিনী’ রবীন্দ্রনাথের কবিতার নাট্যরূপে অংশ নিচ্ছে। আমরা অন্ধকারে একসঙ্গে, আলাদা অসহায়ের মতো কাঁদছি। ও জানে কাঁদলে মন হালকা হয়। কাঁদছে। বাবাকে চাইছে। তছনছ হয়ে গিয়েছে আমাদের জীবন।

তবুও ওর নরম হাত ধরে সব কাজ ফেলে মণ্ডপে যাব। ঠাকুর দেখব। দু'জনে সিঁদুর খেলব। নিয়ম নয়। খেলা। পরস্পরকে ভালবাসব।

২০২৩...

অন্যের বিশ্বাসে আঘাত দিতে নেই। তাই বলে নিজের বিশ্বাসকে তো হারতে দেব না।

এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।

Durga Puja 2023 Sidur Khela
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy