Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
West Bengal Assembly Election 2021

Bengal Polls: নিজেরা মাঠে না নেমে অন্যদের খেলার সুযোগ দিয়ে জেতার কথা ভাবব, এটা হতে পারে না

আমাদের সংলাপ না থাকার কারণে সেলিব্রিটি ও ক্ষমতার কারবারিরা হয়ে উঠেছে গণতন্ত্রের ব্যাখ্যাকার। এই ছবি পাল্টাতে হলে আমাদের সক্রিয় হতে হবে।

নিছক দর্শক হয়ে বসে থাকলে চলবে না।

নিছক দর্শক হয়ে বসে থাকলে চলবে না।

সুমন কল্যাণ মৌলিক
সুমন কল্যাণ মৌলিক
শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০২১ ১০:৩৪
Share: Save:

খেলা হচ্ছে এবং হবে। যুযুধান পক্ষগুলির রণহুংকারে উত্তপ্ত বাংলার আকাশ-বাতাস। টুম্পা সোনা ও পিসি যাওয়ের আবহে সকাল-বিকাল দলবদলুদের সহাস্য মুখ, টলিপাড়ার তারকাদের দেশ সেবার মিষ্টি প্রতিশ্রুতি, মাননীয় নেতৃবৃন্দের অশ্লীল বাক্যচয়ন ও মাটিতে চাঁদ পেড়ে আনার স্বপ্ন ফেরি—খেলার মাঠ জমজমাট। আর যাদের ভালর জন্য এই রাজসূয় যজ্ঞ, অর্থাৎ আমরা দর্শকাসনে স্থির। সব কিছু নীরবে মেনে নেওয়া, সন্ধ্যাবেলায় বোকাবাক্সে সু-বচন শোনা আর ভোটের দিন সকাল সকাল আঙুলে কালি লাগিয়ে গণতান্ত্রিক কর্তব্য সম্পাদন, ব্যাস এ ভাবেই গল্প শেষ। গণতন্ত্রের এই কঙ্কালসার চেহারার জন্য হা-হুতাশ আর নন্দিত নেতৃবৃন্দকে গালমন্দ ছাড়া আমরা আর কিছুই করতে পারতাম না? অন্তত নিজেদের কথা, আমাদের চাওয়া-পাওয়া, সমস্যার বারোমাস্যাকে বিকল্প স্বর হিসাবে উপস্থিত করতে পারতাম না ক্ষমতার কারবারিদের কাছে, বা নিদেন পক্ষে আমাদের স্বপ্ন মাখা একটা দাবি সনদ!

এই তো কয়েক মাস আগে দেশের রাজপথে, রেলপথে প্রত্যক্ষ করেছিলাম অপরিকল্পিত লকডাউনের কারণে লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষের বাড়ির পথে দীর্ঘ পদযাত্রা, নাম না জানা লাশ। ফেসবুকে, গণমাধ্যমে কত সহানুভূতি, কত শপথ, অথচ আজ সেই পরিযায়ী শ্রমিকরা খেলার মাঠের কোথাও নেই। সেই বৃহত্তম মানবিক বিপর্যয়ে গ্রাম ভারতকে কিছুটা হলেও রক্ষা করেছিল একশো দিনের রোজগার যোজনা প্রকল্ল এবং গণবণ্টন ব্যবস্থায় বিলি করা বিনামূল্যে চাল গম। আমরা তো দাবি তুলতে পারতাম, অবিলম্বে গ্রামীণ ভারতে একশো নয় অন্তত দুশো দিনের কাজ সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে এবং রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্পকে শহরাঞ্চলেও সম্প্রসারিত করতে হবে, যাতে শহরাঞ্চলের কর্মপ্রার্থী মানুষ কাজ পান। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে হবে কেন্দ্রীয় বাজেটে (২০২১-২২) মাত্র ৭৩,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা, যা গত বছরে প্রকৃত বরাদ্দের চেয়ে এক তৃতীয়াংশ কম জনকল্যাণমূলক সিদ্ধান্ত নয়। ফুড কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়াকে দুর্বল করে খাদ্য শস্য কেনাবেচার দায়দায়িত্ব বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে আম জনতার খাদ্য নিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি নির্বাচনের আগে যুযুধান পক্ষগুলি কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতির প্রশ্নে কল্পতরু হয়ে ওঠেন (২ লক্ষ থেকে ২ কোটি স্বাভাবিক লিমিট)। চাকরির প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্ভেজাল মিথ্যাচার সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছে। যে দেশে বর্তমানে কর্মক্ষম মানুষের ৫০ শতাংশ বেকার, সেখানে আমাদের চাইতেই হবে সুসংহত কর্মসংস্থানের নীতির কথা। কর্পোরেটদের নানারকম কর ছাড় এবং জলের দরে রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদের মালিকানা তুলে দিলে তারা পুঁজি বিনিয়োগ করবে, নতুন নতুন কল-কারখানা তৈরি করবে, বেকার যুবকরা দলে দলে চাকরি পাবে— কর্মসংস্থানের এই ঘোষিত মডেল গত তিরিশ বছরে চাকরি তৈরি করল, না কি নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ আরও শেষ করে দিল, এই আলোচনা নির্বাচনের প্রচারে আমরা চাইবো না?

আমাদের নিরুদ্বেগ জীবনযাপন, স্বার্থান্ধ মানসিকতার জন্য সহনাগরিকদের বিপন্নতা আজ আর আমাদের স্পর্শ করে না। তাই স্বচ্ছ ভারত ও নির্মল বাংলার এই ভরা বসন্তে চারজন সহনাগরিকের ম্যানহোলে তলিয়ে যাওয়া নির্বাচনে ইস্যু হয় না, যেমন হয় না ঠিকা শ্রমিকদের অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্ট বা উত্তরবঙ্গে চা-বাগানের শ্রমিকদের চলমান ধ্বংসগাথা। পাঁজিপুঁথি দেখে বাৎসরিক শিল্প ধর্মঘট ডেকে আমরা আমাদের ইতিকর্তব্য শেষ করি আর দিল্লির তখত থেকে উচ্চারিত হয় রেল, ব্যাঙ্ক, বিমা-সহ সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের ধ্বংসের শংসাপত্র। সমস্ত নেতার মুখে শিল্প আনার প্রতিশ্রুতি কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মতো একদা শিল্প সমৃদ্ধ রাজ্যের পঞ্চাশ হাজারের বেশি কারখানা বন্ধ কেন, সেখানকার শ্রমিকদের পাওনাগন্ডা না পাওয়া, শিল্পতালুকগুলির বন্ধ দশার কারণ, সমাধানের রাস্তা নিয়ে আলোচনা কোন নির্বাচনী প্রচারের বিষয় হয়ে ওঠে না।

লকডাউনে শ্রমজীবী মানুষের বাড়ির পথে পদযাত্রা।

লকডাউনে শ্রমজীবী মানুষের বাড়ির পথে পদযাত্রা।

কোভিড অতিমারী আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে, তথাকথিত উন্নত নগর সভ্যতার ভঙ্গুর অবস্থা। এই নির্বাচনে তাই পরিবেশ হয়ে উঠতে পারত একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আসানসোল খনি অঞ্চলের ধস, আগুন, মালদা-মুর্শিদাবাদে গঙ্গার ভাঙন, প্রমোটারদের দাপটে জলাভূমি ভরাট নিয়ে আমরা যদি সরব হতাম, তা হলে আলোচনায় উঠে আসতে পারত ‘পরিবেশের উপর প্রভাব খতিয়ে দেখার আইন( ইআইএ) খসড়া বিজ্ঞপ্তি ২০২০’ যা আদতে পরিবেশের প্রশ্নটিকেই তামাদি করতে চায়। আমাদের মধ্যে থেকে প্রশ্ন তোলা যেতে পারত, কেন কলকাতায় পরিবেশবান্ধব সাইকেল চালানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে? কথা হতে পারত স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা নিয়ে। অতিমারী একটা সার সত্য বুঝিয়েছে। সরকারি হাসপাতাল ছাড়া আম আদমির গতি নাই, আর বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা অপ্রতুলতো তো বটেই, তার খরচের প্রশ্নটা ভীষণ রকম অস্বচ্ছ। চিকিৎসা নাগরিকের অধিকার তেমনি রাষ্ট্রের দায়। সেই অধিকারকে বিমার শৃঙ্খলে বেঁধে ফেললে শেষ বিচারে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব না তো?

আসলে ‘ছি ছি এত্তা জঞ্জাল’ বলে আমরা রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছি, আর সেই সুযোগে রাজনৈতিক দল তাদের মত করে খেলার নিয়ম ঠিক করছে। আমাদের সংলাপ না থাকার কারণে সেলিব্রিটি ও ক্ষমতার কারবারিরা হয়ে উঠেছে গণতন্ত্রের ব্যাখ্যাকার। এই ছবিটা পাল্টাতে হলে আমাদের সক্রিয় হতে হবে, নিজেদের দাবি, স্বপ্ন, অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে নিছক দর্শক হয়ে বসে থাকলে চলবে না। খেলার মাঠ আমাদের ডাকছে।

(লেখক স্কুল শিক্ষক এবং লিটল ম্যাগাজিন কর্মী, মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE