Europe’s auto industry may destroy amid China Netherlands chip war over Nexperia dgtl
Chinese Chip War
চিন অধিগৃহীত সংস্থার দখল নিতেই ‘বাঁধের দেশে’ তুলকালাম! পাল্টা ‘হামলায়’ ইউরোপের গাড়ি শিল্পে লালবাতি জ্বালানোর ছক কষছে বেজিং
জাতীয় সুরক্ষার দোহাই দিয়ে চিন অধিগৃহীত সংস্থা নেক্সপেরিয়ার দখল নিয়েছে নেদারল্যান্ডসের সরকার। এই ঘটনার পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় চিপ নির্মাণের যাবতীয় কাঁচামাল সরবরাহ বন্ধের নির্দেশ দেয় বেজিং। ফলে মারাত্মক সঙ্কটের মুখে পড়েছে সমগ্র ইউরোপের গাড়ি নির্মাণশিল্প।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২৫ ১৬:২০
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
চিপ-যুদ্ধে এ বার চিন বনাম নেদারল্যান্ডস। বেজিঙের ‘চক্রান্ত’ আঁচ করে তাদের একটা সংস্থাকে কব্জা করেছে ডাচেরা। সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা চালে মাত দিতে যাবতীয় বিরল ধাতুর রফতানি থামিয়ে দেয় ড্রাগন। পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে তাতে দিনকে দিন দু’তরফেই বাড়বে আর্থিক লোকসানের অঙ্ক। শুধু তা-ই নয়, সর্বাধিক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে গাড়ির নির্মাণশিল্পে। ফলে সংশ্লিষ্ট সংঘাতে অচিরেই জড়াতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ গোটা পশ্চিম ইউরোপ, বলছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
০২১৮
যাকে কেন্দ্র করে সমস্যার সূত্রপাত তার নাম নেক্সপেরিয়া। ‘বাঁধের দেশ’ নেদারল্যান্ডসের এই সেমিকন্ডাক্টর নির্মাণকারী সংস্থাটিকে ২০১৯ সালে অধিগ্রহণ করে চৈনিক কোম্পানি উইংটেক টেকনোলজি। ফলে রাতারাতি বেজিঙের হাতে চলে যায় এর যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ। এই পরিস্থিতিতে চলতি বছরে হঠাৎ করেই সংশ্লিষ্ট সংস্থাটির দখল নেয় ডাচ সরকার। আমস্টারডামের এ-হেন পদক্ষেপের জেরে নেক্সপেরিয়ার ‘বৌদ্ধিক সম্পত্তি’র (ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি) অধিকার হারায় ড্রাগন। এতে দু’তরফে চড়তে থাকে পারদ।
০৩১৮
চৈনিক অধিগ্রহণের ছ’বছরের মাথায় কেন চিপ নির্মাণকারী সংস্থাটির দখল নিল ডাচ প্রশাসন? এর নেপথ্যে অবশ্য রয়েছে একাধিক কারণ। নেদারল্যান্ডসের অভিযোগ, নেক্সপেরিয়াকে সামনে রেখে তাদের দেশের জটিল প্রযুক্তি চুরির চেষ্টা চালাচ্ছিল বেজিঙের গুপ্তচরবাহিনী। ফলে প্রশ্নের মুখে পড়ে জাতীয় সুরক্ষা। তাই বাধ্য হয়ে বিশেষ একটি আইন প্রয়োগ করে সংশ্লিষ্ট সংস্থাটির নিয়ন্ত্রণ হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছে ডাচ সরকার। পাশাপাশি, নেক্সপেরিয়াকে ড্রাগনভূমির সঙ্গে যাবতীয় সম্পর্ক ছিন্ন করার নির্দেশ দিয়েছে তারা।
০৪১৮
গত ১২ অক্টোবর এই ইস্যুতে বিবৃতি দেয় নেদারল্যান্ডসের অর্থ মন্ত্রক। সেখানে বলা হয়, অত্যন্ত ব্যতিক্রমী ‘পণ্য প্রাপ্যতা আইন’ (পড়ুন গুড্স অ্যাভিলিবিলিটি অ্যাক্ট) প্রয়োগ করে নেক্সপেরিয়ার যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়েছে ডাচ সরকার। আর তাই ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে প্রশাসনের নির্দেশ মেনে যাবতীয় পদক্ষেপ করছে এই সেমিকন্ডাক্টর নির্মাণকারী সংস্থা। উল্লেখ্য, আর্থিক নিরাপত্তা এবং জাতীয় স্বার্থ সুরক্ষিত করতে ইউরোপের ‘বাঁধের দেশ’-এ সংশ্লিষ্ট আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার রয়েছে।
০৫১৮
চৈনিক অধিগৃহীত সংস্থা নেক্সপেরিয়ার উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ পাওয়া মোটেই সহজ ছিল না। এই ইস্যুতে আমস্টারডামের আদালতের বিশেষ বিভাগ ডাচ এন্টারপ্রাইজ় চেম্বারে দীর্ঘ শুনানি হয়। সেখানেই চিপ নির্মাণকারী সংস্থাটির সাবেক চিফ এক্জ়িকিউটিভ অফিসার বা সিইও ঝাং জুয়েঝেঙের একাধিক ‘সন্দেহজনক’ পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। নেক্সপেরিয়া কর্তৃপক্ষ এর কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি। ঝাঙের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট সংস্থার ‘বৌদ্ধিক সম্পত্তি’ বেজিঙে পাচারের অভিযোগ রয়েছে।
০৬১৮
ওই শুনানির পরেই ব্যতিক্রমী ‘পণ্য প্রাপ্যতা আইন’ প্রয়োগের কথা ঘোষণা করে ডাচ সরকার। পরে এ ব্যাপারে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, গুরুতর প্রশাসনিক ত্রুটির কারণে নেক্সপেরিয়ার ব্যাপারে হস্তক্ষেপের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ইউরোপের মাটিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং সুরক্ষার ক্ষেত্রে হুমকি তৈরি হচ্ছিল। সেই কারণেই দ্রুত পদক্ষেপ করতে বাধ্য হয়েছে আমস্টারডাম। তবে সংশ্লিষ্ট সংস্থার চিপ নির্মাণের প্রক্রিয়া যে আপাতত অব্যাহত থাকছে, ইতিমধ্যেই তা নিশ্চিত করেছে নেদারল্যান্ডস।
০৭১৮
ডাচ সরকার নেক্সপেরিয়ার দখল নিতেই পাল্টা পদক্ষেপ করে চিন। চিপ তৈরির যাবতীয় কাঁচামালের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় বেজিং। ফলে নেক্সপেরিয়ারের পক্ষে সেমিকন্ডাক্টর তৈরি করা একরকম অসম্ভব হয়ে ওঠে। ইউরোপের অন্যান্য দেশের উপর পড়েছে এর প্রভাব। কারণ, সেখানকার গাড়ি নির্মাণশিল্পে বহুল পরিমাণে ব্যবহার হয় আমস্টারডামের সংস্থাটির সেমিকন্ডাক্টর। সেটা ব্যাহত হলে তাদের উৎপাদন যে ধাক্কা খাবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
০৮১৮
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ইউরোপের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির (পড়ুন গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) সাত শতাংশ রয়েছে গাড়ি নির্মাণশিল্পের দখলে। এ ব্যাপারে সর্বাধিক অবদান জার্মানির। সেখানকার বোশ, ফোক্সভাগেন এবং বিএমডব্লিউয়ের মতো সংস্থার তৈরি করা গাড়ির দুনিয়া জুড়ে কদর রয়েছে। চিপের অভাবে এই সমস্ত সংস্থার উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না কেউই।
০৯১৮
বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, গাড়ির ইঞ্জিন কন্ট্রোল ইউনিট এবং ব্যাটারিতে সেমিকন্ডাক্টরের প্রয়োজন হয়। এত দিন পর্যন্ত এই সংস্থাগুলিকে সেটা সরবরাহ করছিল নেদারল্যান্ডসের সংস্থা নেক্সপেরিয়া। কিন্তু, বেজিং থেকে কাঁচামাল সরবরাহ পাকাপাকি ভাবে বন্ধ হলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিটি কত দিন চিপ তৈরি করতে পারবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। সেই কারণেই গোটা ইউরোপের গাড়ি নির্মাণশিল্প একটা হুমকির মুখে পড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
১০১৮
উদাহরণ হিসাবে বোশের সালৎজ়িটার এলাকার কারখানার কথা বলা যেতে পারে। জার্মানি সংস্থা সূত্রে খবর, চিপের অভাবে উৎপাদনে প্রভাব পড়লে সাময়িক ভাবে ওই প্ল্যান্ট বন্ধ রাখবে তারা। সে ক্ষেত্রে কাজ হারাতে পারেন ১,৪০০ জন কর্মী। একই অবস্থা ফোক্সভাগেনের ক্ষেত্রেও। সেমিকন্ডাক্টরের সরবরাহ শৃঙ্খলে সমস্যার কারণে তাদের যে উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে, সে কথা মেনে নিয়েছে জার্মানির ওই গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থা।
১১১৮
গত তিন বছরে নানা কারণে বার বার ধাক্কা খেয়েছে ইউরোপের গাড়ি নির্মাণশিল্প। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে জ্বালানি সঙ্কটের মুখে পড়ে উত্তর গোলার্ধের এই মহাদেশ। কারণ, এত দিন পর্যন্ত তাদের খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করছিল মস্কো। সংঘাত শুরু হতেই ক্রেমলিনের উপর ১৬ হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র-সহ গোটা পশ্চিম ইউরোপ। ফলে তাদের সরাসরি ‘তরল সোনা’ বিক্রি করা বন্ধ রেখেছে রাশিয়া।
১২১৮
রুশ তেলের সরবরাহ কমায় পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলিতে হু-হু করে বেড়েছে জ্বালানির দাম। এর জেরে নিম্নমুখী হয়েছে গাড়ি বিক্রির সূচক। বৈদ্যুতিন গাড়ি বা ইভির (ইলেকট্রিক ভেহিকল) ক্ষেত্রে আবার অন্য সমস্যা রয়েছে। এ বছরের জানুয়ারিতে কুর্সিতে বসেই শুল্কযুদ্ধ শুরু করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফলে আমেরিকার বাজারে গাড়ি বিক্রি করা বোশ, ফোক্সভাগেন বা বিএমডব্লিউয়ের মতো সংস্থার পক্ষে কঠিন হচ্ছে। উচ্চ শুল্কের কারণে দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই কিনতে চাইছেন না তাদের তৈরি গাড়ি।
১৩১৮
গোদের উপর বিষফোড়ার মতো ইউরোপের বাজারে আবার ঢুকে পড়েছে চিন। ইভি নির্মাণে বেজিঙের যথেষ্ট মুনশিয়ানা রয়েছে। অত্যন্ত সস্তা দরে গাড়ি বিক্রি করছে তারা। ফলে অনেকেই ড্রাগনভূমি থেকে আসা গাড়ি কিনে নিচ্ছেন। এতে আখেরে লোকসান হচ্ছে জার্মানি-সহ অন্য ইউরোপীয় দেশগুলির গাড়িনির্মাতাদের। এই পরিস্থিতিতে চিপের অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হলে বাজার দখল করতে মান্দারিনভাষী সংস্থাগুলি যে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
১৪১৮
নেক্সপেরিয়ার মতো চ্যালেঞ্জ যে চিন এর আগে কখনও তৈরি করেনি, এমনটা নয়। গত ৯ অক্টোবর জাতীয় নিরাপত্তার কথা বলে বিরল ধাতুর রফতানিতে নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ দেন ড্রাগনভূমির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। নতুন নিয়মে যে কোনও বিদেশি সংস্থাকে বিরল খনিজ সরবরাহ করার আগে সরকারের অনুমতি নিতে বলেছে বেজিং। বৈদ্যুতিক গাড়ি, তার যন্ত্রাংশ কিংবা মোবাইল ফোন-সহ একাধিক বৈদ্যুতিন পণ্যের উৎপাদন থেমে যাওয়ার আশঙ্কা বেড়েছে।
১৫১৮
বিরল খনিজ নিয়ে চিনের এ-হেন ‘দাদাগিরি’তে অবশ্য উষ্মা প্রকাশে দেরি করেনি আমেরিকা। বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি জেমিসন গ্রিয়ার। তাঁর কথায়, ‘‘এই বিধির মাধ্যমে বেজিং কার্যত সারা বিশ্বের অর্থনীতির উপরে নিয়ন্ত্রণ কায়েমের চেষ্টা করছে।’’ ফলে এই ইস্যুতে পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
১৬১৮
চিন অবশ্য বিরল খনিজের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ শুরু করতেই ১০০ শতাংশ শুল্ক চাপানোর হুমকি দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তাতে খুব একটা প্রতিক্রিয়া দেখায়নি বেজিং। কারণ, বিরল খনিজের ব্যাপারে ড্রাগনের উপরে আমেরিকার যথেষ্ট নির্ভরশীলতা রয়েছে। উল্টো দিকে মান্দারিনভাষীদের সেই সমস্যা নেই। আর তাই চাপ বজায় রাখছে তারা।
১৭১৮
সম্প্রতি মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালা লামপুরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১১টি দেশের গোষ্ঠী ‘আসিয়ান’-এর বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দেন মার্কিন অর্থসচিব স্কট বেসেন্ট। সেখানে চিনা আধিকারিকদের সঙ্গে আলাদা করে বৈঠক হয় তাঁর। এর পরই দু’তরফে বাণিজ্য সমঝোতা হয়েছে বলে খবর প্রকাশ্যে আসে। আর তাই ১ নভেম্বর থেকে কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও বেজিঙের পণ্যে আপাতত ১০০ শতাংশ শুল্ক চাপানো হচ্ছে না বলে জানিয়ে দেন স্কট।
১৮১৮
অন্য দিকে হাত-পা গুটিয়ে বসে নেই নেদারল্যান্ডসের সংস্থা নেক্সপেরিয়ারও। সমস্যা সমাধানে চিনা সরকার এবং ঠিকাদারদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেছে ডাচ প্রশাসন। পাশাপাশি চলছে বিকল্প রাস্তার খোঁজ। তবে বেজিং এ ব্যাপারে নাছোড়বান্দা অবস্থান নিলে মাথা ঝোঁকাতে হতে পারে এই ইউরোপীয় দেশকে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।