How Israeli spy agency Mossad stole MiG-21 fighter jets in cold war era, which was a game changing operation in West Asia dgtl
Operation Diamond
শত্রুর দেশে সিঁদ কেটে যুদ্ধবিমান ‘চুরি’, সোভিয়েতের তৈরি অত্যাধুনিক জেট গায়েব করে আরবের আকাশের দখল নেয় ইহুদিরা!
গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে ইরাক থেকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি মিগ-২১ লড়াকু জেট ‘চুরি’ করে নিয়ে আসে ইহুদি গুপ্তচরবাহিনী মোসাদ। রুদ্ধশ্বাস সেই অভিযানের পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন ডায়মন্ড’।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ১২:১৮
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
এ যেন কোনও জনপ্রিয় হলিউড চলচ্চিত্র বা ওয়েব সিরিজ়ের চিত্রনাট্য, যেখানে শত্রু দেশের অত্যাধুনিক লড়াকু জেট ‘চুরি’ করে পালাবে এক দুঃসাহসী গুপ্তচর! কিন্তু কোনও কল্পকাহিনি নয়। গত শতাব্দীর ৬০-এর দশকে জীবন বাজি রেখে এমনই এক রুদ্ধশ্বাস অভিযান চালায় মোসাদ, যা আরব দুনিয়ার যাবতীয় হিসাব উল্টে দিয়েছিল। ঘটনার এক বছরের মাথায় বিখ্যাত ছ’দিনের যুদ্ধে ত্রিমুখী জোটকে হেলায় হারিয়ে দিতে তাই কোনও সমস্যা হয়নি ইজ়রায়েলের।
০২১৮
ইহুদিদের ওই অভিযানের পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন ডায়মন্ড’। ১৯৬৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে যা শুরু করে ইজ়রায়েলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ। এতে সাফল্য আসে ১৯৬৬ সালের ১৬ অগস্ট। ইরাকি বিমানবাহিনীর থেকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) তৈরি মিগ-২১ লড়াকু জেট উড়িয়ে নিজেদের ঘাঁটিতে নিয়ে আসে তারা। এই ‘চুরি’তে তেল আভিভের পাশাপাশি সুবিধা পেয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। মস্কোর তৈরি যুদ্ধবিমানটির শক্তি এবং দুর্বলতা সংক্রান্ত যাবতীয় খুঁটিনাটি হস্তগত করে ওয়াশিংটন।
০৩১৮
১৯৫৯ সালে সাবেক সোভিয়েত বিমানবাহিনীতে শামিল হয় মিগ-২১ লড়াকু জেট। কর্মজীবনের গোড়াতেই ভিয়েতনাম যুদ্ধে (১৯৫৫-’৭৫ সাল) শক্তি প্রদর্শন করে মস্কোর ওই ‘ব্রহ্মাস্ত্র’। এর সঙ্গে আকাশের লড়াইয়ে মার্কিন যুদ্ধবিমানগুলি এঁটে উঠতে পারেনি। ফলে অস্ত্রের বাজারে হু-হু করে বাড়তে থাকে মিগ-২১-এর কদর। ১৯৬১-’৬২ সালের মধ্যেই ক্রেমলিনের সাধের জেটটি আমদানি করে ফেলে একাধিক উপসাগরীয় আরব দেশ। ফলে প্রমাদ গোনে ইজ়রায়েল।
০৪১৮
উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলিকে মিগ-২১ সরবরাহের নেপথ্যে তৎকালীন সোভিয়েত নেতৃত্বের ছিল অন্য ছক। ওই সময়ে আমেরিকার সঙ্গে ‘ঠান্ডা লড়াই’য়ে জড়িয়ে পড়ে মস্কো। ফলে পশ্চিম এশিয়ায় মার্কিন প্রভাব কমাতে মরিয়া হয়ে ওঠে ক্রেমলিন। এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ ‘বন্ধু’ হিসাবে পরিচিত ইহুদিদের বিপদ বাড়াতে বিন্দুমাত্র দেরি করেনি তারা। ছক কষেই আরব দুনিয়ায় দেদার অস্ত্র বিক্রি করতে থাকেন সোভিয়েত নেতৃত্ব, যে তালিকায় ছিল মিগ-২১ জেটও।
০৫১৮
মস্কোর এই বিপজ্জনক নীতি আঁচ করে নিতে ইহুদিদের বেশি সময় লাগেনি। তত দিনে উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলির মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী বিমানবাহিনী তৈরি করে ফেলেছে ইজ়রায়েল। ফলে লড়াইয়ের গোড়াতেই শত্রুর আকাশ দখল করে ফেলার চাবিকাঠি ছিল তাঁদের হাতে। সেই সুবিধা হারিয়ে ফেললে তেল আভিভ যে অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়বে, তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি ইহুদি প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়েনের। আর তাই গুপ্তচরবাহিনী মোসাদকে শত্রুর ঘরে সিঁদ দিয়ে মিগ-২১ চুরির নির্দেশ দেন তিনি।
০৬১৮
ওই সময়ে আরব দুনিয়ার দু’টি দেশের বায়ুসেনার বহরে ছিল মিগ-২১। তার মধ্যে একটি হল ইজ়রায়েলের প্রতিবেশী মিশর। আর তাই সোভিয়েত জেটটিকে চুরি করতে প্রথমে ‘পিরামিডের দেশ’কেই পাখির চোখ করে মোসাদ। এই কাজের দায়িত্ব জিন থমাস নামের এক এজেন্টকে দেয় ইহুদিদের গুপ্তচরবাহিনী। আদিব হান্না নামে কায়রোর এক লড়াকু জেট পাইলটের সঙ্গে খুব দ্রুত যোগাযোগ করে ফেলেন তিনি। ১০ লক্ষ ডলার ঘুষের বিনিময়ে মিগ-২১কে ইজ়রায়েলে উড়িয়ে নিয়ে যেতে রাজি হন আদিব।
০৭১৮
থমাস যখন অভিযানের জাল গুটিয়ে এনেছেন, তখনই বিশ্বাসঘাতকতা করে বসেন ওই মিশরীয় পাইলট। ইহুদিদের যাবতীয় পরিকল্পনা কায়রোর সরকারের কাছে ফাঁস করে দেন তিনি। আদিবের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী থমাস-সহ পাঁচ জনকে গ্রেফতার করে ‘পিরামিডের দেশের’ পুলিশ। বিচারে মৃত্যুদণ্ড হয় তাঁদের। এর পর ইজ়রায়েলি গুপ্তচরদের ফাঁসিতে ঝোলাতে দেরি করেননি তৎকালীন মিশরীয় প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসের।
০৮১৮
মিশরের অভিযান ব্যর্থ হলেও হতোদ্যম হয়নি মোসাদ। বরং ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন উদ্যমে কাজে লেগে পড়ে তারা। ‘পিরামিডের দেশ’ থেকে মিগ-২১ ‘চুরি’ করা একরকম অসম্ভব বুঝতে পেরে এ বার ইরাকের দিকে নজর ঘোরায় ইজ়রায়েলি গুপ্তচরবাহিনী। বাগদাদ বিমানবাহিনীর দু’জন পাইলটকে এই কাজের জন্য বিপুল টাকার লোভ দেখানো হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত এ ব্যাপারে রাজি হননি তাঁরা। ফলে ভেস্তে যায় তেল আভিভের দ্বিতীয় প্রচেষ্টাও।
০৯১৮
‘অপারেশন ডায়মন্ড’-এর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে ব্রিটিশ সাংবাদিক গর্ডন থমাসের লেখা ‘গিডিয়ান’স স্পাইস’ নামের বইতে। তাঁর দাবি, পর পর দু’বার ব্যর্থ হয়ে মোসাদ যখন কোনও কূলকিনারা পাচ্ছে না, ঠিক তখনই দেবদূতের মতো প্যারিসের দূতাবাসে হাজির হন এক ইহুদি এজেন্ট। ইরাকি বিমানবাহিনীর লড়াকু জেটের পাইলট মুনির রেদফার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন তিনি। ডলারের বিনিময়ে তাঁকে বশ করা যাবে বলে স্পষ্ট ইঙ্গিত দেন তিনি।
১০১৮
প্যারিসের দূতাবাস থেকে এই খবর মোসাদের সদর দফতরে পৌঁছোতেই হাতে চাঁদ পায় ইজ়রায়েল। এতটুকু সময় নষ্ট না করে রেদফার ব্যাপারে খোঁজখবর শুরু করে তারা। জানা যায়, খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণে কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন তিনি। তা ছাড়া বিদ্রোহের অভিযোগ তুলে কুর্দ জনজাতির উপর হামলার জন্যও বাগদাদের সরকারের উপর বেজায় খাপ্পা ছিলেন ওই ইরাকি জেট পাইলট। আর তাই দেশ ছাড়ার ফিকির খুঁজছিলেন তিনি।
১১১৮
১৯৬৪ সালে এ-হেন রেদফার সঙ্গে যোগাযোগ করতে ‘জর্জ বেকন’ ছদ্মনামে একজন এজেন্টকে বাগদাদে পাঠায় মোসাদ। ইরাকে পৌঁছে নিজেকে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী হিসাবে পরিচয় দেন তিনি। সংশ্লিষ্ট জেট পাইলটের সঙ্গে দেখা করতে তাঁকে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। শেষে ফোরাত নদীর তীরে একটি পার্কে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন রেদফা। সেখানে একটি বেঞ্চে বসে কথা বলেন দু’জনে।
১২১৮
ইহুদি এজেন্টকে ইরাকি জেট পাইলট জানিয়ে দেন, মিগ-২১ ‘চুরি’র পারিশ্রমিক হিসাবে ১০ লক্ষ ডলার নেবেন তিনি। এই অর্থ তাঁর সুইস ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে পাঠাতে হবে ইজ়রায়েলকে। তা ছাড়া শর্ত হিসাবে পরিবারের ৪৩ জন সদস্যের নিরাপত্তার আশ্বাস চেয়েছিলেন রেদফা, যা দিতে রাজি হয়ে যায় তেল আভিভ। ফলে ধীরে ধীরে গতি পেতে থাকে ‘অপারেশন ডায়মন্ড’।
১৩১৮
পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে রেদফার পরিবারের সদস্যদের ইরাক থেকে বার করে আনেন ইহুদি এজেন্টরা। তাঁদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা হয়। তাঁকে টাকা দেওয়ার দায়িত্বে ছিলেন ইজ়রায়েলের তৎকালীন সামরিক প্রধান অ্যাইজ়্যাক রবিন। সুইস ব্যাঙ্কে ডলার পাঠানোর আগে বাগদাদের জেট পাইলটকে ডেকে পাঠান তিনি। ইহুদিভূমিতে পৌঁছে ‘চুরি’ করা লড়াকু জেট কোথায় অবতরণ করবে, তা দেখে নেন রেদফা।
১৪১৮
অভিযানের কিছু দিন আগে স্ত্রী এবং কন্যাকে নিয়ে প্যারিসে যান ওই ইরাকি জেট পাইলট। সেখানেও ইহুদি এজেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। এর পর তাঁর পরিকল্পনার কথা স্ত্রীকে জানান রেদফা। এতে রেগে গিয়ে সব কিছু ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দেন রেদফার স্ত্রী। কোনওমতে তাঁকে শান্ত করেন ইজ়রায়েলি গুপ্তচরেরা। দেশে ফিরে স্ত্রীকে ইরান সীমান্তে পাঠিয়ে দেন রেদফা। সেখান থেকে কুর্দ বিদ্রোহীদের সাহায্যে সাবেক পারস্য দেশে ঢোকেন তিনি।
১৫১৮
ইরান থেকে নিরাপদে রেদফার স্ত্রীকে ইহুদিভূমিতে নিয়ে আসে মোসাদ। এর পর মিগ-২১ ‘চুরি’ করার ক্ষেত্রে তাঁর সামনে আর কোনও বাধাই ছিল না। ১৯৬৬ সালের ১৬ অগস্ট প্রশিক্ষণের সময় সংশ্লিষ্ট জেটটি নিয়ে চম্পট দেন তিনি। প্রথমে তুরস্কের দিকে উড়ে যান রেদফা। সেখানে মাঝ-আকাশে তেল ভরে জর্ডনের উপর দিয়ে উড়ে ইজ়রায়েলে বিমান নিয়ে নামেন তিনি। গোটা অপারেশনে সময় লেগেছিল এক ঘণ্টার সামান্য বেশি।
১৬১৮
মিগ-২১ নিয়ে রেদফা জর্ডনের আকাশে ঢুকতেই তাঁর জেট চিহ্নিত করে ফেলে সেখানকার বিমানবাহিনী। ওই সময়ে মাথা ঠান্ডা রেখে নিজেকে সিরিয়ার পাইলট বলে পরিচয় দেন তিনি। বলেন, প্রশিক্ষণ মিশন চলাকালীন রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে তাঁর জেট। ফলে সংশ্লিষ্ট মিগ-২১কে তাড়া করার কোনও তাগিদ জর্ডনের বায়ুসেনা অনুভব করেনি। রেদফাও নির্বিঘ্নে সেটা নিয়ে ইহুদিভূমিতে চলে আসতে পেরেছিলেন।
১৭১৮
এর পর ইরাক থেকে চুরি করে আনা মিগ-২১-এর খুঁটিনাটি জানতে মার্কিন প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীদের সাহায্য নিয়েছিল ইজ়রায়েল। অন্য দিকে এই ঘটনায় মস্কোর সঙ্গে বাগদাদের সম্পর্কে চিড় ধরে। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ওই সময় ইহুদি বিমানবাহিনীর বহরে ছিল ফরাসি জেট মিরাজ়। ধারে ও ভারে সোভিয়েত যুদ্ধবিমানটির তুলনায় এর শক্তি ছিল অনেকটাই কম।
১৮১৮
১৯৬৭ সালের জুনে ছ’দিনের যুদ্ধে আরব দুনিয়ার তিনটি দেশের সম্মিলিত বাহিনীকে পুরোপুরি পর্যুদস্ত করে ইজ়রায়েল। শুধু তা-ই নয়, মিশরের থেকে সিনাই উপদ্বীপ ও গাজ়া, সিরিয়ার থেকে গোলান মালভূমি এবং জর্ডনের ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক কব্জা করে ইহুদিবাহিনী। এই সাফল্যের নেপথ্যে ছিল আকাশযুদ্ধে তেল আভিভের অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা, চার বছর আগে যার পরিকল্পনা করেছিলেন দূরদর্শী ডেভিন বেন-গুরিয়েন এবং মোসাদের গুপ্তচরেরা।