Chinese dominance increasing amid Donald Trump’s diplomatic distance with Africa dgtl
US China in Africa
দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাদেশে মাটির গভীরে লুকিয়ে ‘কুবেরের ধন’! ট্রাম্পের ‘বোকামি’তে সব সম্পত্তি হাতাচ্ছে সুযোগসন্ধানী চিন
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাদেশ থেকে অনেকটাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফলে সেখানে ভাল ভাবে পা জমানোর সুযোগ পাচ্ছে চিন। সেখানকার বিরল খনিজের ভান্ডারও ধীরে ধীরে কব্জা করতে বেজিঙের যে সুবিধা হচ্ছে, তা বলাই বাহুল্য।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৫ ১০:২৭
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
আফ্রিকাকে ‘অবহেলা’! বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাদেশটির সঙ্গে ক্রমশ দূরত্ব বাড়াচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর সেই ফাঁক গলে সেখানে প্রভাব বিস্তারে চেষ্টার কসুর করছে না চিন। যুক্তরাষ্ট্রের এ-হেন বিদেশনীতির কড়া সমালোচনা করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ। তাঁদের যুক্তি, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত ‘নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মারার শামিল’। এর জেরে আগামী দিনে লিথিয়াম, কোবাল্ট ও তামার মতো বিরল এবং অন্যান্য খনিজ থেকে বঞ্চিত হবে ওয়াশিংটন।
০২১৮
২১ শতকের বিশ্বে কৃত্রিম মেধা (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা এআই) প্রযুক্তি এবং তথ্যভান্ডারের (ডেটা সেন্টার) গুরুত্ব অপরিসীম। এই দুই ক্ষেত্রে উন্নতির জন্য প্রয়োজন লিথিয়াম ও কোবাল্টের মতো বিরল ধাতু। আফ্রিকার মাটির গভীরে লুকিয়ে আছে সেই ‘কুবেরের ধন’। বিষয়টি নজরে আসার পর থেকেই সংশ্লিষ্ট সম্পদের লোভে সেখানে লগ্নি বাড়িয়ে চলেছে চিন। এই পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকায় ঘরের মাটিতেই প্রশ্নের মুখে পড়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
০৩১৮
দ্বিতীয় বারের জন্য ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার আগে আফ্রিকার দিকে মার্কিন সরকারের একেবারে নজর ছিল না, এমনটা নয়। গত বছর (২০২৪ সাল) অনুদান ও ত্রাণের নামে সেখানকার দেশগুলির মধ্যে ১,৩০০ কোটি ডলার বিলি করে যুক্তরাষ্ট্র। ইউএসএড (ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট) এবং পেপফার-এর (ইউএস প্রেসিডেন্ট্স এনার্জি প্ল্যান ফর এড্স রিলিফ) নামে ওই টাকা দিয়েছিল ওয়াশিংটন। কিন্তু, এ বছরের জানুয়ারিতে কুর্সিতে বসে ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতিতে জোরে দেন ট্রাম্প। এর পরই তাঁর নির্দেশে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাদেশটিকে কোটি কোটি ডলার দেওয়া বন্ধ করেছে মার্কিন প্রশাসন।
০৪১৮
২০২৩ সালে আফ্রিকায় ‘লোবিটো করিডর’ নির্মাণের কথা ঘোষণা করে আমেরিকা। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটিতে ১,৩০০ কিলোমিটার লম্বা রেলপথ তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে ওয়াশিংটনের। এর মাধ্যমে অ্যাঙ্গোলার লোবিটো বন্দর থেকে শুরু করে ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গো (ডিআরসি) হয়ে জ়াম্বিয়া পর্যন্ত রেল যোগাযোগ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মার্কিন প্রশাসন। কিন্তু, বর্তমানে এই প্রকল্প থেকে ধীরে ধীরে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করছে ট্রাম্প প্রশাসন।
০৫১৮
বিশ্লেষকদের দাবি, ‘লোবিটো করিডোর’-এর মাধ্যমে আফ্রিকার গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সরবরাহ নিজের দিকে টানার সুযোগ তৈরি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্পের নীতির ফলে সেটা একরকম ধ্বংস হয়ে গিয়েছে বলা চলে। চলতি বছরের মার্চে ইউএসএড বন্ধ করার অনুষ্ঠানিক ঘোষণা করে ওয়াশিংটন। মার্কিন সরকারের এ-হেন সিদ্ধান্তে আমেরিকার প্রতি বিশ্বাসে চরম আঘাত লেগেছে আর্থিক ভাবে দুর্বল মহাদেশটির। ফলে তারা আরও বেশি করে চিনের দিকে ঝুঁকছে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
০৬১৮
সম্প্রতি এই ইস্যুতে গণমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন জ়াম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট হাকাইন্ডে হিচিলেমা। তাঁর কথায়, ‘‘ট্রাম্প আমাদের দু’গালেই থাপ্পড় মেরেছেন। আমেরিকার সহায়তা যে কতটা নিষ্ঠুর সেটা আমরা বুঝে গিয়েছি। সে দিক থেকে চিন অনেক বেশি ভরসাযোগ্য বন্ধু। কোনও প্রকল্পকে অর্ধেক অবস্থায় রেখে পিছিয়ে যায়নি বেজিং।’’ কূটনীতিকেরা অবশ্য মনে করেন, গত এক দশক ধরে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর (বিআরআই) নামে সেখানকার অর্থনীতিকে মুঠোবন্দি করে ফেলেছে ড্রাগন সরকার।
০৭১৮
বর্তমানে আফ্রিকার ৫২টি দেশের সঙ্গে বিআরআই সংক্রান্ত সমঝোতা চুক্তি রয়েছে চিনের। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের মাধ্যমে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাদেশটি জুড়ে রাস্তা, সমুদ্র ও বিমানবন্দর, রেলপথ-সহ অন্যান্য পরিকাঠামোগত উন্নয়নমূলক কাজ করছে বেজিং। এ কথা শুনতে ভাল লাগলেও ব্যাপারটা মোটেই অতটা সহজ নয়। প্রথমত, এই প্রকল্পের নামে আফ্রিকার গরিব দেশগুলিকে চড়া সুদে কোটি কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে ড্রাগন। দ্বিতীয়ত, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী বিআরআই প্রকল্পের কাজ চিনা সংস্থাকেই দিতে হচ্ছে আফ্রিকার দেশগুলিকে।
০৮১৮
ফলে পরিকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে মহাদেশটির ভিতরে যে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে, এমনটা নয়। উল্টে যত সময় গড়াচ্ছে ততই ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে আফ্রিকার দেশগুলি। এ ভাবে চলতে চলতে একসময়ে দেউলিয়া পরিস্থিতি তৈরি হলে সেখানকার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে ড্রাগন যে দ্বিতীয় বার ভাববে না, তা বলাই বাহুল্য।
০৯১৮
পশ্চিমি সংবাদসংস্থা ‘জিয়ো পলিটিক্যাল মনিটর’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধুমাত্র ২০২৩ সালে বিআরআই প্রকল্পে আফ্রিকার দেশগুলিকে ২,১৭০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে চিন। বিনিময়ে আফ্রিকার বিশাল খনিজ সম্পদের দখল নিতে শুরু করেছে বেজিং। উদাহরণ হিসাবে ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গোর (ডিআরসি) কথা বলা যেতে পারে। মধ্য আফ্রিকার দেশটির সমস্ত কোবাল্ট ও তামার খনির ৭২ শতাংশ মালিকানা রয়েছে ড্রাগনের হাতে।
১০১৮
একই কথা গিনির ক্ষেত্রেও সত্যি। সেখানকার বক্সাইট শিল্পে একচেটিয়া আধিপত্য রয়েছে চিনা সংস্থার। এ ছাড়া সিমান্ডু লৌহখনির একটা বড় অংশীদারি পেয়েছে বেজিং। ড্রাগনের এই ঋণ-জালের দড়ি লোবিটো করিডর দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কেটে ফালা ফালা করবে বলে মনে করা হয়েছিল। এই প্রকল্পের মাধ্যমে আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক, আফ্রিকা ফিন্যান্স কর্পোরেশন, আমেরিকা এবং ইউরোপিয়ান কমিশনকে এক সূত্রে বেঁধে ফেলার পরিকল্পনাও ছিল ওয়াশিংটনের।
১১১৮
আর্থিক সাহায্যের বাইরে অন্যান্য বিষয়েও আফ্রিকার সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়েছেন ট্রাম্প। সেখানকার চাদ, রিপাবলিক অফ কঙ্গো, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি, ইরিত্রিয়া, লিবিয়া, সোমালিয়া এবং সুদানবাসীদের পর্যটন, অভিবাসী এবং উচ্চশিক্ষার জন্য ভিসা দেওয়া বন্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন। এ ব্যাপারে প্রতিবাদ জানিয়েছিল আফ্রিকান ইউনিয়ন। কিন্তু, তাতে তেমন কোনও লাভ হয়নি। এখনও পর্যন্ত নিজের সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
১২১৮
পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের ৩০ শতাংশ বিরল খনিজের ভান্ডার রয়েছে আফ্রিকায়। এই ধাতুগুলির সামরিক এবং অসামরিক উপযোগিতা অপরিসীম। স্মার্টফোন, কম্পিউটারের হার্ডঅয়্যার, রেডার, কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ও লড়াকু জেট, যাবতীয় সরঞ্জাম তৈরিতে প্রয়োজন হয় এই বিরল খনিজের। ২০২৯ সালের মধ্যে যার ১০ শতাংশ একক ভাবে রফতানি করবে আফ্রিকা।
১৩১৮
‘জিয়ো পলিটিক্যাল মনিটর’-এর দাবি, ২০২৪ সালে আফ্রিকার বিরল খনিজ রফতানির ৪০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করেছে চিন। চলতি আর্থিক বছরের (২০২৫-’২৬) শেষে এই অঙ্ক ৪৫ থেকে ৪৮ শতাংশ পৌঁছোনোর সম্ভাবনা রয়েছে। সেই কারণেই সংশ্লিষ্ট মহাদেশটিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করছে বেজিং। আফ্রিকায় মার্কিন প্রভাব পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করাই যে তাদের লক্ষ্য, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
১৪১৮
২০০৪ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত অ্যাঙ্গোলায় পরিকাঠামোগত উন্নয়নে বিপুল লগ্নি করে চিন। বিশ্লেষকদের অনেকেই বেজিঙের এই পদক্ষেপকে ‘মাস্টারস্ট্রোক’ বলে উল্লেখ করেছেন। এর জেরে আফ্রিকার দেশগুলির মধ্যে ড্রাগনের গ্রহণযোগ্যতা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ফলে পরবর্তী দশকগুলিতে সেখানে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর মতো প্রকল্পকে নিয়ে যেতে কোনও সমস্যা হয়নি ড্রাগনের।
১৫১৮
আফ্রিকার ৫৪টি দেশের মধ্যে বর্তমানে ৫২টির সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক বেশি বাণিজ্যিক লেনদেন করে থাকে চিন। এ বছরের জুনে সেখানকার ৫৩টি দেশকে বিনা শুল্কে বাণিজ্যের প্রস্তাব দেয় বেজিং। সিংহভাগ রাষ্ট্রই এই প্রস্তাব মেনে নিয়েছে বলে সূত্র মারফত মিলেছে খবর। ফলে আফ্রিকার ভোক্তা বাজারের প্রায় পুরোটাই চলে গিয়েছে মান্দারিনভাষীদের কবলে। যদিও একে ‘অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ’ হিসাবে দেখতে নারাজ সাধারণ আফ্রিকাবাসী।
১৬১৮
এ ব্যাপারে বিস্ফোরক তথ্য দিয়েছে ‘আফ্রোব্যারোমিটার’-এর সমীক্ষা রিপোর্ট। সেখানে বলা হয়েছে, মধ্যবিত্ত আফ্রিকাবাসীর মন জয়ের ক্ষেত্রে আমেরিকার চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে চিন। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মহাদেশটির ৬০ শতাংশ বাসিন্দা বেজিঙের প্রভাব বৃদ্ধিকে ইতিবাচক বলে মনে করেন। ৫৩ শতাংশের মনে আবার যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে রয়েছে প্রবল ঘৃণা।
১৭১৮
গত বছর পর্যন্ত লোবিটো প্রকল্পকে ট্রান্স আফ্রিকান করিডরে বদলে ফেলার স্বপ্ন দেখছিল আমেরিকা। বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, এতে সাফল্য এলে সংশ্লিষ্ট মহাদেশটিতে বড়সড় আর্থিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হত চিনকে। অন্য দিকে কূটনীতিক দিক দিয়ে সেখানে প্রভাব বিস্তারে অনেক বেশি সুবিধাজনক জায়গায় থাকত যুক্তরাষ্ট্র।
১৮১৮
চিনের মতোই আফ্রিকার দেশগুলির সঙ্গে ‘কৌশলগত সম্পর্ক’ মজবুত করার দিকে নজর দিয়েছে ভারত। গত বছর নাইজ়েরিয়া সফর করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেখানে ‘দ্য গ্র্যান্ড কমান্ডার অফ দ্য অর্ডার অফ দ্য নাইজ়ার’ (জিকন) নামের বিশেষ রাষ্ট্রীয় সম্মান পান তিনি। আফ্রিকার একাধিক দেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য এবং জ্বালানি সহযোগিতা বৃদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নয়াদিল্লি।