মলাক্কা প্রণালীতে আগামী দিনে টহল দেবে ভারতীয় নৌসেনা। এ ব্যাপারে সিঙ্গাপুরের পূর্ণ সমর্থন পেয়েছে নয়াদিল্লি। ‘আগ্রাসী’ চিনকে ঠেকানোর ক্ষেত্রে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের এই সিদ্ধান্ত ‘খেলা ঘোরাতে’ পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৩:২৯
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
উত্তরে মালয় উপদ্বীপ। দক্ষিণে সাবেক সুমাত্রা (বর্তমান নাম ইন্দোনেশিয়া)। এই দু’য়ের মাঝে রয়েছে সরু একফালি সামুদ্রিক রাস্তা, নাম মলাক্কা প্রণালী। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অন্যতম ব্যস্ত পথ হিসাবে পরিচিত ওই এলাকায় আগামী দিনে টহল দেবে ভারতীয় নৌবাহিনী। কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের এ-হেন পরিকল্পনাকে ‘মাস্টারস্ট্রোক’ বলে উল্লেখ করেছেন সাবেক সেনাকর্তাদের একাংশ। একে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় ‘আগ্রাসী’ চিনের উপর চাপ বৃদ্ধির কৌশল হিসাবেই দেখছেন তাঁরা।
০২১৮
চলতি বছরের ২ থেকে ৪ সেপ্টেম্বর, তিন দিনের ভারত সফরে আসেন সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লরেন্স ওং। মোদীর সঙ্গে আলাদা করে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক সারেন তিনি। সূত্রের খবর, সেখানেই ওঠে মলাক্কা প্রণালীতে টহলদারির প্রসঙ্গ। এ ব্যাপারে প্রবল আগ্রহ রয়েছে নয়াদিল্লি। পরে যৌথ বিবৃতিতে এ ব্যাপারে ভারতকে সমর্থন করার কথা প্রকাশ্যেই জানিয়ে দেন সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লরেন্স। একে মোদী সরকারের বড় কূটনৈতিক জয় হিসাবেই দেখছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
০৩১৮
দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আগামী দিনে প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি সহায়তায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে ভারত ও সিঙ্গাপুর। এর মধ্যে থাকবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার, কৃত্রিম মেধা (পড়ুন আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা এআই), স্বয়ংক্রিয় সামরিক সরঞ্জাম এবং মানবহীন জলযান। পাশাপাশি, ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় সামুদ্রিক নিরাপত্তা এবং ডুবোজাহাজ উদ্ধারেও একযোগে কাজ করতে দেখা যাবে এই দুই দেশকে।
০৪১৮
এই যৌথ বিবৃতির মধ্যেই মলাক্কা প্রণালী নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘‘ওই এলাকায় নয়াদিল্লির টহলদারি সংক্রান্ত আগ্রহকে আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করছি। এতে আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং সামুদ্রিক সহযোগিতার সংজ্ঞা অনেকটাই পাল্টে যাবে।’’ যদিও কবে থেকে মলাক্কা প্রণালীতে এ দেশের জলযোদ্ধারা রণতরী নিয়ে ঢুকতে পারবেন, তা স্পষ্ট হয়নি।
০৫১৮
বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত সামুদ্রিক রাস্তা মলাক্কা প্রণালীতে মাদক, হাতিয়ার ও মানবপাচার বন্ধ করতে এবং জলদস্যু, সন্ত্রাসবাদ ঠেকাতে ২০০৪ সালে চুক্তি করে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুর। পরে তাতে যোগ দেয় তাইল্যান্ড। ফলে অচিরেই গঠিত হয় ‘মলাক্কা প্রণালী টহলদারি’ (মলাক্কা স্ট্রেট পেট্রল বা এমএসপি) নামের একটি ব্যবস্থা। বিশ্লেষকদের দাবি, সিঙ্গাপুরের সহযোগিতায় এর অংশ হয়ে ‘কৌশলগত’ দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ওই এলাকায় পায়ের তলার জমি শক্তি করতে চাইছে ভারত।
০৬১৮
বর্তমানে তিনটি স্তরে কাজ করছে ‘মলাক্কা প্রণালী টহলদারি’ ব্যবস্থা। এর মধ্যে রয়েছে নিয়মিত যৌথ নৌ এবং বিমানবাহিনীর পাহারা। এ ছাড়া ওই এলাকার চারটি দেশ সব সময়ে নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান করে থাকে। ২০০০ সালের গোড়ায় মলাক্কা প্রণালীতে জলদস্যুদের উৎপাত কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু গত দু’দশকে সেটা অনেকটাই নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে এই যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
০৭১৮
মলাক্কা প্রণালীতে ভারতীয় নৌসেনা টহলদারি শুরু করলে সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাটির বুনন যে কয়েক গুণ শক্তিশালী হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে নয়াদিল্লির এতে ঢুকতে চাওয়ার নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, এ দেশের সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রায় ৬০ শতাংশ পণ্যের আমদানি-রফতানিতে ব্যবহার হয় ওই রাস্তা। এ ছাড়া তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের (লিকুইড ন্যাচরাল গ্যাস বা এলএনজি) প্রায় পুরোটাই আসে মলাক্কা প্রণালী হয়ে।
০৮১৮
দ্বিতীয়ত, ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় চিনের সমুদ্র বাণিজ্যের একমাত্র রাস্তা হল মলাক্কা প্রণালী। যে কারণে ওই এলাকা বেজিঙের জন্য খুবই সংবেদনশীল। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের থেকে মলাক্কা প্রণালীর দূরত্ব মেরেকেটে ৬০০ কিলোমিটার। ফলে এক বার সেখানে ঢুকতে পারলে সংঘাতের সময়ে ড্রাগনের জন্য ওই রাস্তা সহজেই বন্ধ করতে পারবে এ দেশের নৌবাহিনী। এতে ভেঙে পড়তে পারে মান্দারিনভাষীদের অর্থনীতি।
০৯১৮
এ বছরের গোড়ার দিকে বেশ কয়েক বার চিনা গুপ্তচর জাহাজকে ভারতের পূর্ব উপকূলে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গিয়েছে। এ দেশের ‘বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকা’র (এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জ়োন বা ইইজ়েড) খুব কাছে চলে আসে তারা। এ ছাড়া বেজিঙের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ নৌসেনার বিরুদ্ধে রয়েছে ভারত মহাসাগর এবং আন্দামান-নিকোবর সংলগ্ন সমুদ্রের বিশেষ মানচিত্র তৈরি করার অভিযোগ। এগুলিকে জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ হিসাবেই দেখেছে নয়াদিল্লি।
১০১৮
বিশ্লেষকদের দাবি, ঠিক সেই কারণেই পূর্ব উপকূলের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে ‘মলাক্কা প্রণালী টহলদারি’ গোষ্ঠীতে আনুষ্ঠানিক ভাবে অন্তর্ভুক্তি চাইছে ভারত। কেন্দ্রীয় আধিকারিকদের যুক্তি, এতে এক দিকে যেমন নতুন করে প্রাকৃতিক সম্পদের হদিস পাওয়ার সুযোগ থাকছে, অন্য দিকে তেমনই সহজে প্রয়োজনীয় গোয়েন্দা তথ্য হাতে পাবে নৌসেনা। পাশাপাশি, এর মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির সুযোগ পাচ্ছে নয়াদিল্লি।
১১১৮
২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় নিজের অবস্থান মজবুত করতে ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকে নয়াদিল্লির বিদেশনীতির অন্যতম অংশ ছিল ‘লুক ইস্ট’। মলাক্কা প্রণালী টহলদারিতে ভারতের অংশ হতে চাওয়া এগুলিকেই প্রতিফলিত করছে বলে মনে করেন কূটনীতিকদের একাংশ।
১২১৮
বিশ্লেষকদের ধারণা, ভারতের দেখাদেখি আগামী দিনে সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাটির অংশ হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া। কারণ ওই এলাকা দিয়ে বিপুল পরিমাণে পণ্য আনা-নেওয়া করে এই তিন দেশও। তবে সেটা চিনের জন্য অনেক বেশি উদ্বেগের। কারণ, চতুঃশক্তিজোট ‘কোয়াড’-এর সদস্যপদ রয়েছে নয়াদিল্লি, ওয়াশিংটন, টোকিয়ো এবং ক্যানেবেরার। সম্মিলিত ভাবে মলাক্কায় বেজিঙের পণ্যবাহী বা রণতরী ঢোকা চিরতরে বন্ধ করতে পারে তারা।
১৩১৮
গত ৬ সেপ্টেম্বর অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডার দু’টি যুদ্ধজাহাজ হঠাৎ করে তাইওয়ান উপকূলে হাজির হলে কড়া প্রতিক্রিয়া জানায় বেজিং। চিনের সরকারি সংবাদসংস্থা ‘গ্লোবাল টাইম্স’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই এলাকায় ফ্রিগেট শ্রেণির ‘ভিল ডি কুইবেক’ নামের একটি রণতরী পাঠিয়েছে অটোয়া। তাদের সঙ্গে রয়েছে অস্ট্রেলীয় নৌবাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র বহনকারী ডেস্ট্রয়ার শ্রেণির ‘ব্রিজ়বেন’ নামের একটি যুদ্ধজাহাজ।
১৪১৮
‘গ্লোবাল টাইম্স’ জানিয়েছে, ৬ সেপ্টেম্বর ভোরে ১৮০ কিলোমিটার লম্বা তাইওয়ান প্রণালীর একাংশ অতিক্রম করে ওই দুই রণতরী। সংশ্লিষ্ট প্রণালীটি মূল চিনা ভূখণ্ড থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের সাবেক ফরমোজা দ্বীপটিকে আলাদা করে রেখেছে। যদিও বরাবরই তাইওয়ানকে তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবি করে ড্রাগনভূমির বর্তমান কমিউনিস্ট সরকার।
১৫১৮
২০২২ সালের অগস্টে চিনের আপত্তি খারিজ করে মার্কিন পার্লামেন্ট ‘কংগ্রেস’-এর নিম্নকক্ষ হাউস অফ রিপ্রেজ়েনটেটিভসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের পরেই নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়। ওই সময় থেকেই ধারাবাহিক ভাবে দ্বীপরাষ্ট্রটির আকাশসীমা লঙ্ঘন করতে শুরু করে বেজিঙের লড়াকু জেট। পরে পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাইওয়ান প্রণালীতে সপ্তম নৌবহর মোতায়েন করে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।
১৬১৮
পরবর্তী কালে সংঘাত কমাতে কিছুটা নমনীয় মনোভাব নেয় বেজিং এবং ওয়াশিংটন। কিন্তু, গত বছর তাইওয়ানের সাধারণ নির্বাচনে জিতে যায় কট্টর চিন-বিরোধী ‘ডেমোক্র্যাটিক প্রোগ্রেসিভ পার্টি’ বা ডিপিপি। ফলে দু’তরফে নতুন করে বৃদ্ধি পায় উত্তেজনা। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি থেকেই ড্রাগনের নৌ ও বিমানবাহিনীর বিরুদ্ধে ঘন ঘন দ্বীপরাষ্ট্রটির জল এবং আকাশসীমা লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে।
১৭১৮
এ বছরের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় এসে চিনের সঙ্গে ‘শুল্কযুদ্ধে’ জড়ান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। পরে ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ কর চাপিয়ে দেন তিনি। ফলে বিকল্প বাজারের খোঁজ শুরু করে দেয় নয়াদিল্লি। এই পরিস্থিতিতে ‘সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা’র বৈঠকে যোগ দিতে চিন সফর করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। সেখানে ড্রাগন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিঙের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক সারেন তিনি।
১৮১৮
চিনের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘ সীমান্ত বিবাদ রয়েছে। মোদীর ওই সফরের পর বেজিংকে বিশ্বাস করা কতটা ঠিক হবে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে তীব্র হয় জল্পনা। এই পরিস্থিতিতে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মলাক্কা প্রণালীতে পা রাখার চেষ্টা বেজিঙের রক্তচাপ কতটা বাড়ায় সেটাই এখন দেখার।