America’s fear for growing influence of New Delhi had caused for India US row, say experts dgtl
India vs US
অর্থনীতি, মহাকাশ গবেষণা থেকে প্রতিরক্ষা! ভারতের শক্তি বৃদ্ধি পেতেই কি শুল্কবাণে ঘায়েল করতে চাইছে 'ভিতু' আমেরিকা?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘কৌশলগত অংশীদারি’ থাকা সত্ত্বেও কেন বার বার ভারতকে নিশানা করছেন সেখানকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প? এর নেপথ্যে একাধিক কারণের কথা বলেছেন বিশ্লেষকেরা।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০২৫ ১৩:৫৯
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
‘কৌশলগত অংশীদারি’র নামে গলায় গলায় বন্ধুত্ব! যা দেখে ধুরন্ধর কূটনীতিকদের অনেকেই বলতে শুরু করেছিলেন, ২১ শতকের নয়া ইতিহাস লিখবে ভারত ও আমেরিকা। কিন্তু, আচমকাই তাতে ছন্দপতন। নয়াদিল্লির অস্বস্তি বাড়িয়ে একের পর এক পদক্ষেপ করছে যুক্তরাষ্ট্র। কী নেই তাতে? এ দেশের পণ্যে বাড়তি শুল্ক চাপিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। এমনকি ভারতীয় অর্থনীতিকে ‘মৃতবৎ’ বলে তোপ পর্যন্ত দেগেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
০২২০
কেন দিন দিন চওড়া হচ্ছে ভারত-মার্কিন সম্পর্কের ফাটল? আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের অনেকেই অবশ্য মনে করেন, নয়াদিল্লিকে নিয়ে ওয়াশিংটনের আতঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। গত কয়েক বছরে অর্থনীতি, মহাকাশ গবেষণা এবং সামরিক শক্তিতে বুলেট গতিতে উত্থান হয়েছে ভারতের। ফলে ‘কৌশলগত অংশীদার’কেই ভবিষ্যতের প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করছে আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের পারের ‘সুপার পাওয়ার’।
০৩২০
মার্কিন অর্থনীতি অবশ্য এখনও ভারতের চেয়ে অনেকটাই বড়। এ ব্যাপারে এক নম্বর স্থান ধরে রেখেছে আমেরিকা। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, স্বাধীনতার ৭৮ বছরের মধ্যেই বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী অর্থনৈতিক দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে নয়াদিল্লি। তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা চিনের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘কৌশলগত অংশীদার’, যা মানতে কষ্ট হচ্ছে ওয়াশিংটনের।
০৪২০
মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে ভারতের সাফল্য চমকপ্রদ। এক বারের চেষ্টাতেই মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে কৃত্রিম উপগ্রহকে স্থাপন করতে পেরেছেন এ দেশের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। এ ছাড়া চাঁদের অন্ধকার দক্ষিণ মেরুতে মহাকাশযান নামানোর সাফল্যও রয়েছে তাঁদের মুকুটে। ফলে আমেরিকার ‘ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ বা নাসার সঙ্গে প্রায় এক সারিতে চলে এসেছে এ দেশের অন্তরীক্ষ গবেষণাকেন্দ্র ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজ়েশন (ইসরো)।
০৫২০
গত কয়েক বছরে বহু ইউরোপীয় দেশের কৃত্রিম উপগ্রহ মহাশূন্যে পাঠিয়েছে ইসরো। একটা সময়ে এই উৎক্ষেপণের জন্য নাসা ছাড়া তাদের সামনে দ্বিতীয় কোনও রাস্তা খোলা ছিল না। মার্কিন মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্রের মতোই বর্তমানে সূর্য পর্যবেক্ষণে মন দিয়েছেন এ দেশের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। অগ্নিগোলক নক্ষত্রটির রহস্য উদ্ঘাটনে ‘আদিত্য এল-১’ নামের একটি কৃত্রিম উপগ্রহ মহাশূন্যে পাঠিয়েছেন তাঁরা।
০৬২০
পরমাণু শক্তিধর ভারতের সামরিক ক্ষমতাও নেহাত কম নয়। বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ফৌজ রয়েছে নয়াদিল্লির হাতে। জল, স্থল, আকাশ, এমনকি সমুদ্রের গভীর থেকেও আণবিক আক্রমণ চালানোর সক্ষমতা রয়েছে এ দেশের বাহিনীর। সম্প্রতি সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটারের বেশি পাল্লার ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ‘ডিফেন্স রিসার্চ ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজ়েশন’ বা ডিআরডিও।
০৭২০
বিশ্লেষকদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্র জানে ধীরে ধীরে সামরিক প্রযুক্তিতেও তাদের ছুঁয়ে ফেলছে ভারত। ফলে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় বাড়ছে নয়াদিল্লির প্রভাব। বর্তমানে ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম এবং ফিলিপিন্সের মতো দেশ অত্যাধুনিক হাতিয়ারের জন্য শুধুমাত্র আমেরিকার মুখাপেক্ষী নয়। ভারতের থেকেও অস্ত্র আমদানি শুরু করেছে তারা।
০৮২০
ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ভারত-মার্কিন সম্পর্কে কিছুটা চিড় ধরলেও ঐতিহাসিক ভাবে দু’দেশের ‘বন্ধুত্ব’ যে সরলরেখায় চলেছে, এমনটা নয়। ১৭৯২ সালে কলকাতায় প্রথম দূতাবাস খোলে যুক্তরাষ্ট্র। তত দিনে অবশ্য বাংলা-বিহার-ওড়িশার শাসক হয়ে বসেছে এ দেশে ব্যবসা করতে আসা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৮ শতকের ওই সময়ে ইংরেজদের থেকে সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন কিংবদন্তি জর্জ ওয়াশিংটন।
০৯২০
প্রাক্-স্বাধীনতা যুগে ভারতের মুক্তি সংগ্রামের বড় সমর্থক ছিল আমেরিকা। ২০ শতকে মহাত্মা গান্ধীর ডান্ডি অভিযান থেকে শুরু করে লবণ সত্যাগ্রহ— সব কিছুর প্রশংসা করে একাধিক প্রতিবেদন এবং প্রবন্ধ প্রকাশ করে ওয়াশিংটন পোস্টের মতো জনপ্রিয় মার্কিন গণমাধ্যম। ব্রিটিশ সরকার অবশ্য এগুলিকে একেবারেই ভাল চোখে দেখেনি। আর তাই এ দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার উপরে কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি রেখেছিলেন তাঁরা।
১০২০
তার পরেও ১৯ শতক থেকেই উচ্চশিক্ষার জন্য পরাধীন ভারতের মেধাবী পড়ুয়াদের একাংশ আমেরিকায় পাড়ি জমানো শুরু করেন। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে সংবিধানের প্রাণপুরুষ বাবাসাহেব অম্বেডকরের কথা বলা যেতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন দু’তরফে আরও বেড়েছিল ঘনিষ্ঠতা। ওই সময়ে জাপানি আগ্রাসন ঠেকাতে এ দেশের একাধিক সেনাছাউনি মার্কিন ফৌজকে ব্যবহার করতে দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার।
১১২০
১৯৫০-এর দশকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান) সঙ্গে ঠান্ডা যুদ্ধে জড়ায় আমেরিকা। এই সংঘাত শুরুর কয়েক বছর আগে স্বাধীনতা লাভ করে ভারত। এ দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ওই সময়ে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সূচনা করেন। এর মাধ্যমে ওয়াশিংটন বা মস্কো— কোনও জোটে না গিয়ে আলাদা ভাবে আন্তর্জাতিক স্তরে নয়াদিল্লির গুরুত্ব তুলে ধরতে চেয়েছিলেন তিনি। যদিও বিষয়টিকে সন্দেহের চোখেই দেখেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
১২২০
আমেরিকার যুক্তি ছিল, মুখে জোট নিরপেক্ষতার কথা বললেও ভারতের পাল্লা ঝুঁকে আছে সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে। আর তাই মস্কোর প্রভাব হ্রাস করতে ১৯৫৪ সালে ‘দক্ষিণ-পূর্ব চুক্তি সংস্থা’ বা সিয়াটো (সাউথ-ইস্ট এশিয়া ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) এবং ১৯৫৫ সালে ‘কেন্দ্রীয় চুক্তি সংস্থা’ বা সেন্টো (সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) নামের দু’টি সামরিক সংগঠন তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্র। এই দু’য়েরই সদস্য ছিল পাকিস্তান।
১৩২০
১৯৬২ সালে ভারত-চিন যুদ্ধের সময় আমেরিকার কাছে সামরিক সাহায্য চান নেহরু। নয়াদিল্লির জোট নিরপেক্ষ অবস্থান সত্ত্বেও তা দিতে রাজি হন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন ফিটজ়েরাল্ড কেনেডি। যদিও নানা কারণে ওই সাহায্য আর এসে পৌঁছোয়নি। পরবর্তী বছরগুলিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায় কেন্দ্র। ফলে ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ সালের ভারত-পাক যুদ্ধের সময় খোলাখুলি ভাবে ইসলামাবাদের পাশে ছিল যুক্তরাষ্ট্র।
১৪২০
গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে খাদ্য বিষয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল না ভারত। ফলে নয়াদিল্লিকে গম সরবরাহ করত যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্লেষকদের দাবি, এর মাধ্যমে এ দেশের যাবতীয় বিদেশনীতি নিয়ন্ত্রণ করার ছক কষে মার্কিন সরকার। বিষয়টি বুঝতে বেশি দেরি হয়নি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর। সঙ্গে সঙ্গে ওয়াশিংটনের সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে থাকেন তিনি। এতেও দু’তরফের সম্পর্কে শীতলতা এসেছিল।
১৫২০
১৯৭৪ এবং ১৯৯৮ সালে মার্কিন নজরদারি এড়িয়ে রাজস্থানের পোখরানে পরমাণু পরীক্ষা করে ভারত। নয়াদিল্লির হাতে আণবিক হাতিয়ার থাকুক, তা কখনওই চায়নি ওয়াশিংটন। ফলে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার পরেই নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর অবশ্য কাছাকাছি এসেছিল দুই দেশ। ফলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও দু’তরফে সম্পর্কে সে ভাবে বৈরিতা আসেনি।
১৬২০
গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকে আর্থিক উদার নীতির প্রবর্তন করেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। ফলে মার্কিন লগ্নিকারীদের জন্য এ দেশের দরজা খুলে গিয়েছিল। ১৯৬৮ সালে ‘পরমাণু অস্ত্র বিস্তার নিয়ন্ত্রণ চুক্তি’র মূল উদ্যোক্তা ছিল আমেরিকা। সংশ্লিষ্ট চুক্তিটিতে সই করেনি ভারত। ফলে ’৭৪ সালের আণবিক পরীক্ষার পর ‘পরমাণু সরবরাহকারী গ্রুপ’-এ নয়াদিল্লির প্রবেশ বন্ধ করে যুক্তরাষ্ট্র। সেই নিষেধাজ্ঞা এখনও বহাল রয়েছে।
১৭২০
কিন্তু, ২১ শতাব্দীতে পৌঁছে ফের ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করতে উদ্যোগী হয় ওয়াশিংটন। ২০০৫ সালে নয়াদিল্লির সঙ্গে বেসামরিক পরমাণু চুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি, ওই সময় থেকেই ভারতীয় ফৌজকে হাতিয়ার সরবরাহ করা শুরু করে আমেরিকার সরকার। দু’তরফে একাধিক প্রতিরক্ষা সমঝোতাও হয়েছিল।
১৮২০
পরবর্তী বছরগুলিতে ভারতের সঙ্গে জেনারেল সিকিউরিটি অফ মিলিটারি ইনফরমেশন এগ্রিমেন্ট এবং কমিউনিকেশন কমপ্যাটিবিলিটি অ্যান্ড সিকিউরিটি এগ্রিমেন্টের মতো সামরিক চুক্তি করে আমেরিকা। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব’ বাড়ালেও রাশিয়াকে কখনওই ভুলে যায়নি নয়াদিল্লি। মস্কোর থেকেও হাতিয়ার আমদানি সমান তালে চালিয়ে গিয়েছে কেন্দ্র। ‘কৌশলগত অংশীদারি’ থাকার কারণে তাতে ছাড় দিতে বাধ্য হয় আমেরিকা।
১৯২০
সাবেক মার্কিন বিদেশ সচিব হেনরি কিসিংজ়ার একবার বলেছিলেন, ‘‘আমেরিকার শত্রু হওয়া বিপজ্জনক, তবে বন্ধু হওয়া ধ্বংসত্মাক।’’ তাঁর ওই মন্তব্যের গুরুত্ব হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে নয়াদিল্লি। তবে বিশ্লেষকদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রকেও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একটি প্রতিক্রিয়া মনে রাখতে হবে। তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘‘ওয়াশিংটন বন্ধু হতে পারে, বস্ নয়। ভারত নিজের ভাগ্য নিজে লিখতে সক্ষম।’’
২০২০
বিশ্লেষকদের দাবি, ভারত-মার্কিন সম্পর্কের উত্থান-পতনের নেপথ্যে রয়েছে দু’তরফের নিজস্ব স্বার্থ। সাম্প্রতিক সময়ের ফাটল সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে। ট্রাম্প জমানায় জটিলতা তৈরি হলেও আমেরিকার কূটনীতিবিদদের একাংশের আবার নয়াদিল্লির সঙ্গে বৈরিতায় প্রবল আপত্তি রয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে ফের যে দু’পক্ষকে কাছাকাছি আসতে দেখা যাবে না, তা বলা দুষ্কর।